গুরু তুমি সুভাব দাও আমার মনে
একুশে সংবাদ : দেহ মোকামেই বাস করেন দয়াময়। অন্যকথায় মানবতরীতে ব্রহ্মান্ডের যাবতীয় উপাদান যেমন বিদ্যমান থাকে তেমনি ঈশ্বর বা খোদাতায়ালাও এ মানবদেহেই বিরাজ করেন। বাউলদের জীবনাচার, সাধনশীলন খানিক ভিন্নতর বটে। তবে মূলকথার বিবেচনায় সুফিদের সাধনমার্গের সঙ্গে বাউলধর্মের অনেকখানি মিল দেখা যায়। বহু লালনগানের মর্মেই সুফিবাদের ভাবধারা প্রকাশিত হয়েছে। যেমন ‘আপনাকে আপনি চেনা যদি যায়/ তবে তারে চিনতে পারি/ সেই পরিচয়।’
গত মচ্ছবে ফকির ইসাহাক আলী এ রকমই এক গানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমাকে সরাসরি একটি প্রশ্ন করে বসলেনÑ আপনার নাম কি? বললাম, আজাদুর রহমান। নাম শুনে তিনি আমার শরীর হাতড়ে বেড়ালেনÑ এই আপনার মাথা, নাক, চোখ, গলা গুর্দা, নাড়িভুঁড়ি, হাত, পা...। তাহলে আজাদুর রহমান কোথায়? কে আপনি?
ব্যাখ্যা দেখে আমিও কোনো কিনারা পেলাম না। সত্যিই তো ‘আজাদুর রহমান’ বলে আলাদা কেউ নেই। তিনি আরও যোগ করলেন, দেখেন এক পার্টসের নামের ওপর তো আরেক নাম বসবে না, একটা পার্টসের একটিই নাম। তাহলে আপনি কার?
আমি কোনো উত্তর খুঁজে পাইনে দেখে তিনি ফের জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার স্ত্রী-পুত্র আছে?
বললাম, আছে।
এরা কার?
আমি বললাম, আমার। উত্তর শুনে ইসাহাক আলীর যেন হাসি পেলÑএরা আপনার, না আপনি এদের। যতক্ষণ আপনার পকেটে পয়সা আছে ততক্ষণ এরা আপনার, ততক্ষণ আপনি ভালো। আপনার পয়সা নেই তো এরা আর আপনার নয়। শুধু কথায় কী চিড়ে ভেজে, দুধ কিংবা জল না দিলে। যখনই আপনি অর্থ বিনিয়োগ না করতে পারবেন তখনই আপনার এক পয়সার দামও থাকবে না। আপনার ৫০০ কোটি টাকা থাকতে পারে। ওটা আপনার। আমার জন্য নয়। আমার জন্য আপনি। আপনি আমার কি না? এটাই আমার কাছে বড় পাওনা।
একমনে কথা শুনতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেললামÑতাহলে এ আমার লোকগুলো কোথায় পাওয়া যাবে?
ইসাহাকের জবাব যেন রেডিই ছিলÑআমি যদি আপনার হতে পারি, তাহলে অবশ্যই আপনিও আমার। হওয়াটাই বিষয়। ইসাহাক থামলেন না, নিজের লেখা পদ বলতে লাগলেনÑ
বামে বেহেশত, ডানে দোজখ
পুলসিরাত পায়ের কাছে
ভয়ের কোনো কারণ নেই।
শেষের দিনে হবে পানা
আহম্মদ নাম হয় তার
গান শেষ করে নিজ থেকে মুখ পানে চেয়ে আর্জি করলেন, এখন কি আহম্মদ বা আহাদকে আপনি পাবেন! এই জন্য একজন মুর্শিদকে ধরতে হবে। ওলিয়াম মোর্শেদা। লালন পদ দিয়েছে শোনেনÑ
যেই মুর্শিদ সেই তো রাসূল
এতে নেই কোনো ভুল খোদাও সে হয়।
লালন কয় না এমন কথা
কোরআনে কয়।
আবারও ব্যাখ্যায় নামলেন, তার মানে কি? একজন মোমিন ব্যক্তি আরেকজন মোমিন ব্যক্তিকে পাবে। আপনি নিজে মোমিন হলেই মোমিনের দেখা পাবেন। তুমি কোথাও ছিলে, কোথায় এসেছ, কোথায় যাবে, কী হবে তোমার? আপনি আপনাকে চিনেছেন? জীবনে মিথ্যা কথা বলতে পারিনি। এতে কী হয়েছে? আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার কিছুই নেই। আমিই আমার নয়। আমি কে?
ইসাহাক ফকির একটানা বলে গিয়ে একসময় উদাস হয়ে গেলেন। আলুথালু মুখে উ™£ান্তের মতো কেবল সামনের দিকে চেয়ে থাকলেন। বললাম, শুনেছি কোকিলশাহ আপনার গুরু ছিলেন, তাকে কেমন ভক্তি করতেন? ইসাহাক ফকির উত্তর করলেন না, কেবল সামান্য কেঁপে উঠলেন। তার চোখ দিয়ে যেন আপনিতেই জল গড়িয়ে নামল। দৃশ্যটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আর কোনো প্রশ্ন করা ঠিক হবে না গুরুর প্রতি ইসাহাকের এমন অসামান্য ভালোবাসা দেখে সুফিদের মনে পড়ে গেল।
সুফিরাও নিতান্ত গুরুবাদী। তাদের আত্মার অনুসন্ধান প্রক্রিয়া, প্রেম, পরিশুদ্ধি, খোদার নৈকট্যলাভের পথ-মত সর্বোপরি গুরুবাদী ধ্যান-ধারণার সঙ্গে লালনভাবাদর্শের অনেকখানি মিল আছে। লালনবাদেও এক কথা। গুরুতে ভক্তিনিষ্ঠাই শ্রেষ্ঠ সাধনা। ধ্যান ছাড়া যেমন গুরুকে ধারণ করা যায় না তেমনি গুরুর প্রতি অসামান্য ভক্তি ছাড়া অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধ হয় না। গুরু নামের সুধাসিন্ধুতে বিন্দুরূপে পান করলে দীনবন্ধু মেলে। লালনকথায় যারে (গুরু) ভাবলে পাপীর পাপ হরে দিবানিশি ডাক তারে। সাধুরা নিজস্ব ব্যঞ্জনায় তাদের গুরুকে ভক্তি নিবেদন করে থাকে। গুরুই শিষ্যকে ভক্তি দেওয়া শেখান। ভক্তি আস্তে আস্তে গাঢ় হয়। ভক্তির বাহ্যিক প্রকাশেও এক ধরনের আলংকারিক ভঙ্গিমা লক্ষ্য করা যায়। এক বাউলের সঙ্গে অন্য বাউলসাধকের দেখা হলে তারা পরস্পর হাতজোড় করে প্রণাম জানায়। এমনকি গুরুদেশের কথা বলতে গিয়ে গুরুনাম উচ্চারিত হলেও শিষ্যরা হাতজোড় করে কপালে ঠেকায়। শুধু তাই নয়, গুরু-শিষ্যের দেখাসাক্ষাতে তারা চোখে চোখে ভাব বিনিময় করে। দৃষ্টি বিনিময়ে এ যেন এক অপূর্ব মিলনখেলা-
গুরুশিষ্য হয় যদি এক তার
সমন বলে ভয় কিরে আর
গুরুই শিষ্যের মনের মানুষ। যার সঙ্গে যার ভালোবাসা-ব্যবহারে যায় জানা। ভক্তিমান শিষ্য ভক্তিতে নুয়ে পড়ে গুরুর চরণে। গুরুপানে আত্মনিবেদন আর নিষ্ঠাই শিষ্যদের শ্রেষ্ঠ আরাধনা। ঢাকার বাউল জাহাঙ্গীরশাহ বললেন ‘গুরু তো ওপরেই থাকবেন, আমি নিচে থাকতেই চাই।’ আখড়াবাড়ির বজলুশাহ আরও গভীর করে বলেন-‘আমার উনিই তো সব।’ গুরুর গুরুত্ব বোঝাতে বজলু পদ দিয়ে মিনতি করেন-
দাতাগত ঋণ
বাড়িগত মিন
গুরুশিষ্য মিল
থাকে চিরদিন
তাদের নাই ভেদাভেদ
পুরায় মনের খেদ
বিচ্ছেদ কখনো থাকে না।
গুরু নিয়ে একবার পোড়াদহের রহিম ফকিরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, উত্তর দেওয়ার আগে তিনি কপালে আঙুল তুললেন। গুরু তো বড়সাধক। উনি কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাউলদের ডিসি ছিলেন। মানুষকে গুরু ভেবে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। গুরুর আদেশ মানলেই স্রষ্টার দর্শন পাওয়া যায়। ধ্যানের উপরে দেখা-সাক্ষাৎ-সাধনা। অদেখার ধর্ম নেই। ধর্ম দেখাতে।
বাউল হাবিবের কাছে গুরুই বড়। এমনকি ফকির লালনকেও তিনি গুরুর ওপরে ভাবতে পারেন না-‘গুরুই আমাকে সত্যপথ দেখিয়েছেন। সত্যমিথ্যার ভেদাভেদ বুঝিয়ে জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়েছেন। এখন কোনো দেবতা এসেও যদি বলে আমি তোমার গুরুকে সৃষ্টি করেছি তবু আমি গুরুকেই ওপরে রাখব। কেননা দেবতা তো মানুষরূপে গুরুর মাধ্যমে আমাকে জ্ঞান সঞ্চার করেছে।’
আসলে গুরুর ভাব-স্বভাব নিজ মধ্যে আত্মস্থ রেখে গুরুতে বিলীন হওয়ার আকাক্সক্ষাই শিষ্যের কামনা। কাতর শিষ্য তাই গুরুকেই কান্ডারি মেনে কাকুতি জানায়Ñ
গুরু তুমি সুভাব দাও আমার মনে
গুরু তুমি তন্ত্রেরও তন্ত্রী
গুরু তুমি মন্ত্রেরও মন্ত্রী
গুরু তুমি যন্ত্রেরও যন্ত্রী।
গুরুচরণ অমূল্যধন। গুরুপদে না ডুবিলে অকারণ জনম যাবে। সাতক্ষীরার বাউল কার্তিক দাসের কাছে গুরুই যেন সাক্ষাৎ খোদা। তার মতে, গুরু যদি বেশ্যালয়েও যায় তবুও সে পতিতপাবন। গুরুকে অবলম্বন করার পক্ষে কুমারখালীর আবদুর রশিদ বাউলের যুক্তি হলোÑ‘প্রাইভেট মাস্টারের কাছে পড়লে সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না। অন্যদিকে স্কুলের মাস্টার পড়া দেয়, পড়া নেয়। সেখানে সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। প্রাইভেট মাস্টার পড়ায় ভালো কিন্তু ডিগ্রি দিতে পারে না। সেজন্য মানবশিক্ষার মধ্যেও মাধ্যম লাগে এবং গুরুর দরকার হয়। তরিকার মধ্যে দাখিল না হলে আমি নবীর উম্মত বা খোদার বান্দা হতে পারব না।’
যারে দেখি না নয়নে
তারে ভজিব কেমনে?
এই হলো বাউলদের আত্মসান্ত¦না। বাউলমতে গুরুর মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব। তিনি কেবল দেহ রক্ষা করতে পারেন। ভাবশিষ্যদের বিশ্বাস, শারীরিক প্রেম ভালোবাসার মধ্যে প্রকৃত শান্তি নেই; প্রকৃত শান্তি আছে স্বর্গীয় ভালোবাসায়। মূলত ভক্তিই মুক্তিÑ
ভবে মানুষগুরু নিষ্ঠা যার।
সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার।
সুফিরা বিশ্বাস করে স্রষ্টা সৃষ্টির ভিতর দিয়েই নিজকে প্রকাশিত করেন। সৃষ্টিলোক ব্যতিরেকে তার আলাদা অস্তিত্ব নেই। তবে তিনি শুধু সৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন বরং সবকিছুর ঊর্ধ্বে আবার সব সৃষ্টির মূলেও তিনি। বিজ্ঞানী মুর্শিদের নির্দেশিত পথে প্রেমকাতর মুরিদ তাই আল্লাহকে সন্ধান করে ফেরেন। ঈশ্বরের সঙ্গে নিজ আত্মার মিলনের আকাঙ্খা বুকে ধারণ করে শিষ্য মূর্শিদের পথ ধরে আরও এগিয়ে যেতে থাকেন। দীর্ঘ ত্যাগসাধনার পর জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মা মিলে যায়। লালনগানেও যেন সেই সুর বাজে।
কররে পেয়ালা কবুল শুদ্ধ ঈমানে।
মিশবি যদি জাত ছেফাতে
এ তনু আখেরের দিনে।
আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন অতি গূঢ় আর রহস্যময় প্রক্রিয়া। লালনগানে মিলনপথ তথা ফানা বিষয়টি বহুবার এসেছে। ইমাম গাজ্জালির গ্রন্থেও আত্মা-পরমাত্মা বিলীন হওয়ার বিস্তারিত বিবরণ মেলে। আগুন-পানি-বায়ু-জল-মাটির সমন্বয়ে গঠিত হয়ে পার্থিব জগতে থাকলেও আত্মা আসলে আধ্যাত্মিক জগতের সত্তা। আত্মা ও পরমাত্মা বিভিন্ন বিচারে স্বতন্ত্র হলেও রূপ-স্বরূপের বিচারে তা অভিন্ন বটে। সুফিবাদে আল্লাহসত্তার গুণাবলীর মধ্যে আত্মপ্রকাশ হলো জাত থেকে ছেফাতে গমন।
আর লালনের ভাষায়Ñ
জাত এলাহি দিলো জুতে (জাত)
কিরূপে এলো ছেফাতে
লালন বলে নূর চিনিলে
ঘোচে ঘোর আঁধার।
প্রেমিক আত্মজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে প্রেমময়ে আত্মসমর্পণ করে। সে জন্য নফসের তাঁবেদারি থেকে নিজেকে সরাতে হয়। বৃত্তি, ধনলিপ্সা, ঈর্ষা, লোভ, অহংকার, হিংসা, আত্মগরিমা, সম্মান, লালসা, ভোজনস্পৃহা, ধর্ম সাধনপথে অন্তরায়। সব অন্তরায় দেহ থেকে বিযুক্ত করে তবে সাধনার পথে এগুতে হয়। খোদার নাম জপকরত নির্জনবাসে নির্বাক অবস্থায় ক্ষুধা সহ্য করে অনিদ্রায় এবাদত করতে হয়। আল্লাহ্তায়ালার ওপর তাওয়াক্কাল রেখে জীবনের পথে হেঁটে যেতে হয়। প্রেমের সঙ্গে রূপ ধ্যানে রেখে পরমাত্মাকেই জপ করতে হয়। সুফিদের এই কর্মকরণ যেন লালনের কথাই মনে করিয়ে দেয়Ñ
বিসমিল্লাহ্
মুর্শিদ আল্লাহ্
লা ইলাহা ইল্লাল লাহ্।
তোমার প্রেম প্রকৃত হলে তুমি খোদাকে পাবে। আরাধনার বলে তুমি এগিয়ে যাবে এবং ক্রম অগ্রসরশীল আত্মার নিকট নিত্যনতুন রহস্য উদঘাটিত হতে থাকবে। অতঃপর অসীম আনন্দকারের ক্রমিক নৈকট্য লাভ করতে থাকবে। এভাবে নিজকে আত্মজ্ঞানহীন ফানা করতে পারলেই পাওয়া যাবে অমৃত আনন্দলোকÑএ হলো সুফিসাধনার মহান এক শিক্ষা। যখন তুমি আমিত্ব ভুলে খোদাপ্রেমে আত্মহারা হবে তখন তুমি বিশ্বস্রষ্টার অস্তিত্ব টের পাবে। অনুভবে আসক্ত হয়ে প্রেমে লীন হবে। খোদার নৈকট্য লাভের পথ চেনা সোজা কথা নয়। একদিনে খোদা প্রেম হয় না। বহু গোলামি আর কঠোর ত্যাগসাধনার মাধ্যমে দেখা মেলে পরমপুরুষের, যে পথ দেখাতে জানে। সুফিদের এহেন খোদাপ্রেম যেন লালনেরই কথা। অপার জ্যোতির পুণ্যময় প্রেমবাণে লালন পদ বাঁধেনÑ
আল্লাহ্র নামের নাই যে তুলনা
সাদেক দিলে সাধলে বিপদ থাকে না
সে খুলবে তালা, জ্বলবে আলা
দেখতে পাবে জ্যোতির্ময়।
একুশে সংবাদ ডটকম/আর/২১-১০-০১৪:
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :