কবি শঙ্খ ঘোষের প্রিয় স্থান পাকশী
একুশে সংবাদ : ‘‘বাংলাদেশ বলতে যে জায়গাটি আমার সবচেয়ে ভালো লাগার, সেটি হচ্ছে পাকশী। ওখানেই আমার শৈশব কৈশোরের অধিকাংশ সময় কেটেছে। স্কুল জীবনের পুরোটাই পড়েছি পাকশী স্কুলে। আমার বাবা ছিলেন ওই স্কুলের হেড মাস্টার। আমার বড়দা ওই স্কুলে ছয় মাস আর ছোট ভাই ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। এ ক্ষেত্রে আমি আমার স্কুল জীবনের পুরোটাই বাবার স্কুলে পড়তে পেরেছি বলে একটা গর্ব গর্ব ভাব ছিল মনে। পাকশীতে আমার জীবনের খুবই মূল্যবান সময়গুলো কেটেছে। তাই পাকশীর স্মৃতি আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমার কাছে পৃথিবীর সেরা জায়গা হলো পাকশী।
এখনো মাঝে মধ্যে ঘুমে স্বপ্নের ভেতর দেখতে পাই পাকশী স্কুলে পড়ার সময়টাকে। এখানে বেশ বড় একটা চর ছিল। চরে বেড়াতে যেতাম। জলে নামতাম। মাঝে মধ্যে বিপদও হতো। একবার আমরা কজন বন্ধু মিলে বেড়াতে গিয়ে জলে নেমেছি। কিছুক্ষণ পর এক বন্ধু চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘আমি ডুবে যাচ্ছি আমাকে ধর, আমি তলিয়ে যাচ্ছি আমাকে ধর।’ ওই বন্ধুটি প্রায়ই মিথ্যা কথা বলত বলে কেউই প্রথমে পাত্তা দিচ্ছিল না। পরে দেখা গেল যে সত্যি সত্যিই ও ডুবে যাচ্ছে। তখন সবাই দৌড়ে গিয়ে ওকে টেনে তুলি। ও আসলে চোরাবালিতে পড়েছিল। আমার জীবনে কত স্মৃতি যে রয়েছে পাকশীর!’’
কী এক গভীর গোপন অজানা রহস্য আছে হার্ডিঞ্জ সেতুর। এই সেতুর আকর্ষণ আমাদের কাছেও প্রবল। প্রায় প্রতি ঋতুতেই আমরা একদিনের জন্য পাকশী ভ্রমণ করি। সেতুর নিচ দিয়ে প্রবাহমান পদ্মার ঢেউরের চূড়ায় রূপালী ওড়না উড়িয়ে নাচতে নাচতে এগিয়ে যায় বঙ্গোপসাগরের দিকে। বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত ও শীতকালে পদ্মার নানা রূপ কিন্তু সেতুর এক রঙ। ব্রিটিশ প্রকৌশলী এবং তার সহযোগিদের আপ্রাণ প্রচেষ্টার ফসল এই সেতু। অথচ এই সেতুতে রাতে বাতি জ্বলে না। পাশেই লালন শাহ সেতুতে রাত নামলেই জ্বলে ওঠে আলোর সারি। দূর থেকে মনে হয় সেই আলো যেন মালা হয়ে রয়েছে সেতুর গলায়।
সদ্য হেমন্তের সন্ধ্যায় রেল লাইনের প্রশস্ত ঢালে ঘন ঝোঁপে ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর ছোট ছোট পাখির কিচির মিচির মুগ্ধ করে। শান্ত-স্নিগ্ধ পুরো স্টেশন চত্বর। এখানকার ভৌগলিক ঈষদঞ্চু পুলক মহিমা, নৈসর্গিক দৃশ্য দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব যোগ্য। চেতনার আহ্লাদে পদ্মা তীরে এভাবে ভ্রমণের স্বাদ অন্যরকম লাগে। শৈশবের দূরন্তপনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কল্পনার শিহরণ। মুকুলিত জীবনে স্বপ্ন ফোটার বিস্ময়কর সন্ধিক্ষণে ভ্রমণ বড়ই প্রয়োজন বলে মনে হয়। আর তখনই দৃশ্যাবলী পছন্দ করে ফটোসেশনেও মজা করে অংশ নেয়া যায়।
ভ্রমণবিলাসীদের কাছে ক্রমাগত আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে পাকশী। অবশ্য সব ঋতুতে পাকশী আপনার কাছে উপভোগ্য মনে নাও হতে পারে। গ্রীষ্মকালে এখানে ল্যু হাওয়া বয়। তাপমাত্রা ওঠে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এই উত্তাপের আধিক্য হেতু বাতাসের চাপ যায় কমে। বাতাস গরম হয়ে আকাশের দিকে উঠে যায়। আবহাওয়া হয়ে ওঠে গরম। শীতে এই পাকশীর অন্য রূপ। এ সময় বৃষ্টি হয় না। কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গোটা এলাকা। পাকশী সেতু তো অস্পষ্ট হয়ে থাকে দুপুর পর্যন্ত। শরৎ-এ নদী অববাহিকায় নামে কাশফুলের ঢল। হেমন্তে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় শিউলি ফুলের সুরভি। ফলে শীতের শুরু থেকেই অর্থাৎ আশ্বিন মাস থেকেই পর্যটকদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। শরতের প্রথম দিকে পদ্মার ফেনিল জলরাশি আর উত্তল তরঙ্গমালার কলতান অনেকের মন নাড়া দেয়। তার পরেও হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এই তিন কালে এখানে বেড়িয়ে রোমাঞ্চিত হওয়া যায়।
গতানুগতিক জীবনের জাল ছিঁড়ে একদিনের ভ্রমণে পাকশীর বিকল্প আমি দেখি না। ব্রিটিশ প্রকৌশলীরা সেকালে কেমন বাংলোয় বাস করতেন, স্টিলের ওভার হেড ট্যাংক বসিয়ে পানি সরবরাহ করতেন, ডায়নামা চালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতেন- তা এখানে এলে জানা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিমান থেকে হার্ডিঞ্জ সেতুতে যে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল সেই বোমার খোসাসহ অসংখ্য দর্শনীয় বস্তুও এখানে এলে দেখা যাবে। আর রয়েছে নাম জানা-না জানা উদ্ভিদ। রাতে এখানে বাঁধনহারা আলোর স্বর্গ নেই। অনিন্দ্যসুন্দর পর্বত নেই। এক কথায় মেঘ পাহাড়ের খেলা নেই, অভয়ারণ্য নেই, লজ নেই, কিন্তু যা আছে তার সংখ্যাও কম নয়। আছে শিহরণ জাগানো নির্জনতা। বুনো ঝোঁপ যা চোখের ক্ষুধা মিটিয়ে দেয়। সৈকত নেই, বালিয়াড়ি আছে। আছে অসংখ্য ব্রিটিশ বাংলো; যা পরিত্যক্ত। এগুলো পর্যটন বিভাগের হাতে ছেড়ে দিলে পর্যটকেরা রাত যাপন করতে পারতেন। সূর্য মেঘে ঢেকে গেলে আবছা আঁধারে প্রকৃতি যখন ঢাকা পড়ে তখন নির্জনতা আরও ঘন হয়ে ওঠে।
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গড়ে ওঠার পর থেকে পাকশী সমাদৃত হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথের কলমেও পাকশী সংলগ্ন অনেক জায়গার নাম উঠে এসেছে ছিন্নপত্রের বিভিন্ন লেখায়। সেই পাকশী যে পর্যটনবান্ধব হয়ে পূর্ণ বিকশিত হতে পারে নি তার কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত এখানে এলে থাকার খুব সমস্যা। রাত যাপনের ভালো কোনো হোটেল নেই। ভালো মানের খাবার সংগ্রহ করাও একটু কষ্ট বৈকি! পদ্মায় গোসলের ব্যবস্থা থাকলে পর্যটকদের আরও টানতো। এখানে বসন্তকালে অনেকেই বনভোজন করতে আসেন। শিক্ষা সফরেও আসেন। তারা নদীর ওপর জোড়া সেতু দেখে মুগ্ধ হন। একটি দিয়ে চার চাকার গাড়ি অন্যটি দিয়ে শুধুই ট্রেন যাতায়াত করে।
পাকশীর জাগ্রত সৌন্দর্য ভ্রমণপিপাসু ও উদ্ভিদপ্রেমীদের অন্যরকম ভালোলাগায় ভরিয়ে তোলে। প্রতি ঋতুতেই এখানে ফোটে নানা বর্ণের ফুল। মাটির বুকে বৃষ্টিধারায় পদ্মেয় পাকশীর জমিতে উদ্ভিদের জীবন ভরে ওঠে। এখানে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রেলের স্লিপার। আর এগুলো দেখে আপনার মনে হতে পারে এ বুঝি রেলের শহর। ঘরের বেড়া থেকে শুরু করে খুঁটি, বিম, বৈদ্যুতিক খুঁটি প্রতিটি কাজেই রেলের কিছু কিছু জিনিসের বেশুমার ব্যবহার দেখে আপনার তাই মনে হবে। এমনকি শিশুদের দোলনায়ও রেলের স্লিপারের দেখা মেলে এখানে। অপর দিকে প্রাচীন বৃক্ষের শাখা-প্রশাখাগুলো প্রশান্তমাখা। রেলওয়ে অফিস, ভিআইপি গেস্ট হাউসের সামনে সাজানো বাগান। আশপাশের পথ শুনশান। কানে বাজে কেবল বাতাসের ফিসফিসানি। এই শহরে এক সময় বড় লাট ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ এসেছেন। ব্রিটিশ বাংলোগুলোতে সেই ইতিহাস ফিসফিস করে।
হার্ডিঞ্জ সেতুর খাঁজে খাঁজে হাজার হাজার চাতকের বাস। প্রাক সন্ধ্যায় কিচির মিচির ডাক নির্জনতা ভেঙে ডানা মেলে। এখানকার ঝোঁপগুলোতে আগে বন বিড়াল, খরগোশ, গুঁই সাপ, কাঠবিড়ালী প্রভৃতি দেখা যেত। মানুষ শিকার করে সব শেষ করে ফেলেছে। বাঁধে বসে আগে নদীতে শুশুক দেখা যেত। এখন দেখা যায় না। দেখা গেলেও হঠাৎ। তবে সব ঋতুতেই রকমারি পাখি দেখা যায়। ফুলটুসি, মৌটুসি, টুনটুনি, সুঁইচোরা, সাতভাই, বউ কথা কও, পেঁচা, দিনকানা, সাদাবক, কানাবক, মাছ রাঙা, গাংচিল, ঘুঘু, পানকৌড়ি, প্রভৃতি।
মাঘের শেষ পক্ষে বসন্তের আগমন দৃশ্য এখানে বেশ পরিস্কার বুঝা যায়। দূরের কৃষি ক্ষেতে সরষে ফুলের ঢল। অপর দিকে পরিত্যক্ত বাংলোর পাশে ভাঁটফুলের মেলে ধরা পাপড়ি আপনাকে মনে করিয়ে দেবে বসন্তের আগমনী গান। পাকশী তাপসঞ্চারি হিসেবে খ্যাত। শীতকালে প্রচণ্ড শীত নামে। তাপমাত্রা তখন সাত থেকে নয় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠা নামা করে। মধ্য দুপুরে তখন নদীতীরে হাঁটতে মন্দ লাগে না। ইচ্ছে হলে জেলেদের নৌকায় ঘণ্টা মিটিয়ে নদীর বুকে ভেসে বেড়ানো যায়। আর এবাভেই পাকশী এবং এখানকার হার্ডিঞ্জ সেতু একশ বছর ধরে শিহরণ জাগিয়ে আসছে পর্যটকদের।
একুশে সংবাদ ডটকম/আর/২৫-১০-০১৪:
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :