AB Bank
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

শিক্ষার গুণগতমান উন্নত করা অপরিহার্য


Ekushey Sangbad

০১:১২ পিএম, অক্টোবর ২৮, ২০১৪
শিক্ষার গুণগতমান উন্নত করা অপরিহার্য

একুশে সংবাদ : আমাদের মেয়ে মৌসি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। বরাবরের মতো এবারও অমর একুশে বইমেলা থেকে বই কিনতে যাওয়ার বায়না ধরেছিল সে। এবারে ছিল তার এক নতুন বায়না। এবার তাকে ইংরেজি ভাষায় লেখা গল্পের বই কিনে দিতে হবে। এ বুদ্ধি দিয়েছে তাকে তার ম্যাডাম। কেন ম্যাডাম প্রিয় ছাত্রী মৌসিকে ইংরেজিতে লেখা গল্পের বই কিনতে বলেছে, তার কারণ আমরা বুঝি। ভালো ইংরেজি জানা, ভালো করে ইংরেজি বলতে পারা-আমাদের একটি বাড়তি যোগ্যতা। এ যোগ্যতার কদর সর্বত্র। সামাজিক মর্যাদা এবং জীবন-জীবিকা অর্জনের প্রশ্নে ভালো ইংরেজি জানা-শোনাদের বাজারদর আমাদের এখানে খুবই রমরমা। আমাদের সমাজে শিক্ষা গ্রহণের অর্থ-স্বভাব-চরিত্রে, বিবেক-বুদ্ধিতে ভালো মানুষ হওয়া নয়। শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন দ্বারা নিজেকে বিকশিত করে সমাজ, দেশ-দশ কিংবা মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হওয়া-আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য মোটেও তা নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য এখানে কেবলই ক্যারিয়ার তৈরি করা। শিক্ষিত হওয়া মানে বিত্ত-বৈভব অর্জন করা। বাড়ি-গাড়ি, সহায়-সম্পদ বৃদ্ধি করা। রূঢ় অথচ বাস্তব কথা বলতে গেলে বলতে হয়-শিক্ষিত হওয়া মানে ঘুষ-দুর্নীতি করার যোগ্যতা অর্জন করা। বিভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতি এ দেশে চালু করার উদ্দেশ্যই ছিল এমন একটি শ্রেণী এখানে তৈরি করা-যারা হবে মূলতই আত্মোদর সর্বস্ব এবং একইসঙ্গে দালাল প্রকৃতির। এ খ্যাতিটি জাতি হিসেবে আমরা ভালোই রপ্ত করে নিয়েছি। স্বাধীনতার দীর্ঘ চার দশকে এসে সেই অভ্যেস তো আমরা ত্যাগ করলামই না বরং এ সময়ে এসে শিক্ষাকে আমরা বানিয়েছি পুরোপুরি পণ্য-ব্যবসার মাধ্যম। ফলে মৌসির ইংরেজি ভাষায় গল্পের বই পড়তে পারার যোগ্যতা অর্জনের বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে ফেলা যায় ততই মঙ্গল। সুতরাং তার ম্যাডামের বুদ্ধি মৌসি কেন-অভিভাবক হিসেবে আমাদের কাছেও একান্তভাবে কামনার বিষয় হয়ে উঠবে-এমনটাই তো স্বাভাবিক। অবশ্য শেষাবধি মেলায় গিয়ে তার পছন্দের বই কিনলেও ইংরেজি ভাষায় লেখা গল্পের বই আর কেনা হয়নি। নিজেই মৌসি তার সিদ্ধান্ত বদল করেছিল। শিক্ষার সঙ্গে পরিশীলিত জীবনবোধের সভ্যতা-সংস্কৃতি-প্রগতিশীলতা আর মনুষ্যত্বের সংযোগ সম্পর্ক থাকার যে ঐতিহাসিক উদ্দেশ্য, তা থেকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থান যোজন যোজন দূরবর্তী। এর পেছনের সুনির্দিষ্ট ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। সুদীর্ঘ আধিপত্যবাদী ধারাক্রমের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। একদিকে প্রাচ্য অর্থাৎ ইউরোপীয় ভাবধারার এবং অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যীয় মাদরাসাভিত্তিক ভাবধারার শিক্ষা ব্যবস্থা। ভিন্ন সংস্কৃতির এ দুই ধারা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে দখল করে রেখেছে আজও। সংস্কৃতিগত ভাবধারা বিবেচনায় জাতিগতভাবে আমাদের স্বকীয় সংস্কৃতির ধারার অবস্থান তেমন আমরা খুঁজে পাই না। একটি স্বাধীন দেশে বিদ্যমান এরূপ ভিনজাতীয় দ্বৈত ধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিতরা সমাজে দ্বিধাবিভক্ত সমাজ-মানস তৈরি করছে। এ আমাদের জন্য কতটা লজ্জার তা বলে বোঝানোর নয়। কিন্তু জাতিগতভাবে আমাদের সেরূপ সম্বিৎ আছে বলে মনে হয় কি? অথচ স্বাধীনতার মূল কথাই ছিল আমাদের স্বকীয় ভাষা-সংস্কৃতির ভিত্তিমূলে জাতিকে পুনঃস্থাপিত করা। স্বাধীনতার কথা আমরা বিরামহীনভাবে বলে যাই, জীবনপাত আর গলদঘর্ম অবস্থা আমাদের স্বাধীনতার প্রশ্নে। অথচ বাস্তব ক্ষেত্রে ভাষা-সংস্কৃতির স্বকীয় বিকাশের প্রতি আমরা চরম দৈন্য ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে চলছি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জীবনে ঊনবিংশ শতকের রেনেসাঁস এবং তার হাজার বছরের জীবন সংগ্রামের শক্তির ফসল। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে সেই শক্তির স্ফুরণ ঘটে-ভিন্নমাত্রার সংযুক্তি ঘটে। ক্রমে তা রাজনীতির জাতীয়তাবাদী আদর্শকে প্রচ-ভাবে প্রভাবিত করে। তখন বাংলা ভাষা সংস্কৃতির ছিল প্রচ- শক্তি। সেই শক্তি যেন মাটি ফেটে বের হয়ে আসা শক্তি। ষাটের দশকে আমাদের ছোটবেলায় অতশত বুঝতাম না। কিন্তু আজকের এ উন্মাতাল-অস্থির সময়ে অনুভব করি-সেই সময়ের বাঙালি জীবন কতটা শেকড় প্রোথিত ছিল। রেনেসাঁস ব্যক্তিত্ব রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বেগম রোকেয়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামকে মনে হতো আমাদের কত আপনজন। মনে হতো এরা পেছন থেকে আমাদের শক্তি জোগাচ্ছেন। বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি আর মানবসমাজ সবই যেন ছিল পরস্পর একাকার। মানুষের জীবন সংগ্রাম, সংস্কৃতির সংগ্রাম-এ মিলিত শক্তির সংগ্রামেরই নাম স্বাধীনতা সংগ্রাম-স্বাধীনতা যুদ্ধ-মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালি তার ভেতরের শক্তি দিয়ে রেডিওকে গ্রহণ করে এর নাম দিয়েছিল বেতার যন্ত্র, টেলিস্কোপকে দুরবিন, মাইক্রোস্কোপকে অণুবীক্ষণ যন্ত্র ইত্যাদি বলে নাম দিয়েছে। জীবন সংগ্রামের ধারার মধ্যেই আত্মস্থ করে নিজের করে নিয়েছে আরও অনেক কিছুকে। তখন বাংলা ভাষার শক্তি ছিল, জাতির ভেতরের শক্তি ছিল এবং সেই শক্তির আয়োজন ছিল রাজনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি জীবনের অপরাপর নানা ক্ষেত্রে। কিন্তু আজকে স্বাধীন দেশে বিশেষ করে সত্তরের পর আশির দশকে এসে যেন সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। ই-মেইল, মোবাইল, বস্নগ, ফেসবুক, কম্পিউটার-ইত্যাদি জাতীয় প্রযুক্তিগত শব্দ এবং আরও অসংখ্য শব্দ অবলীলায় এমনভাবে আমাদের ভাষায়, সংস্কৃতিতে, জীবনপ্রবাহে ঢুকে পড়ছে যেন এখানে 'স্বাতন্ত্র্য' এ জাতীয় কোনো প্রশ্ন থাকতে নেই। যারা সমাজের অভিভাবক, যারা শিক্ষার অভিভাবক, যারা রাজনীতির নীতিনির্ধারক, তাদের যেন এসব নিয়ে ভাববার কিছু নেই। বাংলা ভাষা আজ আগের মতো আর যেন জীবনের কথা বলে না-জীবন সংগ্রামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রাখে না। বাঙালির জীবনে বাংলা নয়, মনে হয় ইংরেজি হয়ে পড়েছে জীবনের ভাষা। আর ভিন জাতীয় প্রযুক্তি সংস্কৃতির তো কোনোই রাখঢাক নেই। শহর-বন্দর-নগর জীবনের পর এবার পল্লী জীবন পর্যন্ত গ্রাস করতে চলেছে। কোনো জাতির নিজস্ব ভাষার বিকাশ, উন্নতি, অগ্রগতি মানে জাতির ভেতরকে ঋদ্ধ করা, সুস্থ-সবল ও কর্মক্ষম করা। অস্তিত্বের সংগ্রামে সামর্থ্যবান করে তোলার ক্ষেত্রে জাতির স্বকীয়তার নিজস্ব সংস্কৃতি শিরদাঁড়ার মতো কাজ করে। কিন্তু সেদিকে জাতিগতভাবে আমরা যথেষ্ট মনোযোগী কি? মনে হয় না; বরং আমাদের রাজনীতিকরা, সুশীল সমাজ, এনজিওপতিরা মুখিয়ে আছে উপরদিকে। জাতির মানসকে তারা উত্তরাধুনিক ভাবধারার আলোকে গড়ে তুলতে চায়। জাতির সার্বিক মঙ্গল চিন্তায় তাদের এ জাতীয় প্রয়াসকে কোনোভাবেই ইতিবাচক তৎপরতার পরিচায়ক ভাবা যায় না। তাদের নীতি-আদর্শ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের বিশ্বায়নবাদী নীতির স্বপক্ষীয় নীতি। এ নীতি একরৈখিক বৈশ্বিক নীতি। এ নীতি দুর্বল জাতিগুলোর স্বকীয় বিকাশ, স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠন ও তার পরিপূরক আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠনের পরিপন্থী নীতি। সবলদের পক্ষে আর দুর্বলদের বিপক্ষের নীতি উত্তরাধুনিকতাবাদী নীতি। এ পথ রেনেসাঁসবিরোধী পথ। রেনেসাঁসের শক্তি মাটির শেকড়ের শক্তি, আপন ভাষা-সংস্কৃতি জীবন সংগ্রামের শক্তি, সৃজন-উদ্ভাবনের শক্তি, পায়ের নিচের মাটির ওপর ভর দিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার শক্তি। এ শক্তি প্রগতি সভ্যতার শক্তি। আর উত্তরাধুনিকতার শক্তি নিঃসীম শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার শক্তি, ইতিহাস মাড়িয়ে চলার শক্তি, অব্যাহত আধিপত্যবাদিতার শক্তি। এরূপ শক্তির দ্বারা বিশ্বায়নবাদী গন্তব্যের পথে জাতিকে নিয়ে যেতে চান আমাদের ক্ষমতাবানরা। একাত্তরের পর স্বাধীন রেনেসাঁসের পথভ্রষ্ট জাতি যখন ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকারকে বুকে আগলে চলতে চাইল-তখন থেকেই অশুভ শক্তি আছর করে জাতির ওপর। স্বাধীন পথে না হেঁটে ঔপনিবেশিকতাকে তো অাঁকড়ে ধরে থাকলামই তার ওপর আশির দশকে এসে ব্রিটিশ স্থলাভিষিক্ত মার্কিনিদের নীতির ফাঁদে পা দিলাম। বিশ্বায়নবাদী এ নীতির টানেই শাসক গোষ্ঠী ইংরেজি ভার্সনকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে। প্রথমে সীমিত পর্যায়ে এর প্রয়োগ শুরু হলেও এতদিনে তা ব্যাপকতর রূপ নিয়ে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। অর্থনীতির লুটেরা, দুর্নীতিবাজরা শিক্ষাকে বাজারদরে পরিণত করে কিনে নিতে চাইছে। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা চলে যাচ্ছে তাদের হাতের কব্জায়। আজকে পাবলিক খাতের শিক্ষা নিষ্প্রভ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে। সাধারণ শিক্ষা মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং-কারিগরি সব ধরনের শিক্ষা আজ ব্যবসার দামে বাজারে হাঁকা হচ্ছে। এখানে জাতির বিকাশ, জাতীয় ভাষা-সংস্কৃতি-মনন-মেধার বিকাশ, সৃজন-উদ্ভাবন-গবেষণা-এষণার বিকাশ সাধন নয়-লাভের ঝুলি ক্রমাগত স্ফীত করাটাই এখানে একমাত্র লক্ষ্য। গত বছর ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার শাহবাগে জাগরণ মঞ্চ গড়ে উঠেছিল। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গড়ে উঠেছিল এ আন্দোলন। এ জমায়েতে যারা অগ্রভাগে ছিল তাদের শিক্ষা-সাংস্কৃতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক একটি বিশেষ চিত্র লক্ষ করার মতো ছিল। একই বছরে এর মাস দুয়েক পরে রাজধানীরই মতিঝিলের শাপলা চত্বরে গড়ে উঠেছিল অন্য একটি জমায়েত। এখানে জমায়েতকৃতদেরও ছিল অন্যরকম এক বিশেষ পরিচিতি। শাহবাগ চত্বরে ইউরোপ-আমেরিকার ভাবধারা এবং শাপলা চত্বরে মধ্যপ্রাচ্যীয় ভাবধারার মাদরাসাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবির আদল লক্ষ করা গেছে। দুই ভিন্ন ও বিপরীত ভাবধারার উপস্থিতি ফুটে উঠেছে দুই জমায়েতে। কিন্তু ভালো করে লক্ষ করলে এ চিত্র যে পুরো দেশের মানুষের মাঝে বিদ্যমান, তা বোঝা যায়। এ চিত্র বিভাজনের চিত্র। এ বিভাজনের রয়েছে বিশেষ ঐতিহাসিকতা। দীর্ঘ আট বছরের মুসলমান শাসন এবং ২০০ থেকে ২৫০ বছরের পশ্চিমা ও মুসলমান শাসনের আগের আট ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন এবং তাদের স্ব-স্ব সংস্কৃতির প্রভাবে গড়ে উঠেছে এ ভিন্নতর চিত্র। কেবল দুই ভিন্নতর মানস নয়। স্বাধীনতার পর সত্তর পেরিয়ে আশির দশকে এসে পশ্চিমা প্রভাবের ক্ষেত্রে খানিকটা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে আমাদের দেশে। আন্তর্জাতিক পরিসরে আধিপত্য বিস্তারের মোড়লিপনা চলে যায় বিশ্বায়নবাদী আমেরিকার হাতে। এর প্রভাবে আগেকার ব্রিটিশ প্রভাবিত শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে যুক্ত হলো বিশ্বায়নী চরিত্র। তা ক্রমেই আমাদের এখানে দৃশ্যমান হতে হতে একবিংশ শতকে এসে সর্বব্যাপী একটা রূপ নেয়। শাহবাগে জাগরণ মঞ্চে এ দৃশ্যটিরই মঞ্চায়ন হলো। যারা অগ্রভাগে থেকে শাহবাগ মঞ্চ গড়ে তুলেছে তাদের শিক্ষা পটভূমিকাসহ যাবতীয় বিষয় লক্ষ করলে মূল ধারার পাবলিক শিক্ষা এবং ইংরেজি ভার্সনের সুস্পষ্ট একটি পার্থক্য দেখা যাবে। এখানে রাজধানীর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইংরেজি কারিকুলামের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য লক্ষ করার মতো অধিক। আর অপরদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি অর্থানুকূল্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের প্রভাব ছিল তুলনামূলক কম এবং তাদের অবস্থান হয়েছিল প্রথমদিকে পেছন সারিতে। অথচ আমরা দেখি, অতীতে এ দেশে যতগুলো বড় বড় আন্দোলন-সংগ্রাম সফল হয়েছে, সেসবের সবই সংঘটিত হয়েছে মূল ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে ও নেতৃত্বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয়ে থাকে স্বাধীনতা, স্বাধিকারসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার। জাগরণ মঞ্চের আন্দোলন হলো, এ রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে শাহবাগে। কিন্তু দৃশ্যতই এ আন্দোলনের কেন্দ্র হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর প্রধান কারণ, এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরা ছিল না। এ মঞ্চের আন্দোলন ও জমায়েত গড়ে তুলবার নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিল বড় লোকের ইংরেজি মিডিয়ামের প্রাইভেট স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর দুশ্চিন্তার কারণ কেবল যে এখানে তা নয়। জাতিগতভাবে ভাবনার বড় কারণ হলো-তথাকথিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা এবং যাদের দ্বারা গড়ে উঠেছে শ্রেণী হিসেবে তাদের উত্থানের ক্ষেত্রে দুর্নীতি আর লুটপাটের অর্থনীতির সংস্কৃতি সংযোগের অভিযোগ রয়েছে। কথা বাংলা ভাষা নিয়ে। আমাদের আজকের বাংলা ভাষার রূপ-প্রকৃতি এবং তার বিকাশ অন্য দশটা জাতির মতো নয়। এ ইতিহাস আমরা জানি। আজকের এ ভাষা নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আজকে পুঁথি-পুস্তকে, শিক্ষিত সুধী সমাজে, বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান প্রচার মাধ্যমে বাংলা ভাষার যেরূপ ব্যবহার সচরাচর লক্ষ করা যায় তার সঙ্গে এ দেশের মাটিলগ্ন আমজনতার মুখের ভাষার সম্পর্ক কিরূপে নির্ণীত হবে? প্রমিত বাংলা ভাষা বলে যাকে আমরা শিক্ষিত প-িতজনরা নাম দিচ্ছি তার সঙ্গেই বা মাটিলগ্ন গ্রামেগঞ্জে ছড়ানো জীবন সংগ্রামে নিয়োজিতদের সম্পর্ক কী এবং কেমন? আমাদের মতো শিক্ষিত দাবিদারদের ব্যবহৃত ভাষাকে ঢালাওভাবে বাংলা ভাষা নাম দিয়ে সব বাঙালির ভাষা বলাটা কি ন্যায্য হচ্ছে? এ ভাষা কি ভিন সংস্কৃতির প্রভাবিত শহরভিত্তিক মধ্যবিত্তের-উচ্চবিত্তের মুষ্টিমেয় মানুষের ভাষায় পরিণত নয়? ইদানীং মনে হচ্ছে, প্রমিত বাংলা প্রবক্তাদের সঙ্গে বিরোধ চলছে অত্যাধুনিক এলিট শ্রেণীর লোকদের। উপর তলার এরা নানা মাধ্যমে যেভাবে ইংরেজি ভাষার সংশ্লেষণ দ্বারা জগাখিচুড়ি মার্কা বাংলা ভাষা তৈরি করছে তাতে প্রচ- আপত্তি প্রমিতওয়ালাদের। দুই পক্ষের মধ্যে কি আদৌ কোনো বিরোধ আছে? গভীরে বিচার করলে বোঝা যাবে, উপরে উপরে বিরোধের ভাব আছে মনে হলেও ভেতরগতভাবে তারা অভিন্ন পথের সারথি। উভয়ই এরা অভিন্ন বিশ্বায়নবাদী পথের যাত্রী। প্রমিতদের দৃষ্টি রেনেসাঁস স্পিরিটের স্বপক্ষীয় থাকলে তারা থাকত নিচুমুখী। পরাধীন দেশের মতোই এ স্বাধীন দেশেও জীবনের অপরাপর ক্ষেত্রের মতো ভাষা সংস্কৃতির দিকে থেকেও আজ শহর-বন্দরের শিক্ষিত সমাজের সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের বিপুল আমজনতার পার্থক্য ক্রমাগত বেড়েই চলছে। কিন্তু আধুনিকতার পথযাত্রী উত্তরাধুনিকতাবাদী তথাকথিত প্রমিতদের দৃষ্টি সেদিকে নেই। আমরা যারা শিক্ষিত তারা নিজেদের মতো করে তথাকথিত অশিক্ষিতদের টেনে উপরে তোলার জন্য প্রাণপাত করছি, তারা-আমরা সঠিক পথে নেই। আমরা শেকড় বিচ্ছিন্ন নাড়ি ছেঁড়া। ভাষাকে নিয়ে আমরা এক সময় সত্যি সত্যিই স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু ভাষাকে নিয়ে আজকাল যা করছি, তা আর স্বপ্নের পর্যায়ে পড়ে না। এতদিনে তা আজ জাতির জীবনে ফ্যাশনে পরিণত। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের অর্জন আমাদের জীবনে আর আগের মতো আবেদন নিয়ে নেই। আমাদের ভাষা আন্দোলনের একুশে ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'-এর স্বীকৃতি দিনকে দিন মনে হচ্ছে জাতির জীবনে তৃপ্তির ঢেঁকুরের মতোই আবেদনী রূপ নিচ্ছে। আমাদের হাবে-ভাবে এমনই মনে হয়, ভাষা নিয়ে আমাদের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেছে। ভাষার উন্নতির জন্য জাতীয় পর্যায়ে আর তেমন করার কিছু নেই। আমাদের স্বপ্নচারী মন এখন মনে হয় অন্য এক হিসাবের খাতা মেলাচ্ছে। পৃথিবীতে এক নম্বর ব্যবহারিক ভাষা ইংরেজি। বাংলার অবস্থান ভাষাভাষীর হিসেবে অষ্টম। বাংলাকে টেনে ইংরেজির উপরে তোলার স্বপ্নে নয়, স্বপ্নচারী তথাকথিত বাঙালি মন আজ শতভাগ সমর্পণ করেছে ইংরেজির কাছে। 'গ্লোবাল ভিলেজ তত্ত্বে' আমরা বিভোর। বাংলা, বাঙালি, বাংলা ভাষা, জাতি, জাতীয়তা-এসব ক্ষেত্রে 'স্বাতন্ত্র্য' বা 'স্বাধীনতা' আমাদের কাছে আজ অর্থহীন ইংরেজির বদান্যতায় যত তাড়াতাড়ি এসব পেছনমুখী টান ভোলা যায়, ততই যেন আমাদের জন্য মঙ্গল। এ আত্মঘাতী পথেই জাতি হিসেবে আমরা দ্রুত ধাবমান। বাঁচার পথ নিয়ে কেউ ভাবেন না। আমরা স্বাধীনতার কথা বলি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বুলি আওড়াচ্ছি অবিরাম। আর বিরামহীনভাবে পরাধীনতার জালে জড়াচ্ছি। একটার পর একটা জালের ফাঁদে পড়ছি। শত্রু-মিত্র সব একাকার। জাতি হিসেবে আজ বিভ্রান্ত-পথভ্রষ্ট। মহানিদ্রার ঘোরে নিমগ্ন জাতি। এ ঘোর ভাঙতে জেগে ওঠা দরকার। দরকার স্বাধীনতার সঠিক পথে অগ্রসর হওয়ার। স্বাধীনতার প্রশ্নে রাজনীতি এবং অর্থনীতিকে সামনে এনে যেভাবে আমরা মুক্তির পথ হাতড়াচ্ছি তাতে যে পার পাওয়া যাচ্ছে না-সেই সত্য যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারব ততই মঙ্গল। জাতিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ এবং সার্বিক বিকাশের ভাষা সংস্কৃতির বিষয়কে আরও গুরুত্ব দিয়ে আরও বৃহত্তর ক্যানভাসে দেখতে হবে। কেবলই একাত্তর-বায়ান্নো কিংবা তার আগের বড়জোর ব্রিটিশ সময়ের রামমোহন-বিদ্যাসাগর কালের নবজাগরণ অবধি গিয়ে পরিতৃপ্ত থাকলেও চলছে না। মধ্য ও প্রাচীন বাংলার শ্রী চৈতন্যদেব এবং শীল ভদ্র-অতীশ দীপঙ্করের কালের বাঙালি জাগরণের উন্মেষকেও হিসাবের মধ্যে নিতে হবে। অর্থাৎ বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ভিত্তিতে জাতিকে পুনর্গঠনের পথে অগ্রসর হয়ে স্বাধীনতা-মুক্তি-সমৃদ্ধির খোঁজ করতে হবে। তার জন্য দরকার শিক্ষার গুণগতমান উন্নত করা। শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঙালির জীবন সংগ্রামের ধারার আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভিত্তিমূলে দাঁড় করিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বার্থে উন্নত যে কোনো ভাষাকে স্থান দিতে হবে সেই শিক্ষা ব্যবস্থার পরিসীমায়। মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম সাবেক সংসদ সদস্য ও আহ্বায়ক, জাগরণী শান্তি সংঘ। একুশে সংবাদ ডটকম/আর/২৮-১০-০১৪:
Link copied!