AB Bank
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

সাগরদ্বীপ মনপুরা, অনেক দিনের আশা হয়েছে পুরা


Ekushey Sangbad

০৩:০১ পিএম, অক্টোবর ২৮, ২০১৪
সাগরদ্বীপ মনপুরা, অনেক দিনের আশা হয়েছে পুরা

একুশে সংবাদ : মনপুরা নামে যে একটি উপজেলা রয়েছে তা অনেকের অজানা। মনপুরা ছবির সোনাই আর পরীর কথা মনে হলেই ইচ্ছে হতো দেখে আসি মনপুরা। তবে যতটুকু জানা যায় এই ছবির শুটিং মনপুরাতে হয়নি!
মনপুরা থেকে ঘুরে এসে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম-
“অনেক দিনের আশা হয়েছে পুরা,
৫ সেপ্টেম্বর গিয়েছি মনপুরা।
সাথে গেছে (প্রায় চল্লিশ জনের) বাহিনী,
সহিসালামতে ফিরে এসেছি, এবার লিখব সে কাহিনী!”
কিন্তু লিখতে গিয়ে মনপুরা সম্পর্কে জানার জন্য গুগলে সার্চ দিয়ে দেখা যায় মনপুরা চলচ্চিত্র ছাড়া মনপুরা উপজেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই লেখা নাই।
১৪২০ বাংলা সন শেষে ভূমি উন্নয়ন কর আদায়সহ অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও ভাল কাজ করায় উপজেলা ভূমি অফিস, হাতিয়ার সাথে সম্পৃক্ত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়ে গেট টুগেদারের আয়োজন করার প্রয়োজন অনুভব করেছিলাম। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনও স্যারের পরামর্শে অপূর্ব সুন্দর এ উপজেলায় সদলবলে দেখতে যাওয়া।
আসুন মনপুরা সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিই। বাংলাদেশের বৃহত্তম দ্বীপ জেলা ভোলা এবং বৃহত্তম দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া। ভোলা জেলার একটি উপজেলা মনপুরা, যা স্থানীয়ভাবে সাগরকন্যা হিসেবে পরিচিত। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি মনপুরা। চতুর্দিকে মেঘনা ও শাহবাজপুর নদীবেষ্টিত মনপুরা হাতিয়ার খুবই কাছে। তমরদ্দি ঘাটে দাঁড়ালে মনপুরার মোবাইল ফোনের টাওয়ার দেখা যায়।
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনার মোহনায় ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে মনপুরা উপজেলা গঠিত। এ চারটি ইউনিয়ন হলো মনপুরা, হাজীরহাট, উত্তর সাকুচিয়া, দক্ষিণ সাকুচিয়া। হাতিয়ার তুলনায় অনেক ছোট মনপুরা উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। আমার কাছে মনে হয়েছে হাতিয়ার তুলনায় মনপুরায় মানুষের ঘনবসতি কম।
কেমন করে মিয়া জমিরশাহের স্মৃতিবিজড়িত এই দ্বীপটির কাব্যিক নাম মনপুরা হলো, সে সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ‘ঐতিহাসিক বেভারিজ মনপুরার নামকরণ নিয়ে লিখেছেন- জনৈক মনগাজি নামের ব্যক্তি সে সময়ের জমিদার থেকে মনপুরা জমি লিজ নেন অষ্টাদশ শতাব্দীর যুগে। তখন তার নামানুসারে এ দ্বীপের নামকরণ হয় মনপুরা।’ ইত্তেফাকের একই প্রবন্ধ থেকে আরও জানা যায়, ‘স্থানীয়দের মতে এখানকার খাঁটি দুধ খেয়ে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলা দেখে মানুষের মন ভরে যেত। এ জন্য এর নামকরণ করা হয় মনপুরা।’
এবার ফিরে আসা যাক ভ্রমণ বৃত্তান্তে। ইউএনও ভাবির রান্না করা খিচুড়ি, গরুর মাংস, সালাদ আর ডিম এই ছিল আমাদের সকালের নাস্তা। সবাই এত মজা করে খাচ্ছিল দেখে মনে হচ্ছিল- এত মজার খাবার তারা যেন অনেক দিন খায়নি!
সার্ভেয়ার আব্দুর রব ভাইয়ের ‘কলকল ছলছল নদী করে টলমল ঢেউ ভাঙ্গে ঝড় তুফানেতে, নাও বাইওনা মাঝি ভীষণ দইরাতে...’ গানের সুরে ৫ সেপ্টেম্বর ভোরে আমরা মনপুরার উদ্দেশে যাত্রা করি। এই বৃষ্টি এই রোদ লুকোচুরির মাঝে আমাদের নৌকা মেঘনার ফেনিল ঢেউ পাড়ি দিচ্ছিল। আর গায়ে গতরে এবং বয়সের দিক থেকে বড়সড় আমাদের সহযাত্রীরা ছেলেমি দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছিল, যা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
শাহজাহান মেম্বারের যে নৌকায় করে আমরা যাত্রা করেছিলাম তাতে মাঝিমাল্লা ছিল পাঁচজন। এদের একজন সম্পদ। আসল নাম ছালাহউদ্দিন। আমি যখন লাইফ জ্যাকেট বিছিয়ে পাটাতনে শুয়ে আছি, সম্পদ গুটিসুটি মেরে আমার পাশে এসে বসল। আমিও মওকা পেয়ে তার সুখ-দুঃখের কাহিনী জানতে চাই। জানতে পারি, নৌকায় তার কাজ মূলত রান্না করা। তারা চার ভাই-বোন। আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় পড়ালেখা বাদ দিয়ে নৌকায় কাজ করছে। মালিকের টাকা বাদ দিয়ে যা থাকে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ সে পায়। নৌকায় রান্না হয় দিনে একবার। সকাল, দুপুর, রাতে তা দিয়েই তাদের চলে।
মনপুরায় পৌঁছে আমরা প্রথম যে ঘাটে নামি—তার নাম রাম নেওয়াজ ঘাট। এরপর পৌঁছি উপজেলা পরিষদসংলগ্ন হাজীরহাট ঘাটে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আব্দুল্লাহ আল বাকি স্যারকে না জানিয়েই আমাদের মনপুরা যাওয়া। কিন্তু মনপুরায় পৌঁছে স্যারকে ফোন করতেই গাড়ি পাঠালেন। এরপর এ বিশাল বহরকে স্যার তাৎক্ষণিকভাবেই বাসায় আপ্যায়িত করলেন। হাতিয়ার ইউএনও ভাবির শখ রান্না করা আর মনপুরার ইউএনও ভাবির শখ পাখি পালা! বাসার সামনে অনেক ধরনের পাখির বাসা।
এরপর আমাদের ঘুরতে বের হওয়া। মনপুরা দ্বীপটি ছোট, রাস্তাঘাট বেশি নাই। কিন্তু সবুজের সমারোহ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে কোন আংশে কম নয়। দেখতে দেখতে তালতলা বেড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম। যেখান থেকে জাহাজমারা আর নিঝুম দ্বীপের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার।
এখানে বলে রাখা ভালো- মনপুরার উপজেলা চেয়ারম্যান সেলিনা আক্তার চৌধুরী হাতিয়ারই মেয়ে। জাহাজমারার চর হেয়ার তার পিত্রালয়।
বেলা ২টার দিকে আমরা দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য হাতিয়ার ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, সোনাদিয়া গোলাম ফারুকের শ্বশুরবাড়ি আন্দিরপাড় যাই। খুব চমৎকার পরিবেশে ছিমচাম আয়োজন। দুপুরের খাবার সবাই খুব পছন্দ করে। এরপর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার একের পর এক গানে সবাই যখন মোহিত তখন নুরুল আশফ, আব্দর রব, আব্দুল মুকিত, আব্দুর রহিম, আবুল কাশেমসহ আমাদের আশপাশের লোকগুলোও তাদের ঝাঁপি খুলে বসে। এই আপাত নিরস মানুষগুলোর মাঝে যে এত প্রতিভা লুকিয়ে ছিল তা মনপুরা না গেলে বুঝতেই পারতাম না!
নদী বয়ে যায়, সময় ফুরিয়ে যায়। এবার হাতিয়ায় ফিরে আসার পালা। ৪টার দিকে আন্দিরপাড় থেকে নৌকায় উঠলাম। পাড়ে দাঁড়িয়ে মনপুরার ইউএনও বাকি স্যারসহ মনপুরার অনেক মানুষ আমাদের বিদায় জানায়।
'মাঝি নাও চাইড়া দে
ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে
গা রে মাঝি গা কোন গান...'
ফিরতে ফিরতে চলুন আবারও জেনে নিই মনপুরার কিছু কথা। প্রতিনিয়ত মেঘনা আর শাহবাজপুর নদীর ভাঙ্গাগড়ার শিকার মনপুরাবাসী প্রকৃতির সাথে লড়াই করে টিকে আছে। এ দ্বীপটির চারদিকে ছোটবড় দশটি চর। অনেকটা মুক্তোর মালার মতো। চর পিয়াল, চর নিজাম, চর সামসুউদ্দিন, চর পাতালিয়া, চর তাজাম্মুল, কালুগাজির চর ও কলাতলির চর এর মাঝে উল্লেখযোগ্য। চরগুলোতে যেন সবুজের বান ডেকেছে। এত সবুজ বাংলাদেশের খুব কম জায়গাতেই দেখা যায়। ম্যানগ্রোভ বনে চিত্রা হরিণের বাস।
মূল ভূখণ্ডের বাইরে হাতিয়ার চর খাসিয়া-ঘাইস্যার চরসংলগ্ন কলাতলিতে নতুন করে মানুষ বসবাস শুরু করেছে। আমরা আসার সময় কলাতলি থেকে আসা ট্রলারের যাত্রীদের কাছ থেকে জানতে পারি, প্রতিদিন দুটি ট্রলার মনপুরা থেকে কলাতলি আসা-যাওয়া করে। যাত্রী পিছু ভাড়া ৩৫ টাকা। সামর্থ্যবানরা মনপুরার পাশাপাশি ভোলা কিংবা ঢাকায় আলাদা বা বিকল্প বাসস্থান গড়ে তুলেছেন।
মনপুরা ও হাতিয়ার সংস্কৃতি প্রায় একই। হাতিয়ার মতো মনপুরাও নিয়ন্ত্রিত হয় কয়েকটি পরিবার আর বংশের লোকজনের মাধ্যমে। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য বংশগুলোর পদবী হলো চৌধুরী, হাওলাদার, পাটোয়ারী, সিকদার, মিঝি ইত্যাদি।
মনপুরার মানুষের ঘরবাড়ি তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দরিদ্র পরিবারেও নকশি কাঁথার ব্যবহার দেখা যায়। খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকে মনপুরার অধিকাংশ মানুষ সকালের নাস্তা হিসেবে পান্তা খায়। অল্প কিছু অবস্থাপন্ন পরিবারে পিঠা পুলি তৈরি করা হয়। উল্লেখযোগ্য পিঠাপুলির মঝে আছে পুয়া, চিতরুটি-চটকা, পাটিসাপটা (পাডি ফিডা), ছই পিঠা, ছান্নি পিঠা ইত্যাদি। শীতের হাঁস, মহিষের দধি, টাটকা ইলিশ, বড় কই, নদীর পাঙ্গাস, খেজুরের রস মনপুরায় তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়। মনপুরায় আরেকটি জিনিস আমার নজর কেড়েছে তাহলো—পাঙ্গাস ধরার চাঁই। এখানে দেখলাম প্রচুর পাঙ্গাস ধরা পড়ে, যা হাতিয়ায় দেখা যায় না।
আমার মতে, মনপুরার প্রধান সমস্যা অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। মন চাইলেই আপনি মনপুরা যেতে পারবেন না। বিদ্যুৎ সমস্যা, নদী ভাঙ্গন এ অঞ্চলের অন্যতম সমস্যা। সমস্যা সমাধান করে এর পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে মনপুরার মানুষ যেমন উপকৃত হবে তেমনি দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে।
লেখক : সহকারী কমিশনার (ভূমি), হাতিয়া, নোয়াখালী

একুশে সংবাদ ডটকম/আর/২৮-১০-০১৪:

Link copied!