AB Bank
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

চা-শ্রমিকদের জীবনমান...


Ekushey Sangbad

০৫:০৭ পিএম, অক্টোবর ২৯, ২০১৪
চা-শ্রমিকদের জীবনমান...

একুশে সংবাদ : আমাদের এই উপমহাদেশে চা-আবাদ শুরু হয় ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে আসামে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো ভারতে চা-শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশে চা-বাগান স্থাপন করা হয় চট্টগ্রামে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে এ দেশে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভিত্তিতে চা-বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয় মালনিছড়ায়। ব্রিটিশ কম্পানিগুলো ভারতের বিভিন্ন এলাকা (বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি) থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে চা-বাগানে শ্রমিক হিসেবে নিয়ে এসেছিল। তাদের বলা হয়েছিল- এমন একটি সুন্দর পাহাড় ঘেরা দেশে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেখানে গাছের পাতা খাঁটি সোনার। আর যদি কেউ সে গাছে ঝাঁকুনি দেয় অমনি সোনার পাতাগুলো ঝরে পড়ে। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে চা শ্রমিকদের সঙ্গে চার বছর মেয়াদি চুক্তি করে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো। এরপর থেকেই চা-শ্রমিকদের দাসত্বের জীবন শুরু। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত শ্রমিকদের সাথে মধ্যযুগীয় ভূমিদাসদের মতো আচরণ করা হতো। চা-বাগান শ্রমিকদের সন্তানদের পড়াশোনার কোনো সুযোগ ছিল না। এ অবস্থা ছিল আশির দশক পর্যন্ত। এখন পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। যদিও চা-চাষের শুরুর সময়ের ধারণা থেকে এখনও পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেননি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তারা। সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব এখনও পোষণ করেন চা-বাগানের কর্তারা। তবে পরিস্থিতি যে দ্রুত বদলে যাচ্ছে তা চা-বাগান ঘুরে সকলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল। টিকে থাকার নিরন্তর সংগ্রামে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। শ্রমিকেরা আগে বাগানের মালিক বা ম্যানেজারকে দেবতাজ্ঞান করে কুর্ণিশ করতো। আশির দশকের গোড়ার দিকেও চা-বাগানের মালিক ও ম্যানেজারকে চা-শ্রমিকদের মাটিতে শুয়ে গড় হয়ে প্রণাম করতে দেখেছি। এখন সে পরিস্থিতি নেই। চা-চাষের জন্য সরকারি জমি আগে যা ছিল এখনও তাই। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের তুলনায় চা-উৎপাদন বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। অভ্যন্তরীণ বাজারে চায়ের চাহিদা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে যেখানে দেশে মাথাপিছু চায়ের চাহিদা ছিল ২৩০ গ্রাম, এখন তা বেড়ে হয়েছে মাথাপিছু প্রায় ৪৫০ গ্রাম। চা-বাগানে এখন আবাদ হচ্ছে রাবার, লেবু, আনারস। এভাবে চলতে থাকলে এ দেশ থেকে চা রপ্তানী বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার চা-বাগান লিজ প্রদান করেছে ২৯টি শর্তে। শর্ত ভঙ্গ করেই রাবারসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করা হচ্ছে। এর জন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখলাম রাবার চারা তৈরি করা হচ্ছে। ‘ডানকান’-এর শমশের নগর ও লুংলা চা-বাগান এবং ন্যাশনাল টি কোং-এর মাধবপুর বাগানে চারা তৈরি হচ্ছে। শমশের নগর চা-বাগানে ৭ হাজার চারা তৈরি করা হয়েছে। এই চারাসমূহ রোপণ করার জন্য ৩৬ হেক্টর জমিও প্রস্তুত করা হয়েছে। অন্যান্য কয়েকটি বাগানেও জমি প্রস্তুত চারা রোপণের জন্য। এসব দেখার কেউ নেই! আমাদের দেশের বেশ কয়েকটি চা-বাগান রুগ্ন। এসব রুগ্ন চা-বাগানগুলো সবল করার ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে। চীন এবং ভারতের পাশাপাশি ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া এবং কেনিয়াতে চায়ের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। আমাদের জমি কম। তবে মাটি উর্বর। শ্রীলঙ্কায় চা-বাগান সমবায় ভিত্তিতে শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ায় চায়ের উৎপাদন বেড়েছে। চা-শ্রমিকদের বর্তমান মজুরি কাঠামো বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় এখনও চা-শ্রমিকেরা ন্যায্য মজুরি পায় না। প্রতিদিন একজন শ্রমিককে অবশ্যই ২৩ কেজি চা-পাতা উত্তোলন করতে হয়। তবেই সে পায় ৬৯ টাকা। মজুরি ও রেশন মিলিয়ে একজন শ্রমিক প্রতিদিন সর্বোচ্চ দেড়শ টাকা পায়। যেখানে একজন ক্ষেতমজুরের বর্তমান আয় প্রতিদিন তিনশ টাকা। একজন রিক্সা চালকের প্রতিদিনের আয় প্রায় চারশ টাকা। আমরা চায়ের চটকদার বিজ্ঞাপনচিত্রে চা-শ্রমিকের যে সুন্দর চেহারা এবং চকচকে পোষাক দেখি, প্রকৃত চিত্র তার উল্টো। চা-বাগানগুলো ঘুরে কয়েকশ চা-শ্রমিককে দেখলাম। তাদের রুগ্ন দেহ, ভগ্ন স্বাস্থ্য প্রমাণ করে তারা অপুষ্টির শিকার। পুষ্টিকর খাবার দূরের কথা তারা দু-বেলা পেটপুরে খাবার পায় না। চা-শ্রমিকরা নৈমত্তিক ছুটি পায় না। ভারতে ১৮ দিন কাজ করার পর একদিন ছুটি পেলেও বাংলাদেশের চা-বাগানে এই নিয়ম মানা হয় না। এখানে চা-শ্রমিকদের কাজ না থাকলে সে রেশনও পায় না। একইসঙ্গে বাসস্থানও হারাতে হয়। চা-শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থেকেও বঞ্চিত। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় চা-শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। সেইসঙ্গে শিক্ষা- স্বাস্থ্য সেবাসহ নানান সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে চা-শ্রমিকদের বাসস্থানের উন্নতি হয়নি। এটা বাগান মালিকদের দায়িত্ব। ছোট্ট কুঠুরিতে গাদাগাদি করে মা-বাবা, পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূ নিয়ে তারা বাস করে। কয়েকটি চা-বাগানের শ্রমিক কলোনি বা লেবার লাইন ঘুরে দেখা গেল পুরাতন ঘরে ঝুঁকির মধ্যে তারা বসবাস করছে। শমশের নগর চা বাগানের কুশল উড়িয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তার ঘরের দেয়াল ভেঙে গেছে। মেরামত করা তার পক্ষে সম্ভব না। বাগান কর্তৃপক্ষ লেবার লাইনের বাড়িগুলো সংস্কার করে দিচ্ছে না। এখানেই কথা হলো রেবতী রায়ের সাথে। বয়স ৩৮। বিয়ে করেননি। এমনই অবিবাহিত পাঁচজন ক্ষিণকন্ঠী-রুগ্ন, ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী নারীকে দেখলাম, যারা বিয়ে করেননি বা বিয়ে হয়নি। তবে এত কষ্টের মধ্যেও সেখানে ঢুকছে শিক্ষার আলো। চা-বাগানে এখন মালিকরা স্কুল গড়েছে। এ ছাড়াও স্কুল পরিচালনা করছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। যদিও সরকারি স্কুলের সংখ্যা কম। তবে বাগানের নিকটবর্তী জনপদে সরকারি স্কুল গড়ে উঠেছে। রাস্তা পাকা হয়েছে। যান চলাচল করে। শ্রমিকদের সন্তানেরা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে বাগানের স্কুলে। এক সময় নিম্ম বর্ণের দলিত চা-শ্রমিকদের ঘৃণার চোখে দেখত সাধারণ জনগণ। এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। চা-শ্রমিকদের সন্তানেরা এখন অনেকেই লেখাপড়া শেষ করে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। মাধবপুরের ন্যাশনাল টি কোম্পানির চা-বাগানের শ্রমিক বৃন্দাবন যাদব বলেন, ‘১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে দিনে মজুরি পেতাম এক টাকা। এখন পাই ৬৯ টাকা। রেশন আগের মতই আছে। রেশনের আটা ও চালের মান ভালো না। বড় ছেলে এসএসসি পাস করে সেনাবাহিনীতে চাকরি করছে। মেজ ছেলে এমএ পাস করেছে। ছোট ছেলে কলেজে বিএ পড়ে।’ মাধবপুর চা বাগানের শ্রমিক মুনমুনি যাদব বলেন, ‘ছেলে কলেজে পড়ে। ওকে কেরানির চাকরি দেয়া হয়েছে মাধবপুর চা-কারখানায়। বেতন দিনে ৬৯ টাকা।’ শিক্ষিত হলেও চা শ্রমিকদের সন্তানদের বড় পদে চাকরি যে দেয়া হয় না- অনেকেরই এমন অভিযোগ রয়েছে। কথা হলো চা-শ্রমিক চানু মুনিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ছোট দুই মেয়ে নবম ও সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। সরকার মেয়েদের পড়ার জন্য বৃত্তি দেয় তাই পড়াতে পারি। এখানে সবাই এখন স্কুলে যায়।’ এভাবেই চা-শ্রমিক পরিবারে শিক্ষার আলো তাদের এগিয়ে নিয়ে চলেছে সবার অলক্ষ্যে। শমশের নগর চা-বাগানের লেবার লাইনের দালিয়া অর্ণালের বাড়িতে গেলে তিনি জানালেন, তার পুত্রবধূ এবং পুত্র দুজনই স্কুলশিক্ষক। বাগানের স্কুলে তারা শিক্ষকতা করে। মেয়েটিও আইএ ক্লাস পর্যন্ত পড়ছে। সে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। লেবার লাইনের প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে জলাবদ্ধ পায়খানা, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ। যেখানে বিদ্যুতের লাইন নেই সে এলাকায় সোলার বিদ্যুৎ আছে। এই বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য বেসরকারি সংস্থাকে টাকা গুণতে হয়। প্রতিটি পরিবারেই দেখলাম গবাদি পশু। নতুন প্রজন্মের দম্পতিরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ করছে। বেশ কটি বাড়িতে টেলিভিশনও দেখলাম। এই পরিস্থিতি ইঙ্গিত দেয়, রুগ্ন বা ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারি এই সব চা-বাগান শ্রমিকদের ক্ষিণ কণ্ঠ একদিন সোচ্চার হবে। শিক্ষার আলোতে সময়ের সাথে সাথে সব বদলে যাবে। হয়তো সেদিন দূরে নয় যখন এ দেশের চা-বাগানের শ্রমিকরা সমবায় পদ্ধতিতে চা উৎপাদন করবে। তাতে উৎপাদনও বাড়বে। তখন দেশের চাহিদা পূরণ হবে, বাড়বে রপ্তানী, বাড়বে বৈদেশিক আয়। হাবিবুর রহমান স্বপন লেখক : সাংবাদিক একুশে সংবাদ ডটকম/আর/২৯-১০-০১৪:
Link copied!