লালমনিরহাট এখন শিমের জেলা
একুশে সংবাদ : বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সবুজ আর সবুজ। সেই সবুজে ভালো করে তাকালে দেখা যায় লকলকে লতার সমারোহ। লতার ফাঁকে ফাঁকে ছোট্ট নীল-সাদা অজস্র ফুল ফুটে আছে বুক সমান উচ্চতার মাচানজুড়ে। আর তাতেই ধরে আছে অসংখ্য শিম।
এই শিম কুমড়িরহাট ও দুরাকুটি হাটের বিক্রেতাদের কাছ থেকে চলে যাচ্ছে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। আর এভাবেই প্রতিদিন দেশের বৃহত্তম শিমের হাট কুমড়িরহাট ও দুরাকুটিহাটে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৩০ ট্রাক শিম।
লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালিগঞ্জে, আদিতমারি এবং লালমনিরহাট সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শিমের আবাদ হচ্ছে। এই এলাকায় শিম আবাদ শুরু হয়েছিল ১৯৯৭ সালে।
লালমনিরহাট জেলার কমলাবাড়ি গ্রামের সবজি ব্যবসায়ী আজিজুল ইসলামের কাছ থেকে উচ্চ ফলনশীল শিম বীজ এনে জমিতে আবাদ করেন। তিনি ওই বছর শিম বিক্রি করে লাভবান হন। ফলে প্রতিবেশী কৃষকরা তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হন। তাছাড়া বাজারে ক্রমশই শিমের চাহিদা বাড়তে থাকায় পরপর কয়েক বছর এলাকার কৃষকরা শিমের চাষ করেন। এভাবেই এলাকায় শিম চাষ সম্প্রসারিত হয়।
এই এলাকার চুনযুক্ত দো-আঁশ মাটিতে শিমের ফলনও ভালো হতে থাকে। আর এভাবেই কুমড়িরহাট এখন দেশের বৃহত্তম শিম উৎপাদন এলাকা। কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এই এলাকার নামকরণ করেছেন ‘শিমের গ্রাম’।
শিম চাষে ঝামেলা তুলনামূলক কম এবং অন্যান্য ফসলের তুলনায় লাভজনক। তাছাড়া বেশ কিছু দিন সময় নিয়ে ধীরে ধীরে গাছ থেকে শিম সংগ্রহ করে বিক্রি করা যায়। ২৩টি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কম-বেশি শিম চাষ হচ্ছে। বাড়ির আঙিনা এবং এলাকার বিভিন্ন সড়কের দুই পাশে শিমের মাচান রয়েছে। তাছাড়া বুড়িমারি থেকে রংপুরগামী মহাসড়কের দুই পাশে এবং দৈখাওয়াহাট থেকে দুরাকুটি সড়কের দুই পাশে মাঠের পর মাঠ শুধু শিম ক্ষেত।
শিম চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিম চাষ হয় দুইভাবে। নিজের জমিতে আবাদ করা ছাড়াও কৃষকরা অন্যের জমি লিজ নিয়ে আবাদ করেন। একেবারেই যারা ভূমিহীন তারাও জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন। বর্গা চাষিরা আবাদ করে এক তৃতীয়াংশ ফসল দেন জমির মালিককে। এতে জমির মালিকও অন্য ফসলের তুলনায় লাভ বেশি পান। যারা জমি লিজ নিয়ে আবাদ করেন তারা প্রতি বিঘা জমির জন্য মালিককে দেন ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা।
দুরাকুটি গ্রামের কৃষক হাসান আলী বলেন, ‘প্রতি বিঘা জমিতে শিম চাষে খরচ হয় ১৫ হাজার টাকা। উৎপাদন হয় প্রায় ১১ মণ শিম। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪০ হাজার টাকা।’
চলতি বছর শিমের ফলন ভালো হয়েছে বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। শিয়াল খোওয়া গ্রামের কৃষক আতাহার আলী জানালেন, তিনি শ্রাবণ মাসে শিম বীজ বপন করেছেন। আশ্বিনের শেষ সপ্তাহে প্রথম দফা শিম উঠিয়েছেন। চলতি মৌসুমে এলাকায় লাল রংয়ের নতুন জাতের শিম আবাদ শুরু হয়েছে। কৃষকরা এর নাম রেখেছেন ‘লালমনি শিম’। জৈষ্ঠ্য, আষাঢ় মাসে শুরু হয় লালমনি শিমের আবাদ।
তবে শিম চাষে কীটনাশকের ব্যবহার আগের তুলনায় বেড়েছে। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে কৃষক জমিতে কীটনাশক দিচ্ছেন স্প্রে মেশিনের মাধ্যমে। সপ্তাহে একবার তারা স্প্রে করেন। প্রায় ২৫ জন বিক্রয় প্রতিনিধি কীটনাশক সরবরাহ করছেন ওই এলাকার বিভিন্ন কৃষিপণ্য বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
কৃষক এই কীটনাশককে ‘বিষ’ বললেও বিক্রয় প্রতিনিধিরা জানান, হরমোন ও ভিটামিন। এতে ফলন ভালো তো হবেই পাশাপাশি রোগ-বালাইমুক্ত থাকবে শিম গাছ।
এলাকায় শিম চাষ করে অনেকেই ভাগ্য ফিরিয়েছেন। ফলে বেকার তরুণেরাও ঝুঁকছেন শিম চাষে। অনেকে ব্যবসা ছেড়ে মৌসুমের সময় শিম চাষ করছেন। ভেলাবাড়ি গ্রামের কৃষক ওসমান আলী, রোকন উদ্দিন, হেলাল আলী, নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথা হলো। তারা জানালেন, কয়েক হাজার কৃষক পরিবার শিম চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। অনেক অস্বচ্ছল পরিবার স্বচ্ছল হয়েছে।
মোগলহাটের হাফিজুর রহমান একজন সফল শিম চাষি। এলাকাবাসী তাকে ‘শিম হাফিজ’ বলে সম্বোধন করে। তিনি এবার আবাদ করেছেন ১৩ বিঘা জমিতে। তিনি আশা করছেন শিম বিক্রি করে আয় করবেন প্রায় ১৪ লাখ টাকা। মোগলহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জানালেন, ইউনিয়নের প্রায় ৮০ ভাগ পরিবারই শিম চাষের সঙ্গে জড়িত।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে জেলার পাটগ্রাম উপজেলায় ৯৫০ হেক্টর জমিতে ১০৫০০ মেট্রিক টন, হাতীবান্ধা উপজেলায় ৭২০ হেক্টর জমিতে ৮৬০০ মেট্রিক টন, কালিগঞ্জ উপজেলায় ১৫০ হেক্টর জমিতে ৬০০ মেট্রিক টন, আদিতমারি উপজেলায় ১৩২০ হেক্টর জমিতে ১২৬৩৪ মে. টন এবং সদরে ২১০ হেক্টর জমিতে ৩২১ মে. টন শিম আবাদ ও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে।
লালমনিরহাটের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. সাফায়াত হোসেন বলেন, ‘এ এলাকার মাটি শিম চাষের জন্য উপযোগী। ফলে শিম চাষে সাফল্য এসেছে।’
একুশে সংবাদ ডটকম/আর/২২-১১-০১৪:
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :