আতঙ্কের রাত কাটিয়ে বেঁচে থাকা...
একুশে সংবাদ : মালয়েশিয়াতে পড়াশুনার ফাঁকে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কোনো রকমের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই নানান ধরনের কাজ করেছি। দেশে যে কাজ কখনো করিনি শুধু অন্যদের করতে দেখেছি, সে ধরনের কাজ শুধুমাত্র চোখে দেখার আইডিয়ায় করেছি। এ নানান ধরনের কাজগুলোর মধ্যে একমাস এমন জায়গায় কাজ করেছি যেখানে প্রতিরাত কাটতো আতঙ্কে। রাত ৯টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ছিল আমার ডিউটি। টানা ১২ ঘণ্টা বসে থাকতাম জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ডাকাতের ভয় ও পুলিশের ভয়ে কাটত গোটা রাত। অনেক সময় জুয়াড়ি কাস্টমার অনর্থক গায়ে পড়ে ঝগড়া করতো, টাকা ধার চাইতো। আমি মালয়েশিয়ান ভাষা কোনরকম জানতাম। কিছু কিছু জুয়াড়ি খেলায় হেরে অযৌক্তিক কথাবার্তা বলে টাকা ফেরত চাইতো। আমি কিছু কথা বুঝতাম, কিছু বুঝতাম না। কিছুটা উত্তর দিতে পারলেও বেশিটা উত্তর দিতে পারতাম না। ভাষাগত ভয়ের কারণে কখনো টাকা ফেরত দিয়ে এমন মুহূর্ত সামাল দিতাম। সকালে যখন বসকে টাকার হিসেব বুঝিয়ে দিতাম তখন ভাষাগত জড়তার কারণে ঠিকভাবে তাকেও বুঝিয়ে বলতে পারতাম না টাকা ফেরত দেয়ার ঘটনা। ফলে এ টাকার হিসেব কাটা যেত আমার বেতন থেকে।
প্রতিটা মুহূর্তে আতঙ্ক নিয়ে যেখানে কাজ করতাম সেটি ছিল একটি জুয়ার আসর। ছিলাম ক্যাশিয়ার। ১২ ঘণ্টা এ জুয়ার আসর পরিচালনার পুরো দায়িত্ব ছিল আমার একার। আমার পর বাকি ১২ ঘণ্টা আরেকজন চালাতো। এ জুয়ার আসরটি বাইরে থেকে দেখতে আমাদের দেশের সাইবার ক্যাফের মতো। আমি যেটি পরিচালনা করতাম, একটি দোকানের ভেতর সর্বমোট দশটি কম্পিউটার ছিল। নয়টি কম্পিউটার খেলোয়াড়দের জন্য। আরেকটি থেকে কাউন্টারে বসে এ নয়টি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করতাম আমি। দোকানের সামনে এবং পিছনে দুইদিকে দু'টি দরজা। দু'টি দরজায় সিসি ক্যামেরা লাগানো। একজন জুয়াড়ি যখন খেলতে আসতো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সুইচ চাপলে কলিং বেল বাজতো। কাউন্টারে বসে মনিটরে দেখতাম। যদি সন্দেহজনক মনে হতো তাহলে দরজা খুলতাম না। জায়গায় বসে সুইচ চাপলেই দরজা খুলতো। একজন একটি কম্পিউটারে অনলাইনে হরেক রকমের জুয়া খেলতো। আমাকে কাউন্টারে টাকা জমা দিলে আমি আমার নিয়ন্ত্রিত কম্পিউটার থেকে টাকার পরিমাণ বুঝে পয়েন্ট ট্রান্সফার করতাম। এ পয়েন্টের মাধ্যমেই অনলাইনে জুয়া খেলা। যার নাম অনলাইন ক্যাসিনো। হারলে পয়েন্ট কাটা যায়। জিতলে পয়েন্ট বাড়ে। কেউ খেলা ছেড়ে যেতে চাইলে তার কম্পিউটারে কত পয়েন্ট আছে কাউন্টারে বসে দেখে সেই পয়েন্ট আবার কাউন্টার কম্পিউটারে ট্রান্সফার করে এনে খেলোয়াড়কে সে পরিমাণ ক্যাশ টাকা বুঝিয়ে দেয়া ছিল আমার কাজ।
এ ধনের অনলাইন ক্যাসিনো মালয়েশিয়াতে অবৈধ হলেও পার্শ্ববর্তী থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে চালানো হয়। তারপরেও প্রায় সময়ই এসব ক্যাসিনোতে পুলিশের অভিযান চলে। এ অভিযানে ধরা পড়লে আমি ছাড় পেতাম না। কারণ একেতো আমার স্টুডেন্ট ভিসা, কাজ করার অনুমতি নেই। দ্বিতীয়ত, আমি মুসলিম, মালয়েশিয়াতে মুসলিমরা এ ধরনের কাজ করতে পারে না। তৃতীয়ত, এ ব্যবসা অবৈধ। আমি যেখানে কাজ করেছি আমাকে বলা হয়েছিল, যদি অভিযানে পুলিশ সামনের দরজা নক করে তাহলে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে। আর যদি পিছনের দরজায় নক করে তাহলে সামনে দিয়ে পালাতে। আর যদি কোনো দরজা দিয়ে পালানোর সুযোগ না থাকে তাহলে যেন বসকে ফোন করি। বস এসে সমাধান করতে না পারলে অথবা তার আগেই পুলিশ দরজা ভেঙ্গে প্রবেশ করলে তো নিশ্চিত গ্রেফতার। আমার ভাগ্য ভালো থাকায় এমন অভিযানে পড়িনি। তবে এই বুঝি পুলিশ আসবে, এ ভেবে ভেবে ভয়ে থাকতাম।
এছাড়া ডাকাতের ভয় ছিল। সিসি ক্যামেরায় দেখা গেলেও সব মানুষ তো আর চেনা যায় না। এ ধরনের ক্যাসিনোগুলোতে ডাকাতি হয় যেভাবে- 'আলাদা আলাদাভাবে তিন চারজন এসে খেলতে বসে। খেলোয়াড়দের সংখ্যা কমে গেলে হঠাৎ তারা কাউন্টার থেকে জোরপূর্বক টাকা-মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। অস্ত্র হিসেবে তারা ছুরি-চাকু ব্যবহার করে।' ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা পেতে আমি ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতাম। কাউন্টারের ক্যাশে খুব অল্প পরিমাণ টাকা রাখতাম। বেশিরভাগ টাকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতাম, কম্পিউটারের কি-বোর্ডের নিচে, পড়ে থাকা নষ্ট যন্ত্রপাতির নিচে অথবা প্রকাশ্যে রাখা হিসেবের ভিন্ন ভিন্ন খাতার পাতার ভেতর। সঙ্গে খুব কম দামী মোবাইল রাখতাম। কলিং বেলের আওয়াজ পেলে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে দেখতাম, একসঙ্গে এক বা দুইয়ের অধিক মানুষ হলে দরজা খুলতাম না। দরজা খোলার সুইচ চাপার আগে সিসি ক্যামেরায় ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতাম, যে প্রবেশ করতে চাইছে বাইরে তার সঙ্গে আরও কেউ ছিল কিনা। সিসি ক্যামেরা ছিল দূর রাস্তা পর্যন্ত। তাই বাইরের অনেক কিছুই দেখতে পারতাম। কাউন্টারের আশেপাশে নিরাপত্তার জন্য লুকিয়ে রাখা ছিল অনেকগুলো হকস্টিক। তারপরেও একটু ভুলে হয়ে যেতে পারতো অনেক কিছু। সকালে যখন আরেকজন এসে ক্যাসিনো পরিচালনার ভার বুঝে নিতো কেবল তখনই বের হয়ে নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে পারতাম। আর ভাবতাম, আমি বেঁচে আছি!
একুশে সংবাদ ডটকম/আর/২৫-১১-০১৪:
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :