মীর মশাররফ হোসেন স্মরণে কিছু কথা
একুশে সংবাদ : মীর মশাররফ হোসেন জাতীয়তাবাদীর দৃষ্টিকে ধারণ করেছেন। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, তিনি এক বিশেষ সময়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। সে সময়ে বাংলা পদানত ছিল ব্রিটিশ রাজশক্তির হাতে। তাই তার বুকে স্বাধীনতার পদাবলি প্রবল ছিল। আর এ কারণেই আমরা দেখি ‘বিষাদ সিন্ধু’র এজিদ বধ পর্বে রচনা করেন, ‘কিন্তু স্বাধীনতা ধনে একবার বঞ্চিত হইলে সহজে সে মহামণির মুখ আর দেখা যায় না। বহু আয়াসে আর সে মহামূল্য রতন হস্তগত হয় না। স্বাধীনতা-সূর্য একবার অস্তমিত হইলে পুনরুদয় হওয়া বড়ই ভাগ্যের কথা।’
তিনি ভুলে যান না যে নাগরিক হিসেবে তারও দায় আছে। সে দায় এড়ানোর সুযোগ খুব কম। তাই ‘বিষাদ সিন্ধু’ আখ্যানে রচনা করেন, ‘রাজা প্রজারক্ষক, বিচারক, প্রজাপালক এবং করগ্রাহক। কিন্তু রাজ্যের যথার্থ অধিকারী প্রজা। দায়িত্ব প্রজারই অধিক। রাজ্য প্রজার রক্ষার দায়িত্ব বাসিন্দামাত্রেরই।’ ‘বিষাদ সিন্ধু’র মাধ্যমে মিথকে তিনি নবায়ন করেন। সমকালীন জীবন ও চিন্তার সঙ্গে প্রাচীন চিন্তনের সংযোগ ঘটানোর কাজটি করা হয়। নানা লেখার ভিড়ে তার ভাবনায় ছিল স্বদেশের মাটি ও মানুষ। তাই তার আখ্যান পাঠে কোনো ইসলামী মিথের সঙ্গে কথোপকথন হয় না বরং যুদ্ধবিরোধী একটি মানবিকতা বোধ জাগ্রত হয়। এখানেই মীর মশাররফ হোসেন নতুন চিন্তনের দিকে ধাবিত করেন। যেখানে ধর্মের চেয়ে বড়ো হয়ে যায় শিল্পের সাধনা, বাস্তব সমাজের নানা সংকট। একটি বিশেষ কালপর্ব থেকে ঘটনা নিয়ে রচিত হয়েছে মানবিক চিন্তনের এক অসামান্য দলিল।
মীর মশাররফ হোসেনের ৩৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার লেখা উল্লেখযোগ্য বইগুলোর নাম আগ্রহী পাঠকের কথা বিবেচনায় প্রকাশ করা হলো : ‘রত্নবতী’ (গদ্যে রচিত প্রথম বাঙালি মুসলমান রচিত গল্প), ‘গোরাই-ব্রিজ অথবা গৌরী-সেতু’, ‘বসন্তকুমারী নাটক’ (বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাহিত্যিক রচিত প্রথম নাটক। নাটকটি তিনি নওয়াব আবদুল লতিফকে উৎসর্গ করেন), ‘জমীদার দর্পণ’, ‘বিষাদ সিন্ধু’, ‘সঙ্গীত লহরী’ (১ম খণ্ড), ‘গো-জীবন’, ‘বেহুলা গীতাভিনয়’, ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’, ‘তহমিনা’, ‘গাজী মিয়াঁর বস্তানী’ ইত্যাদি।
আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস, এই সময়ে তাঁর রচনার সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে তার চিন্তনকে সন্ধান করা যায়। মীর মশাররফ হোসেন যে চিন্তনের কথা বলেন তাতে থাকে প্রগতিশীলতার ছাপ। আজ বলতে দ্বিধা নেই যে ‘বিষাদ সিন্ধু’ মুসলমান সমাজে ধর্মীয় চিন্তনে ক্ষেত্রেও একটি দেয়াল তৈরি করে। এই দেয়াল হলো মানবিকতার দেয়াল, তখন ধর্ম গৌণ হয়ে যায়। তাই তার কাব্যে ধর্ম প্রসঙ্গ থাকলেও তা স্বর্গের পথ নির্দেশ করে না। বরং মানবের মনে থাকা বেদনাকে বহন করে। ইতিহাসকে আশ্রয় করে তিনি নতুন ভাবনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তার ভাবনায় কারবালায় যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার মূল কারণ প্রেম। এজিদকে তিনি তৈরি করেছেন এক মানবীয় রূপ দিয়ে। এখানে জয়নাবের প্রেম বঞ্চিত এজিদ জিততে চায় তাকে। তাইতো এজিদ তার সৈন্যকে বলে, ‘জয়নাব লাভের আশাতরী বিষাদ সিন্ধু হইতে উদ্ধার করিতে চাও তবে এখনই অগ্রসর হও, আর পশ্চাতে ফিরিও না।’
মীর মশাররফ হোসেন অনুভব করেছেন ভালোবাসার এই পথের সঙ্গে আরেকটি পথ আছে তার নাম সপত্নীবাদ। এটাও ভালোবাসার আরেকটি চেহারা। এই ঈর্ষার পথে পরাজয় ঘটে সম্পর্কের, ভালোবাসার। মীর মশাররফ হোসেন এখানে ব্যক্তি জীবনের স্রোতে ডুব দিয়েছেন। হাসানের স্ত্রী জায়েদা সম্পর্কেও এ কথা খাটে। একই অবস্থা দেখা যায় মশাররফের ব্যক্তি জীবনে। তার দুই স্ত্রী আজিজান নেসা এবং বিবি কুলসুম। ধারণা করা যায় এই পথেই মীর উপলব্ধি করতে পেরেছেন সপত্নীবাদের যন্ত্রণা। এ বিষয়ে ‘বিষাদ সিন্ধু’তে রচনা করেন, ‘সপত্নীবাদ কোথায় না আছে? এক অন্তরে দুই মূর্তির স্থাপন হওয়া অসম্ভব। ইহার পর তিনটি যে কি প্রকারে সংকুলান হইল, সমভাবে সমশ্রেণিতে স্থান পাইল, তাহা আমাদের বুদ্ধিতে আসিল না।’
মীর মশাররফ হোসেন রচিত ‘বিষাদ সিন্ধু’ আখ্যানের শরীরে বাঙালি মুসলমান সমাজের আবেগ যেমন আছে অনুরূপ তার চিন্তন এবং ক্রিয়ার সঙ্গে ভ্রমণও রয়েছে। তিনি উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। তার গদ্যরীতি ছিল বিশুদ্ধ বাংলা। তিনি `জমিদার দর্পণ` নাটক লিখে তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের মর্যাদা লাভ করেন। মুসলিম সাহিত্যিকদের পথিকৃত মীর মশাররফ হোসেন অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করলেও আরবি-ফারসি মিশ্রিত তথাকথিত মুসলমানী বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করেছিলেন। তার `বিষাদ সিন্ধু` আজও পঠিত হয়। কারবালার করুণ ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে রচিত এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা।
একুশে সংবাদ ডটকম/আর/১৯-১২-০১৪:
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :