প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর বিশাল এক দিঘী নীলসাগর
একুশে সংবাদ : নীলও না, সাগর না, জানা- অজানা বাহারি গাছগাছালি ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত বিশাল এক দিঘীর নাম নীলসাগর। এর চারদিকে সবুজের সমারোহ, পর্যটন ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবণাময় নীলফামারীর একমাত্র পিকনিট স্পট তথা বিনোদন কেন্দ্র নীলসাগর পড়েছে নানা সমস্যার আবর্তে। খাবার পানি সংকট, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা, সংস্কার ও দেখভালের অভাবসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে আজকাল নীলসাগরমুখি হতে চান না অনেকেই। শত সমস্যার পরও জেলার একমাত্র দর্শনীয় স্থান বা পিকনিক স্পট কিংবা বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে দিন দিন বাড়ছে নীলসাগরের জনপ্রিয়তা। নীলফামারী জেলার বিনোদন পিপাসু মানুষ হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটাতে নীলসাগরের ওপরই নির্ভরশীল। উজ্জ্বল সম্ভাবণাময় এ নীলসাগরকে আধুনিকায়ন করে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুললে পরিবর্তন হবে এখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থাা।
একনজরে নীলসাগরের অবস্থান: নীলফামারী জেলা সদরের গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাঙ্গা মৌজায় ৫৩.৯০ একর জমির ওপর নীলসাগরের অবস্থস্থান। নীলসাগরে ৩২.৭০ একর পুকুর/পানির অংশ, রয়েছে ৮.৭০ উত্তর ও পূর্ব পাড়ে .৫৪ একর পশ্চিম পাড়ে এবং ১১.৯৬ একর দক্ষিণ পাড়ে। নীলফামারী জেলা শহর জিরো পয়েন্ট চৌরঙ্গী মোড় থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান।
নামকরণ: সঠিক কোনো তথ্য না থাকলেও কথিত আছে, অষ্টদশ শতাব্দীতে রাজার অগণিত গরু- মহিষের পানির চাহিদা মেটাতে প্রায় ৫৪ একর জমিতে খনন করা হয় দীঘিটি। মেয়ে বিন্নাবতীর নামানুসারে নাম দেওয়া হয় বিন্নাদীঘি। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের উদ্যোগে এবং স্থানীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বিন্নাদীঘির নাম পরিবর্তন করে ‘নীলসাগর’নামকরণ করা হয়।
নীলসাগরের আকর্ষণ: নীলসাগরের বিশাল দীঘির চারদিকে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ- গাছালির সমাহার। পানি আর সবুজ মিলে সে এক অপরুপ দৃশ্য ছায়া ঘেরা দীঘির চারপাশ বাঁধানো। শান বাঁধানো দীঘির চারপ্রান্তে রয়েছে সিঁড়ি। এসব সিঁড়ি গোসল করার ঘাট হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া দীঘির পাড়ে পাকা রাস্তার কিছুদুর পর পর দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে সুদৃশ্য বিশ্রামাগার, ছাতা প্রকৃতির বসার স্থান। এখানে শিশুদের জন্য সীমিত আকারে দোলনা, নাগরদোলার ব্যবস্থা রয়েছে। শীতকালে সাইবেরিয়াসহ শীতপ্রধান দেশগুলো থেকে আসা অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। এটিই মুলত নীলসাগরের প্রধান আকর্ষণ। মাঝপুকুরে বসে ভিনদেশী হাজার পাখির মেলা। দীঘিতে ফোটে শাপলা। শাপলার পাতায় পাখির অস্তিত্ব অসাধারণ ও প্রাকৃতিক দৃশ্যে যোগ করে ভিন্ন মাত্রা। প্রকৃতির অপূর্ব দৃশ্য দেখতে শীতকালে এখানে ছুটে আসেন নানা বয়সের মানুষ। কল্পকাহিনী ঘেরা নীলসাগরে প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে বসে ‘বারুনী স্থান’ মেলা। মেলায় থাকে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। এখানে এসে পাওয়া যায় প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়া, শত ব্যস্ততার যান্ত্রিকতা এড়াতে ও ক্লান্তি দূর করতে তাই নীলফামারীর মানুষ ছুটে আসেন এখানে। শুধু নীলফামারীই নয়, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর ও দিনাজপুরসহ আশেপাশের কয়েকটি জেলা থেকেও বিপুল সংখ্যক মানুষ এখানে বেড়াতে, আড্ডা দিতে আসেন। এখানে ছোট চিড়িযাখানা রয়েছে। তবে তাতে কোন জীবজন্ত নেই।
জনশ্রুতি: জনশ্রুতি রয়েছে, ১৯৯৩ সালে সংস্কারের সময় দীঘির তলদেশে পাওয়া গিয়েছিল স্বর্ণ, রৌপ্য এবং কষ্টি পাথরের মূল্যবান মূর্তি। তবে মজার ব্যাপার হলো, মাটির তলদেশে মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও সেখানে বাস করতো বিশাল আকৃতির দুটি মাছ। ডুবুরিরা এই মন্দিরের ভেতরে যেতে পারেননি। কারণ, তাদের নাকি অলৌকিকভাবে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল। কথিত আছে, এক সময় নাকি নীলসাগরের পানি শুকানোর জন্য অনেকগুলো মেশিন বসানো হয়েছিল। কিন্ত পানির উচ্চতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। লোকমুখে শোনা যায়, অতীতে গ্রামের লোকজন বিন্নাদীঘির পানিতে গাভীর প্রথম দুধ উৎসর্গ করতেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুধ চক্রাকারে ঘুর্ণায়মান অবস্থায় দীঘির মাঝখানে চলে যেত। তাদের বিশ্বাস ছিল, এতে গাভীর দুধ বেশি হবে এবং অনিষ্টকারীর দৃষ্টি থেকে গাভীটি রক্ষা পাবে। সত্য- মিথ্যা যাই হোক, দিন দিন মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধি এবং জনপ্রিয়তা বাড়ায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে নীলসাগরে। এ ব্যাপারে নীলফামারী জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৯৮-২০০১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নেওয়া প্রকল্পে ৮০ লাখ ৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নীলসাগরের ভূমি উন্নয়ন, সীমানা প্রাচীর, আরসিসি বেঞ্চ, গার্ডশেড, রেষ্ট হাউস, টিনসেড ঘরসহ সেড, নলকূপ, অভ্যন্তরীন সড়ক, পার্কিং এলাকা, আসবাবপত্র, ক্রোকারিজ, বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা, মৎস্য চাষ ও পরিচর্যাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা: প্রকল্পভুক্ত দীঘির পাড়ে বনায়ন, বিরল প্রজাতির বৃক্ষরোপন দীঘিকে আকর্ষণীয় ও নিরাপদস্থল হিসাবে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা, অতিথি পাখির অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা, মাছ চাষে আয় বৃদ্ধি এবং চিত্ত বিনোদন ও অবকাশ যাপনের স্থান হিসাবে নীলসাগরকে গড়ে তোলাই মুলত এসব প্রকল্পের উদ্দেশ্য। ১৯৯৯ সালের ৭ ডিসেম্বর আওয়ামীলীগ সরকারের তৎকালীন ভূমি প্রতিমন্ত্রী রাশেদ মোশাররফ নীলসাগরকে ‘পাখির অভয়ারন্য’ হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন। দর্শনার্থী, বাই সাইকেল, মোটর সাইকেল, প্রাইভৈটকার, মাইক্রোবাস, জিপ, মিনিবাস, বাস, প্রবেশ ফি, রেষ্ট হাউস ভাড়া, মৎস্য শিকার, ফল, ইজারা ইত্যাদি থেকে আসা অর্থই নীলসাগরের আয়ের উৎস। নীলসাগরে প্রবেশ ফি জনপ্রতি ৫ টাকা। এখানে বাইসাইকেল পার্কিংংয়ের ফি ৫ টাকা, মোটর সাইকেল ২০ টাকা, মাইক্রোবাস ৩০ টাকা এবং বাস পার্কিংয়ের ফি ১শ’ টাকা।
যাতায়াত ও থাকা-খাওয়া: ঢাকা ছাড়াও দূরবর্তী স্থান থেকে নাবিল, হানিফ, শ্যামলী, আগমনি, এসআর পরিবহনের বাসে বা রেলওয়ের নীলসাগর আন্ত:নগর ট্রেনে করে নীলফামারী শহরে এসে পৌঁছানোর পর স্থানীয় পরিবহনে নীলসাগরে যাওয়া যায়। নীলফামারী শহর থেকে দেবীগঞ্জগামী বাস ছাড়াও রিকশাভ্যান, মাইক্রোবাস এবং মোটর সাইকেলে করে অনায়াসে যাওয়া যায় নীলসাগরে। এখানে রাত যাপনের জন্য রেষ্টহাউস রয়েছে। জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে ভাড়া নেওয়া যায় নীলসাগরের রেষ্টহাউস। ২ কক্ষ বিশিষ্ট রেষ্টহাউসে ২৪ ঘন্টার জন্য সিঙ্গেল বেডরুমের ভাড়া ২০০ এবং ডাবল বেডরুমের ভাড়া ৪০০ টাকা। আর থাকা- খাওয়ার জন্য এখানে আলাদা কোন রেষ্টুরেন্ট নেই। তবে রেষ্টহাউস কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা খাবারের ব্যবস্থা করে দেয়।
সমস্যা ও সম্ভাবনা : জেলার একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও আশানুরুপ উন্নয়ন হয়নি নীলসাগরের। বরং যেটুকু রয়েছে, সেটুকুও নষ্ট হতে বসেছে। এখানকার রাস্তা সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখানে খাবার পানির জন্য কোনো টিউবওয়েলের ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে বসার জন্য ছাতা থাকলেও সেগুলো রয়েছে ভাঙাচোরা অবস্থায়। বেশিরভাগ দোলনার স্ট্যান্ড থাকলেও দোলনা নেই, মসজিদ থাকলেও সেখানে আদায় হয়না নামাজ। বিনোদনের জন্য মানুষ এলেও এখানে নেই কোনো বিনোদনের পরিবেশ। সীমানা প্রাচীরের অবস্থাও নাজুক হওযায় বাইরে থেকে নীলসগরের সব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যায়। পুকুরের পানিতে ভেসে বেড়ানোর জন্য স্পিডবোড থাকলেও সেগুলো রয়েছে অকেজো হয়ে। গোসল করার জন্য ঘাট থাকলেও সংস্কার না করায় সেগুলোতে গোসল করাই এখন দায়। শিশুদের জন্য আলাদাভাবে তেমন কিছুই গড়ে ওঠেনি। যে দোলনা ও নাগরদোলা রয়েছে, তাও ব্যবহারে উপযোগি নয়। নীলসাগরে কয়েকজন নিরাপত্তা রক্ষী রয়েছেন। কিন্ত তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। খুব সহজে ভাঙা প্রাচীর টপকে প্রায়ই টোকাই আর ছিনতাইকারীরা ভেতরে ঢুকে অঘটন ঘটায়। এর আগে গাছ চুরির ঘটনাও ঘটেছে নীলসাগরে। এছাড়া নিরাপত্তা রীদের জিম্মি করে অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটিয়ে থাকে দুর্বৃত্তরা।
নানা সমস্যার পরও নীলসাগর জেলার একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র। দর্শনার্থী বাড়লে এবং সরকার একটুখানি অন্তরিক হলে এখানকার সমস্যাগুলো সমাধান হবে অনেকাংশে। তাই, এখানে সবুজ গাছের ছায়ায় অবসর সময় কাটানো, পিকনিক, পার্টি দেওয়াসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন ঐতিহাসিক নীলসাগর।
একুশে সংবাদ ডটকম/আর/১৯-১২-০১৪:
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :