AB Bank
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

"নামকরণেই মেলে বাঙালির মেধার পরিচয়"


Ekushey Sangbad

০৪:৪৯ পিএম, জানুয়ারি ২৬, ২০১৫

একুশে সংবাদ : নাম দিয়ে কী হয়, নামের মাঝে পাবে তুমি আসল পরিচয়।’ এটি একটি জনপ্রিয় গানের প্রথম কলি। নামকরণ বা নাম রাখা নিয়ে এ দেশে বহু ঘটনা আছে। এ সব ঘটনা নিয়ে রটনাও আছে। তবে এ কথা ঠিক হাজার বছর ধরে বাঙালি এই কাজে বেশ পারঙ্গম। এর প্রমাণ সর্বত্র। যেমন নদ-নদীর নাম। গ্রাম-জনপদের নাম ইত্যাদি। নামকরণেই প্রমাণ পাওয়া যায় বাঙালি মেধাবী জাতি। কবে কে পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, মধুমতি, কর্ণফুলী, ইছামতি, করতোয়া, আত্রাই, কপোতাক্ষ, সুরমা, গোমতি, ডাহুক, তিস্তা, বুড়িগঙ্গা ইত্যাদি নদীর নাম রেখেছিল? বাংলাদেশের অসংখ্য নদীর সুন্দর নামকরণ কে করল? এমন প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খায় সেই ছোটবেলা থেকেই। আমি এই প্রশ্নের উত্তর কোথাও পাইনি। অনেক বইপত্র ঘেঁটেও না। বিল-ঝিলের নামও খুব সুন্দর। যেমন চলনবিল, বিল গন্ডহস্তী, শাপলা বিল, সোনাই বিল, কাঁকন বিল, ঝিনুক বিল, বিল গ্যারকা ইত্যাদি। এ দেশের ফুলের নামও সুন্দর। ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষার নামের সঙ্গে মিল নেই। ইংরেজিতে রোজ, বাংলায় গোলাপ। হাসনাহেনা, রজনীগন্ধা, জুঁই, চামেলি, চন্দ্রমল্লিকা, জবা, শেফালি, শিউলি, কাঞ্চন ইত্যাদি ফুলের নাম কে কবে রেখেছিল সেটাই ভাববার বিষয়। তখন কি বাঙালির বিদ্যা-শিক্ষা এখনকার মতো এতটা ছিল? ইতিহাস অনুসন্ধান করলে জানা যায়, ছিল না। তা হলে এটা বলা যায়, বাঙালি স্বশিক্ষিত জাতি। আমরা আমাদের সন্তানদের নাম রাখি ফুলের নামে। ক’দিন আগে লক্ষ্য করলাম পাবনা শহরের প্রধান সড়কে যন্ত্রচালিত ত্রিচক্রযান-এর চালকরা গলা ফাটিয়ে যাত্রী ডাকছেন ‘ঝুটপট্টি’, ‘চুলকানির হাট’, ‘ঠোঙা পাড়া’, ‘ব্যারাকপুর’ ইত্যাদি বলে। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্নের উদ্রেক হলো, পাবনা শহরের উপকণ্ঠে এসব নতুন জনপদের নামকরণ করল কে? সাধুপাড়া’ নামটাই বা কার রাখা? সেখানে কি কোনো সাধুর বাস ছিল? সাধুপাড়ার দক্ষিণে ঝুটপট্টি। সেখানে ঝুট বা ছাট কাপড় নিয়ে এসে কে একজন প্রথম ব্যবসা শুরু করেন। ক্রমশ সেখানে বেশ কিছু ব্যক্তি একই ব্যবসা করতে থাকে। ফাঁকা এলাকাটিতে ক্রমান্বয়ে জনবসতি গড়ে ওঠে। লোকমুখে এলাকার নাম প্রচার হয় ‘ঝুটপট্টি’ বলে। একইভাবে শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে পদ্মা নদীর দিকে অগ্রসর হলেই একটি ছোট বাজার। যেখানে হাট লাগে সপ্তাহে দুদিন। তার নাম ‘চুলকানির হাট’। নামকরণের বিষয়টি খোঁজ নিতে হাটের একটি চায়ের দোকানে বসলাম। দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে প্রথমে একটি চায়ের দোকান ছিল। সেখানেই নতুন ওই জনপদের লোকজন এসে বসে আড্ডা দিত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প-গুজবে তাদের সময় কাটতো। ওই দোকানে এক মুরব্বী বসতেন, তার নিন্মাঙ্গে চুলকানি হয়। চুলকাতে চুলকাতে বেচারা দিশেহারা হয়ে যেতেন। ক্রমশ বাজার থেকে চায়ের দোকানের পাশে হাট বসল। এলাকার এক ব্যক্তি ঠাট্টা করে বললেন, ‘চুলকানির হাট’। চায়ের দোকানে সেই ব্যক্তি এবং চুলকানি নিয়ে মুখরোচক আলোচনা হতো। এ ভাবেই ‘চুলকানির হাট’ নামকরণ হয়ে গেছে ওই জনপদের। ঠোঙাপাড়া’ নামকরণ হলো কীভাবে জানতে গেলাম সেখানে। ওখানকার এক ব্যক্তি ঠোঙা তৈরি করে শহরের দোকানে দোকানে সরবরাহ করতেন। ঠোঙার ব্যবসা করে তিনি বেশ অর্থ-কড়ি কামালেন। দেখা-দেখি অনেকেই ঠোঙা তৈরির ব্যবসায় মনোনিবেশ করল। তারাও বেশ সাফল্য পেল। এলাকায় ক্রমান্বয়ে বসতি গড়ে উঠল। শহরের কাছাকাছি দক্ষিণ-পশ্চিমের বিরাট এলাকাটি এখন ‘ঠোঙাপাড়া’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। টেবুনিয়া যাওয়ার পথে গাছপাড়া পাওয়ার আগেই ব্র্যাক অফিস। ব্র্যাক অফিস এলাকার নাম এখন বারাকপুর। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ব্যারাকপুর নামের জনপদটি ঐতিহাসিক। কারণ সেখানে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন বীর স্বদেশী বিপ্লবীকে সর্বপ্রথম ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল ব্রিটিশরা। যেখানে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল সেটি ছিল ব্রিটিশ সৈন্যদের ব্যারাক। পাবনা শহরের উপকণ্ঠের ব্র্যাক অফিস এলাকা এখন ব্যারাকপুর নামে পরিচিতি পেয়েছে। সেটি বোধ করি অটো রিক্সা চালকদের মুখে মুখে প্রচার হয়েই। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন নগরবাড়ি ঘাটে। সেখানে তিনি মাটি কাটার কাজ উদ্বোধন করেন। মাটি কাটার উদ্দেশ্য বাঁধ নির্মাণ। যাকে বলা হয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। অর্থাৎ যমুনা ও পদ্মা নদীর পানি বন্যার সময় পাবনা জেলাকে ডুবিয়ে দিতো, তা থেকে রক্ষা করা। বাঁধের তখন কেউই নাম রাখেনি। কিন্তু সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচার হয়ে গেল ‘মুজিব বাঁধ’। গ্রাম জনপদের নামকরণ বোধকরি এভাবেই হয়েছিল। ‘পাবনা’ নামটি কে কবে রেখেছিল? ‘ঢাকা’ নামটাই বা কে রাখল? ‘রাজা নেই, বাদশাহী নেই, তবু নাম ‘রাজশাহী’। মতিঝিলে মতিও নেই, ঝিলও নেই তবুও নাম মতিঝিল! নামের মাঝে কখনো কখনো পরিচয় মিললেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিচয় মেলে না। বাংলাদেশের বহু গ্রামের নামকরণ যে ব্যক্তি বিশেষের নামে হয়েছে তা সেই গ্রামের নাম শুনেই বোঝা যায়। যেমন হেমায়েতপুর (হেমায়েত নামের কোনো ব্যক্তির নামে)। এমন আরো উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন রামকান্তপুর, সুজানগর, কাশিনাথপুর, আলীপুর, মান্নান নগর ইত্যাদি। আবার উপাধি বা বংশের নাম অনুয়ায়ীও জনপদের নাম আছে। যেমন কাজীপুর, খাঁপুর, সৈয়দপুর, দত্ত নগর। একইভাবে পাড়া-মহল্লার নামও আছে। যেমন মন্ডলপাড়া, মোল্লা পাড়া, সরদার পাড়া, মজুমদার পাড়া, পাল পাড়া, দাস পাড়া, সেন পাড়া ইত্যাদি। এলাকা ভেদে নামের চমক বা প্রকারভেদ আছে। যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার গ্রাম জনপদের নামের মধ্যে আলাদা একটা মেজাজ আছে। পাহাড়ি ঝরনাকে কেন্দ্র করে নাম করা হয়েছে বা মুখে মুখে নামটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যেমন খাগড়াছড়ি, হিমছড়ি, বিল্যাইছড়ি, নাইখংছড়ি ইত্যাদি। আপনি যদি কক্সবাজারের টেকনাফ এলাকায় যান, দেখবেন সেখানকার গ্রামগুলোর নাম সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। যেমন দু পালং, যদু পালং, শাক পালং, রূপ পালং ইত্যাদি। এ দেশে অনেক জনপদের নামের শেষে ‘পুর’ শব্দটি রয়েছে। যেমন চাঁদপুর, মানপুর, যদুপুর, মধুপুর, রূপপুর ইত্যাদি। নদীমাতৃক বাংলাদেশে জনবসতি গড়ে ওঠে সেই প্রাচীনকাল থেকে। তাই নদী তীরের বাজার, শহর ‘গঞ্জ’ হিসেবে পরিচিত। যেমন সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ, আশুগঞ্জ ইত্যাদি। যেখানে জনবসতি গড়ে উঠেছে সেখানে গাছ থাকলে, সেই গাছের নামেই জনপদের বা গ্রামের নামকরণ হয়ে গেছে। যেমন বটতলির হাট, শিমূলতলা, তালতলী, আমতলী, ঝাউতলা, গাবতলী, কলাগাছি, মহুয়াপুর ইত্যাদি। আবার পশু-পাখীর নামেও এলাকার নাম রয়েছে। যেমন ঘোড়াচড়া, মহিষবাথান, হাতী বাগান, টিয়াপুর ইত্যাদি। ফুলের নামেও আছে জনপদ। যেমন পুষ্পপাড়া, ফুলপুর, গোলাপনগর, শাপলাপুর, পলাশপুর ইত্যাদি। বাংলাদেশের মানুষের রুচিবোধ যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়েও ভালো তার প্রমাণ রয়েছে সর্বত্র। নদী, বিল-ঝিল, জনপদ ইত্যাদির নামেই তার পরিচয় মেলে। বোধকরি এ কারণেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘এই দেশেরই আচার দেখে সভ্য হলো নিখিল ভুবন দিব্য পরিপাটি।’ আপনি কিছু কিছু জনপদের নাম শুনে অবাক হবেন। প্রাচীন ওইসব জনপদের নামকরণ কে করেছে তা নিয়েও আপনার ভাবনা হবে। যেমন একটি গ্রামের নাম আফরা। আফরা শব্দের অর্থ শুভ্র বা সাদা। আবার একটি গ্রামের নাম গাগড়াখালি। গাগড়া হচ্ছে মাটির কলস। একইভাবে সেঁজুতি। সেঁজুতি শব্দের অর্থ মাটির প্রদীপ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘নামে মানুষকে বড় করে না, মানুষই নামকে জাকাইয়া তোলে।’ আবার এ কথাটিও বহুল ব্যবহৃত, প্রচলিত ‘অনেক ধনসম্পদের চেয়ে একটা সুন্দর নাম ভালো’। একজন বড় দার্শনিক বলেছেন, ‘যে নাম শুধু বালু দিয়ে লেখা হয়, সে নামের স্থিতি নেই’। এসব নিয়ে যদি আমরা আলোচনা করি তাহলে তার প্রমাণ মিলবে সঙ্গে সঙ্গে। এর দৃষ্টান্ত আমাদের আশেপাশেই রয়েছে। ছেলেটির নাম চঞ্চল কিন্তু সে খুবই ধীর-স্থির। নাম শান্ত অথচ চলনে বলনে সে অশান্ত বা চঞ্চল। নাম লাজুক কিন্তু কাজে কর্মে বিশ্ববেহায়া। মেয়েটির নাম সুনয়না। প্রকৃত অর্থে সে ট্যারা। নাম বিউটি, বাস্তবে কুশ্রী। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন তো রয়েছেই। নাম নিয়ে বাংলা ভাষায় বহু গান রয়েছে। মান্না দে’র গাওয়া কালজয়ী গান, ‘কাগজে লিখো নাম সে নাম মুছে যাবে, পাথরে লিখো নাম সে নাম ক্ষয়ে যাবে, হৃদয়ে লিখো নাম সে নাম রয়ে যাবে।’ সত্যিই হৃদয়ে লেখা নাম কখনো মুছে যায় না। কত ব্যক্তিকেই আমরা মনে রাখি। আবার কত জনের নামই তো ভুলে যাই। ছোটবেলায় অর্থাৎ যখন প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র তখন দেখেছি গরুকে নাম ধরে ডাকতে। বাথানের রাখালরা গাভী দহনের সময় নাম ধরে ডাকলেই চলে আসতো। বাছুরও দৌড়ে চলে আসতো মায়ের কাছে। নাম রাখা হতো সিনেমা কিংবা নাটক-যাত্রা দলের নায়ক-নায়িকার নামে। যেমন বেহুলা, রূপবান, কবরী, সুচন্দা, শেফালি, শিউলী, তাজেল, রমা, দুলালী। এসব নাম রাখা হতো দুগ্ধবতী গাভীর। এ ছাড়াও এঁড়ে বাছুরের নাম রাখা হতো মন্টু, ঝন্টু, সাগর, বাটুল, টুটুল, কালা, শ্যামা, মণি ইত্যাদি। আমরা অবাক হতাম মাত্র দশ দিনের গরুর বাছুরকে নাম ধরে ডাকলেই খোয়ার থেকে বের হয়ে মায়ের কাছে চলে আসতে দেখে। কুকুর, ঘোড়া, বিড়াল প্রভুভক্ত হয়ে থাকে। আদর করে তাদের নামও রাখা হয়। নাম একটি বড় বিষয়। প্রতিটি মানুষ নিজের নাম পছন্দ করে। সে নাম যত খারাপই হোক না কেন। সে এই নাম নিয়ে গর্ব করে। এ কারণে মূর্খ ছেলের নামও রাখা হয় জজ মিয়া। শিশুর সুন্দর নাম রাখার মধ্য দিয়েও পিতা-মাতা এবং পরিবারের অন্যান্যদের রুচির পরিচয় মেলে। শিশুর সুন্দর নাম রাখার প্রতিযোগিতাও হয় কোনো কোনো এলাকায়। হাবিবুর রহমান স্বপন লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট একুশে সংবাদ ডটকম/আর/২৬-০১-০১৫:
Link copied!