ইতিহাসের দায়ে মিত্রশক্তি!
একুশে সংবাদ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির হাতে জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির পরাজয়ের পর হিটলারের দেশটিতে প্রবেশ করে মিত্রশক্তিভুক্ত দেশগুলোর সৈন্যরা। এ সময় তাদের হাতে লাখ লাখ জার্মান নারী ধর্ষণের শিকার হয়। জার্মান ইতিহাসবিদ মারিয়াম গেবহার্ডটের লেখা ‘হোয়েন দ্য সোলজার্স কেম’ নামক বইয়ে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বইটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তিভুক্ত দেশগুলোর সৈন্য ও তাদের সাহায্যকারীরা অনন্ত ৮ লাখ ৬০ হাজার নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করে। জার্মান পুরুষরাও ধর্ষণের হাত থেকে বাদ পড়েনি।
এতদিন ধারণা করা হতো, রেড আর্মি নামে পরিচিত সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যরা জার্মানিতে ব্যাপক নারী নির্যাতন চালিয়েছিল। তৎকালীন সোভিয়েত একনায়ক জোসেফ স্ট্যালিন ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে গণ্য করতেন। মারিয়াম গেবহার্ডট তার বইয়ে আরও উল্লেখ করেছেন, শুধু সোভিয়েত সৈন্যরাই নয়, ধর্ষণযজ্ঞে পিছিয়ে ছিল না ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরাও এবং সৈন্যদের যৌন লালসার শিকার হয়ে অনেক নারী আত্মহত্যা করেছে বলে তিনি দাবি করেছেন।
জার্মান ইতিহাসবিদ গেবহার্ডট বই লেখার আগে নির্যাতনের শিকার বেশ কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন এবং বই লেখার জন্য দেড় বছর ধরে গবেষণা চালিয়েছিলেন। নির্যাতিতদের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, শুধু সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলেই এ ধরনের ‘জঘন্য অপরাধ’ সংঘটিত হয়নি, ফ্রেঞ্চ, ব্রিটিশ ও আমেরিকান অঞ্চলেও একই ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ওই সময়ে একটি ‘জনপ্রিয়’ স্লোগান ছিল ‘জার্মান সেনাদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে আমেরিকানদের ছয় বছর লেগেছে, কিন্তু জার্মান নারীদের জয় করতে লাগে এক দিন ও এক টুকরা চকোলেট।’
তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ঘটনা নিয়ে মিথ্যা ধারণা প্রচলিত আছে যে, প্রয়োজনীয় কাপড়, খাবার, সিগারেট, কফির জন্য সৈন্যদের কাছে নিজেদের সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন জার্মান নারীরা। যাকে ধর্ষণ না বলে অনেকটা পতিতাবৃত্তির মতোই বলা যায়।
এটা একটা ভুল ধারণা। সৈন্যরা জোরপূর্বক নারী-শিশুদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করত। দক্ষিণ জার্মানিতে আমেরিকান সৈন্যরা টানা ৪৮ ঘণ্টা ধরে পালাক্রমে ধর্ষণ করত বলে গেবহার্ডট তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
প্রচলিত ধারণা, যুদ্ধে কোনো নৈতিকতা থাকে না। কোনো কোনো দার্শনিকের মতে, যুদ্ধে সবার আগে মৃত্যু ঘটে সত্যের। তবে যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় ঘটে মানবতার। তবে এর বিপরীত চিত্র যে একেবারে অনুপস্থিত তা বলা যাবে না। অনেক যুদ্ধে বিপর্য়স্ত মানবতাও প্রতিষ্ঠিত হয়। সে কারণে অনেক যুদ্ধই ইতিহাসে ন্যায়যুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তবে এটাও সত্য যে, ইতিহাস অধিকাংশ সময় বিজয়ীর পক্ষে কথা বলেছে।
জার্মান লেখক তার বইয়ে যে সত্য তুলে ধরতে চেয়েছেন তা সত্য হলেও ইতিহাস পাল্টে দিতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে তার এই লেখা অবশ্যই মানবতা প্রতিষ্ঠায় বিবেচনার দাবি রাখে।
প্রচলিত ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায় তাতে মিত্রশক্তি জার্মানি এবং তার মিত্রদের বিরুদ্ধে ন্যায়যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। মিত্রশক্তির পক্ষে ছিল গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রবক্তা ব্রিটিশ জাতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই বাহিনীর সৈন্যদের হাতে বিজীত জার্মানির লাখ লাখ নারী-শিশু ধর্ষণের ঘটনা তাই তাদের প্রচারিত আদর্শেরই বরখেলাফ।
যেহেতু একজন লেখক তার বইয়ে মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলেছেন সেহেতু তাদের দায়িত্ব এই অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ করা অথবা ধর্ষিত জার্মানসহ অক্ষশক্তির নিযার্তিতদের কাছে আনুষ্ঠনিকভাবে ক্ষমা চাওয়া। তা না হলে ইতিহাসের দায় থেকে সেদিনের বিজয়ীরা কখনো পার পাবে না।
একুশে সংবাদ ডটকম/আর/০৩-০৩-০১৫:
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :