বৈশাখে ওই শাখে || সাযযাদ কাদির
একুশে সংবাদ : বৈশাখ এলে মনে পড়ে আমার সাত-আট বছর বয়সের জীবনটাকে। ওই জীবনে আমাদের বাড়ির, গাঁয়ের বাড়ির আর মামার বাড়ির সবাই ছিলেন আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের আদেশ-উপদেশ মেনে চলার পাশাপাশি তাঁদের নজর এড়িয়েও চলেছি অনেক। সেই এড়িয়ে চলার জীবনটাতেই ছিল যত মজা। কিন্তু কেমন ছিল সেই গ্রীষ্মতপ্ত বৈশাখের দিনগুলি? সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২)-এর কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে দিই এর জবাব :
“বৈশাখে খরতাপে মূর্চ্ছাগত গ্রাম,
ফিরিছে মন্থর বায়ু পাতায় পাতায়;
মেতেছে আমের মাছি, পেকে ওঠে আম,
মেতেছে ছেলের দল পাড়ায় পাড়ায়।
সশব্দে বাঁশের নামে শির, -
শব্দ করি’ ওঠে পুনরায়;
শিশুদল আতঙ্কে অস্থির,
পথ ছাড়ি’ ছুটিয়া পালায়।
স্তব্ধ হয়ে সারা গ্রাম রহে ক্ষণকাল,
রৌদ্রের বিষম ঝাঁজে শুষ্ক ডোবা ফাটে;
বাগানে পশিছে গাভী, ঘুমায় রাখাল,
বটের শীতল ছায়ে বেলা তার কাটে।
পাতা উড়ে ঠেকে গিয়ে আলে,
কাক বসে দড়িতে কুয়ার;
তন্দ্রা ফেরে মহালে মহালে,
ঘরে ঘরে ভেজানো দুয়ার।” (‘গ্রীষ্ম-চিত্র’)
আমাদের বাড়ি টাঙ্গাইল শহরে, গাঁয়ের বাড়ি দেলদুয়ারে, মামার বাড়ি মিরের বেতকায়। শহর থেকে দক্ষিণ-পুবে দেলদুয়ার ১২ কিলোমিটার দূরে। মিরের বেতকাও দক্ষিণ-পুবে। তবে শহরের উপকণ্ঠে, দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার। তখনও যমুনা নদীকে শাসাতে বন্যারক্ষা বাঁধ হয়নি, আমরা ছ’মাস শুকনায় আর ছ’মাস ডুবে থাকতাম। দেলদুয়ার-মিরের বেতকা শুকনা কালে যেতাম টমটমে, আর বর্ষা কালে যেতাম নৌকায়। আমাদের ঘুম-ঘুম শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যেতো লৌহজঙ্গ নদী। বর্ষায় ফুলেফেঁপে উঠলেও বৈশাখে সত্যিই হাঁটুজল নিয়ে হয়ে পড়তো আঁকেবাঁকে বয়ে চলা ছোট নদী।
সেই সময়ে আমার জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমাদের বিন্দুবাসিনী স্কুল, আর আমাদের আকুরটাকুর পাড়া। বৈশাখ এলে আমরা স্কুলে পেতাম সামার ভ্যাকেশন অর্থাৎ গ্রীষ্মের ছুটি, আর পাড়ায় পেতাম একে-একে কয়েকটি মেলা। পাড়ার সবচেয়ে বড় মেলা ছিল, এখনও আছে, ‘মদনার মায়ের মেলা’ বা ‘মদনার মেলা’। সেই মদনা বা মদনার মা কে ছিলেন তা জানতে পারিনি অনেককে জিজ্ঞেস করেও, তবে ছোট কালীবাড়ি নামে পরিচিত পূজাবাড়ি ঘিরে ছিল যাবতীয় আয়োজন। পাড়ায় আমাদের বাড়ির লাগোয়া কোকিলার বাড়িকে ঘিরে ছিল ‘বুড়ির মেলা’। সে মেলা নেই এখন। কোকিলারাও নেই। পাশের পাড়া সাবালিয়ায় হরি পাগলার মেলা হয় এখনও। এই তিন মেলা নিয়ে ছিল আমাদের সারা বছরের নানা আগ্রহ-উদ্দীপনা। মদনার মায়ের মেলা হয় বৈশাখের প্রথম রবিবারে, হরি পাগলার মেলা পরের রবিবারে। বুড়ির মেলা হতো আরও পরে। তবে আমার মেলা উদযাপন শুরু হতো বৈশাখের আগেই, চৈত্রের শেষে। মামাবাড়ি মিরের বেতকার দক্ষিণে নদীপাড়ের গাঁ গাড়াইলে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা দিয়ে উদ্বোধন হতো আমার এবং আমাদের গোটা এলাকার গ্রীষ্ম-উৎসবের।
মেলায় কি-কি কিনতে হবে আর কি-কি খেতে হবে তার একটি ফর্দ ছিল আমার। ওই ফর্দের প্রথমেই ছিল ছুরি। কামারের কাছ থেকে কিনতাম ওই ছোট্ট ছুরি কাঁচা আম কেটে খাওয়ার জন্য। নুন-মরিচ মাখিয়ে সে কাঁচা আম খাওয়ার স্বাদই ছিল অন্য রকম। আহা! পাড়ায় কত আম গাছ তখন।ঝড়ের সময় কুড়াতাম সে সব গাছের আম। অনেক গাছে ঢিল ছুড়তাম, অনেক গাছে চড়ে বসতাম ভর দুপুরবেলা- বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে থাকতো তখন। কিচ্ছুটি টের পেতো না কেউ। যারা টের পেতো তাদের কেউ-কেউ ঝগড়ার মতো ভাব দেখিয়ে প্রশ্রয়ই দিতো! সেই চিনু, কণা, রেখা, সারা, চায়না, জাপু, দীপু... ওরা এখন কে যে কোথায়! সেই আমগাছগুলির দু’টি-একটি দাঁড়িয়ে আছে এখনও। তবে আমি মনে রেখেছি সব ক’টি গাছই। মনে রেখেছি সে সব গাছের আমের রঙ, স্বাদ, ঘ্রাণও।
ফর্দের দ্বিতীয় স্থানে পতং। মানে ঘুড়ি। ঠিকমতো ওড়াতে পারতাম না, কিন্তু আমার বেশ মাতামাতি ছিল ঘুড়ি নিয়ে। সুতায় মাঞ্জা দিয়ে কাট্টি-ও খেলেছি অনেক। তখন পাড়ায় খোলামেলা জায়গা ছিল কত! বিকালে ঘুড়ি বা চঙ ওড়াতে-ওড়াতে যেতাম খেলার মাঠে। সেখানে ঘুড়ি তার মতো উড়তে দিয়ে আমরা মেতে উঠতাম গোল্লাছুট, লবণদাঁড়ি, হাডুডু, জামবুরা বল খেলায়...!
এরপর ফর্দে নাম থাকত মারবেলের। তখন কি নেশাই যে ছিল এ খেলার! তাই কত রকমের রঙিন কাচের কত মারবেল যে কিনতাম! সানি মারবেলও কিনতাম বেশি দাম দিয়ে। খেলতে-খেলতে ক্ষত-বিক্ষত হতো অনেক মারবেল। সেগুলো ব্যবহার করতাম বাঁটুল বা গুলতির গুলি হিসেবে। ভাবতাম, বড় হয়ে যখন চাকরি করবো বাবার মতো, আয়-উপার্জন করবো, তখন কিনবো সব রকমের মারবেল।
বন্ধুদের নিয়ে মেলায় নানা রকম মিষ্টি খাওয়া ছিল আরেক মজার ব্যাপার। দু’রকমের মিষ্টি তখনও ছিল। গুড়ের মিষ্টি আর চিনির মিষ্টি। কোন-কোন মিষ্টি গুড়ের হলে বেশি মজা হয়, কোনগুলো আবার চিনি ছাড়া ভাবা যায় না- তা নিয়ে জব্বর তর্ক বাঁধতো আমাদের মধ্যে। তাহলেও মেলায় গিয়ে দু’রকমেরই জিলিপি, কদমা, বাতাসা খেতাম আমরা। হাওয়াই মিঠাইও ছিল আরেক আকর্ষণ। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখতাম হাওয়াই মিঠাই বানানো। তারপর এক আনায় তিনটি মিঠাই খাওয়ার মজা... সে কি ভোলা যায়! এছাড়া বোঁদে, শনপাপড়ি, নৈ টানা, বাদাম টানা, ঝাল চানাচুর এসব খাওয়ারও ছিল ধুম।
মেলা শেষ হয়ে যেতো সন্ধ্যার পর-পরই। তারপর বন্ধুরা সবাই মিলে সুযোগ খুঁজতাম ছবি দেখার। শহরে তখন একটাই প্রেক্ষাগৃহ- কালী সিনেমা। আসলে টিনের গুদামঘর একটা। ছবি চলে ভটভট ডায়নামো’য়। রিল ঘোরাতে হয় হাতে। ফ্যান নেই। গরমে পুরো ঘর পরিণত হয় এক চুল্লিতে। ছবি দেখার কোনও মজাই থাকে না তখন। থাকতে পারেই না। তারপরও সে মজা পেতে যারা ওই চুল্লিতে সেদ্ধ হন তারাই হন আসল মজার ব্যাপার। গরমে ভাজা-ভাজা, ঘামে জবজবা, প্রায় উদোম ওই দর্শকদের পাগলা-পাগলা চেহারা এখনও ভাসে চোখে।
চৈত-বৈশাখে তাই দর্শক জুটতো না কালী সিনেমার। তাঁরা কনসেশন রেটে ছবি দেখাতেন তখন। এক টিকেটে দুই ছবি, তিন ছবি, চার ছবিও দেখাতেন। সন্ধ্যার পর মেলার শেষে আমরা সব জুটতাম তাই কম পয়সায় বেশি ছবি দেখার আশায়। গরমে পুড়ে আর ঘামে ভিজে সেদ্ধ হতে-হতে প্রায় দিগম্বর হওয়ার উল্লাসে মেতে উঠতে। কিন্তু ছবি কি সহজে শুরু হয়? দর্শক জোটাবার আশায় ন’টা-সাড়ে ন’টা পর্যন্ত মাইকে ‘ফিট করা’ গানের কলে বাজতেই থাকে হেমন্ত, তালাত, শ্যামল, সতীনাথ, ধনঞ্জয়, মান্না, মানবেন্দ্র, শচীন, দ্বিজেন, তরুণ, সুবীর, লতা, সন্ধ্যা, গীতা, আশা, প্রতিমা, সবিতা প্রমুখের পাশাপাশি অধুনা প্রায় বিস্মৃত জগন্ময় মিত্র, পঙ্কজ মল্লিক, সত্য চৌধুরী, বেচু দত্ত, সুধীরলাল চক্রবর্তী, অখিলবন্ধু ঘোষ, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, মৃণাল চক্রবর্তী, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সনৎ সিংহ, দীপক মৈত্র, অরুণ দত্ত, অপরেশ লাহিড়ী, যূথিকা রায়, শিপ্রা বসু, গায়ত্রী বসু, উৎপলা সেন, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, বাণী ঘোষাল, ইলা বসু, নির্মলা মিশ্র, সুমন কল্যাণপুর, মাধুরী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের গান। ‘নেভার অন সানডে’ গানের সুরে অপরেশ লাহিড়ীর গাওয়া “বৈশাখে ওই শাখে ওই ডাকে কোন পাখি হায়... যৌবন মৌবনে মৌমাছি ডাক দিয়ে যায়...” গানটি খুব জনপ্রিয় ছিল তখন। (স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত করলাম, একটু ভুল থেকে গেল হয়তো।)
লাগাতার শেষ হয়ে ছবি শুরু হওয়ার পর গায়ক-গায়িকাদের পর কত অপরূপ হয়ে ওঠেন নায়ক-নায়িকারা। অসিতবরণ, বিকাশ, উত্তম, বসন্ত, সন্ধ্যারানী, সুচিত্রা, সাবিত্রী, সুপ্রিয়া প্রমুখের পাশাপাশি অধুনা বিস্মৃত নায়ক-নায়িকা রবীন মজুমদার (‘অরক্ষণীয়া, ১৯৪৮), রাধামোহন ভট্টাচার্য (‘ভুলি নাই’, ১৯৪৮), জহর গাঙ্গুলি (‘সঙ্কল্প’, ১৯৪৯), মলয়া সরকার (‘কঙ্কাল’, ১৯৫০), মঞ্জু দে (‘জিঘাংসা’, ১৯৫১), স্মৃতিরেখা বিশ্বাস (‘আবু হোসেন’, ১৯৫২), প্রণতি ঘোষ (‘পাত্রী চাই’, ১৯৫২), দেবযানী (‘সীতার পাতাল প্রবেশ’, ১৯৫৩), ধীরাজ ভট্টাচার্য (‘মরণের পরে’), নীতিশ মুখোপাধ্যায় (‘রাইকমল’, ১৯৫৫)...
এখন অত মধুর গান শুনি না, অত মুগ্ধকর অভিনয় দেখি না! তবে সেই খরতর বৈশাখ এখনও আছে - যেমন ছিল কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮২১-১৮৫৯)-এর কালে :
‘..প্রভাকর ভয়ঙ্কর খরতর তাপ্।
ছাতি ফাটে প্রাণ যায় বাপ্রে বাপ্ ॥...
পৃথিবীর কোন সুখ মনে নাহি ধরে।
নিষ্ঠুর নিদাঘে প্রাণ ছটফট করে ॥
অচল সবল যত বল বুদ্ধি হরে।
নিদ্রা নাহি করে বাস নয়নের ঘরে ॥
কেবল বাতাস খাই হাতে লয়ে পাখা।
পাখার বাতাসে প্রাণ নাহি যায় রাখা ॥
আপনি না থাকি আর আপনার বশে।
পৃথিবী ভিজিয়া যায় শরীরের রসে ॥
সংসার সংহার করে গুমটের দাপ্।
ছাতি ফাটে প্রাণ যায় বাপ্রে বাপ্ ॥... (‘গ্রীষ্মের অত্যাচার’)
একুশে সংবাদ ডটকম/আর/১৩-০৪-০১৫:
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :