AB Bank
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

`বাঙালি সংস্কৃতি এখন মিশ্র ও গতিশীলতার পথে এগোচ্ছে'


Ekushey Sangbad

১২:১৬ পিএম, এপ্রিল ১৩, ২০১৫
`বাঙালি সংস্কৃতি এখন মিশ্র ও গতিশীলতার পথে এগোচ্ছে'

একুশে সংবাদ : মুহম্মদ নূরুল হুদা। পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত একজন মানুষ। কাব্যবোদ্ধা অনেকের কাছে তিনি ‘বাঙালি জাতিসত্তার কবি’ হিসেবে পরিচিত। দরিয়ানগরের কবি হিসেবেও বেশ পরিচিতি তার। দরিয়াপাড়ের মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে শৈশবেই দারুণ সখ্য গড়ে উঠেছিল তার, যা পরবর্তীকালে ধরা দিয়েছে কবিতার নান্দনিক শব্দে। কবিতায় তিনি প্রকৃতিকে গ্রহণ করেছেন দেশীয় পটভূমিতে। এই পটভূমি খুবই প্রসারিত। ১৯৪৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দক্ষিণবঙ্গের কক্সবাজার জেলার পোকখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। শেকড়সন্ধানী এই কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৮ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পদক পান। ২০১৫ সালে তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক। তিনি বেশকিছু আন্তর্জাতিক সম্মানেও ভূষিত হয়েছেন। ছাত্রজীবনে ‘অধোরেখ’ সংকলনটি সম্পাদনা করে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বহু গ্রন্থ ও কাব্য রচয়িতা, বহু ভাষার ধ্রুপদী সাহিত্যের রূপান্তর সাধক এবং আপন ভাষা ও দেশমাতৃকার অসংকোচ সেবক। তিনি বাংলাদেশের লেখকদের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। গত ৬ এপ্রিল বিকেলে রাজধানীর কাঁটাবনে বসে এই সময়কে দেওয়া দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে কবি হয়ে ওঠা, বাঙালি সংস্কৃতির বিবর্তন, দেশের রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে বলেছেন আগে না বলা অনেক কথা। ওঠে এসেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ চিন্তাও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ আপনার জন্ম দরিয়ার পাড়ে। দরিয়ানগরের কবি বলেই নিজেকে পরিচয় দিতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। লেখালেখিতে আসার পেছনে কী ধরনের প্রেরণা কাজ করেছে? আমার জন্ম কক্সবাজারে। তখন চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল ছিল। মহকুমা ছিল। জেলা ছিল না। আমার শৈশবে আমি আমার এলাকায় কোনো প্রকাশিত লেখক দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। যারা বই লেখে বা প্রকাশ করে এ রকম কাউকে দেখিনি। দেখেছি লোককবিদের, যারা মুখেমুখে গান রচনা করে এবং গায়। সেই গান নিজে নিজেও গায়। কেউ কেউ ভিক্ষা করতে করতে সেই গান গাইছে। কিংবা কেউ মাঠে কাজ করার সময় সারি গান গাইছে। এমন একজন কবি আমার এলাকার বড়কেতা গায়েন। বড়কেতা মানে বড় কাঁথা। তার মনে কোনো ভাবের উদয় হলে তিনি একধরনের জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যেতেন। লোকে বলেন, তখন তিনি ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকতেন, গায়ে একটা গরম কাঁথা বা লেপ দিয়ে। তারপর ওই কাঁথার নিচে কাঁপতে কাঁপতে গান রচনা করতেন। অর্থাৎ শুরুর দিকে আমার কাছে লেখালেখি ছিল একটা ঐশ্বরিকতা। মনে করতাম এটা নাজিল হওয়া কোনো বিষয়। মনে হতো লেখকের ওপর বাইরের কোনো শক্তি এসে ভর করে। পরে কীভাবে বুঝলেন এটা আধ্যাত্মিক কোনো বিষয় নয়? আমাদের গ্রাম ছিল নদীর পাড়ে। পূর্ব পোকখালী গ্রাম। আমরা নদীর উত্তর পাশে। দক্ষিণ পাশে ফরাজিপাড়া। শীতকালে যখন ধান কাটা শুরু হতো বা শেষ হতো, তখন ঐ খালের এই পাড়ে দাঁড়িয়ে গান করা হতো। আমরা বলতাম ভাইট্টাল গান। নদীর পাড়ের লোকজন দুই ধারে দাঁড়িয়ে এক ধরনের গানে গানে তর্ক করে; এটাকেই ভাইট্টাল গান বলে। গানে গানে তর্ক দেখে মনে হলো এটা তো স্বাভাবিক বিষয়। কারো ওপর উড়ে এসে জুড়ে বসা নয়। এটা খুবই স্বাভাবিক। আমরাও তো তর্ক করি। এছাড়া কবিয়ালের গান হতো। কবিয়াল ফণী বড়–য়া, ইয়াকুব তখন বেশ নামকরা। তারা রমেশ শীলের শিষ্য ছিলেন। কিন্তু গান যখন গাইতেন সেই শিক্ষক আর শিষ্যে প্রভেদ থাকত না। দুজন মিলেই গাইতেন। ওইখানেও প্রথম প্রথম মনে হয়েছে গান রচনা কঠিন ব্যাপার। তারপর দেখছি তারা একজন আরেকজনকে আক্রমণ করে কথা বলছে। তখন মনে হলো, এই যে তাৎক্ষণিকভাবে লিখতে পারা, এটা ঐশ্বরিক ব্যাপার নয়। এটা তো মানুষের চেষ্টার ফল। কখন মনে হলো আপনিও পারবেন? মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্কুলে অ-আ-ক-খ পাঠ শেষ করে কবিতা পড়তে শুরু করলাম। একটা কবিতা ছিল ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।’ দেখি, আরে এ যে আমাদেরই ছোট নদী! বৈশাখ মাসে তো এখানে হাঁটুজল কেন, জলই থাকে না। ভাবলাম এটা নিয়ে লিখলেই কি কবিতা হয়ে যায়? যিনি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, তার দাড়ি আছে। চেহারাটা আমার দাদার মতো। তখন মনে হলো আসলে এটা একদম বাস্তব ঘটনা। তারপরের ঘটনা, আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আবুল কাশেম সাহেব। তিনি কুমিল্লা থেকে এসেছেন। আমাদের বাড়িতে জাইগির থাকতেন। একদিন দেখি তিনি তার খাতার পেছনে কী যেন লিখছেন। আমি চুপিসাড়ে দেখে ফেললাম। স্যার বললেন, ‘তুমি কী দেখছ?’ বললাম, ‘স্যার আপনি কী লেখেন?’ বললেন, ‘কবিতা লিখছি।’ ‘কবিতা, আপনি কি স্যার কবি?’ বললেন, ‘কবি কি না জানি না, তবে আমি কবিতা লেখি। শুনবে?’ তিনি আমাকে কবিতা শোনালেন। তখন চিন্তাগুলো সব মিলিয়ে নিলাম। বুঝতে পারলাম কবিতা লেখা খুব কঠিন কাজ নয়। চাইলেই সবাই লিখতে পারে। আসলে লেখালেখিটা এক ধরনের সৃষ্টিশীলতা, আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, এমনকি চাষাভুষাদের মধ্যেও চালু ছিল। এখনো আছে। এখনো অনেকের অবসর কাটে এসব করে। প্রথম লেখালেখি শুরু করলেন কীভাবে? আমার মনে হলো, স্যার যেহেতু কবিতা লেখেন আমিও তো কবিতা লিখতে পারি। সেটা স্যারের মতো না হলেও ছাত্রবৎ কবিতা লিখতে পারি। প্রথম লিখলাম ‘বাঘ আসছে, বাঘ আসছে’ ঘটনা নিয়ে ‘মিথ্যা কথা বলার ফল’ শীর্ষক আট লাইনের একটি রচনা, যা কবিতার মতো। স্যারকে দেখলাম, তিনি বললেন, ‘আমার চেয়ে ভালো লিখেছ।’ আমি লজ্জা পেলাম। স্যার বললেন, ‘তোমাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলেছি, তুমি লিখতে চাইলে লিখতে থাকো।’ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ঈদগাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে এলাম। এখানে এসে একটা ভালো সুযোগ পেয়েছিলাম। ওই সময় কোনো ছাপা বা মুদ্রিত পত্রপত্রিকা আমাদের আাওতার মধ্যে ছিল না। একটা দেয়াল পত্রিকা ছিল। সেটা কবে বের হয়েছে, তারপর বন্ধ হয়ে গেছে। আমি গিয়ে সেই দেয়াল পত্রিকায় লিখতে শুরু করলাম। এক পর্যায়ে দেয়াল পত্রিকার দায়িত্ব এলো আমার ওপর। বন্ধুরা মিলে সেখানে লিখতাম। লিখতে লিখতে একটা দল হলো। নাম দিলাম ‘ঊর্মিমালা সাহিত্য সংসদ’। ঈদগাহ উচ্চ বিদ্যালয়েই এটা হলো। এই সংসদের পক্ষ থেকে কক্সবাজারে প্রথম সাহিত্য পত্রিকা তথা লিটল ম্যাগাজিন বের করলাম। পত্রিকাটিতে সব লেখাই কক্সবাজারের লেখকদের। শুধু মুদ্রণ হয়েছে ঢাকা থেকে। নাম ছিল ‘কলতান’। ঊর্মিমালা সংসদের ‘কলতান’। এখানেও একটা ধারাবাহিকতা ছিল। আমি লিখলাম, আমাদের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অবলা কান্ত সেন গল্প লিখলেন। এভাবে দেখলাম, আমাদের কিছু নেই এটা তো ঠিক নয়, অনেক কিছু আছে। যিনি গান করেন, তিনি মাছও ধরেন। অর্থাৎ এসব মিলে একটা লৌকিক ঐতিহ্য ছিল। লৌকিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি যারা আধুনিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তারা আধুনিকতা না বুঝেও লোকসাহিত্যের চেয়ে একটু অন্য ধরনের অন্য পর্যায়ের সাহিত্য শুরু করলেন। যেটা না লোক সাহিত্য, না আধুনিক সাহিত্য। কক্সবাজার থেকে ঢাকা এলেন কবে? ১৯৬৫ সালে এসএসসি পাস করার পর একটা বিশেষ কারণে চট্টগ্রামে ভর্তি হতে পারলাম না। ভর্তি হলাম ঢাকা কলেজে। এখানে আমার ব্যাচেই ছিলেন কবি আলতাফ হোসেন। তার মাধ্যমেই স্বাক্ষর আন্দোলন, কণ্ঠস্বর আন্দোলন, সিকান্দার আবু জাফর, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় হয়। এটা একটা মহাব্যাপার। চট্টগ্রামে যদি থাকতাম তা হলে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতাম। কবি আহসান হাবীব তখন দৈনিক পাকিস্তানের সাহিত্য সম্পাদক। শহীদুল্লাহ কায়সার সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক। সিকান্্দার আবু জাফর সমকাল সম্পাদনা করছেন। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্বাক্ষর এবং কণ্ঠস্বর আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। এখানে এসে বুঝলাম এতদিন যা লিখেছি এগুলো আধুনিক সাহিত্য নয়। এটা বলা যেতে পারে পাঠ্যপুস্তকনির্ভর এক ধরনের সমিল সাহিত্য। বাংলার ক্লাসিক সাহিত্যের ধারণা আমার মধ্যে আছে। এটা হচ্ছে, কবিতার ক্ষেত্রে মিল থাকতে হবে। ছন্দ থাকতে হবে। এটা বুঝেছি। কিন্তু মিল এবং ছন্দ যে এক নয় এটা তখন বুঝিনি। নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনলেন কীভাবে? যখন আমি বুঝলাম কবিতা ছাপতে হবে, তখন সব পত্রিকা অফিসে গেলাম। সবাই দেখল, বলল যে এভাবে লিখলে হবে না। সমকালীন সাহিত্য পড়ো। শামসুর রাহমানের কবিতা পড়ো। তখন পর্যন্ত আমি শামসুর রাহমানের নাম জানি না, শুনিনি। জীবনানন্দ দাশ পড়ো। বললাম, আমি জীবনানন্দ দাশ পড়েছি। তারা বলল, ভালো করে পড়ো শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো। এগুলো নিবিষ্টভাবে পড়ার পর আমার মনে হলো এতদিন আমি যা লিখেছি সেগুলো কিছুই হয়নি। এরপর সুকান্ত ভট্টাচার্য ও কাজী নজরুল ইসলাম পাঠ করার পর বুঝলাম তিনজন তিন ধরনের লেখেন। যে ধরনের কবিতা নজরুল লেখেন জীবনানন্দ তা লেখেন না। আর সুকান্ত এদের দুজনের মাঝামাঝি একটা ধারার মধ্যে আছেন। বুঝলাম কবিতা স্বতঃস্ফূর্ত কাজ হলেও অসচেতন কোনো কাজ নয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহিত্য শুরু হয়। কিন্তু লালন করতে গেলে সচেতন পাঠ এবং চর্চার প্রয়োজন আছে। আহসান হাবীবের কাছে যখন কবিতা নিয়ে গেলাম তিনি বললেন, তোমার কবিতা বেশ ভালো, ছাপা যাবে। তুমি কি কবিতায় ছন্দটা ঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারো না? বললাম, কেন? এই যে চিলের সঙ্গে দিল আছে, মিল আছে। তিনি ছন্দের মধ্যে যে অঙ্কের হিসাব আছে তা বুঝিয়ে দিলেন। অক্ষরবৃত্ত কী, মাত্রাবৃত্ত কী। এক ঘণ্টা তিনি বিষয়গুলো বোঝালেন। আমার জন্য ওটা ছিল এক ঘণ্টার গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাস। সঙ্গে সঙ্গে আমি বিষয়গুলো প্রাথমিকভাবে বুঝেছি। কারণ, ছাত্র হিসেবে আমি খারাপ ছিলাম না। আবারও কি কবি আহসান হাবীবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল? ওই দিনের পর থেকে ছন্দের বই কিনে ছন্দ কী, তা রপ্ত করতে শুরু করলাম। এর পর দুবছর কবি আহসান হাবীবের কাছে যাইনি। এর মধ্যে ছন্দভিত্তিক কবিতা লিখেছি, বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। একদিন এক জায়গায় আহসান হাবীবের সঙ্গে আমার দেখা। তিনি বললেন, তোমার লেখা তো বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি বাবা, তুমি আমার কাছে আসো না কেন? বললাম, ভয়ে। ওই যে আপনি আমার ক্লাস নিয়েছিলেন। বললেন, তুমি এসো। গেলাম। কবিতা দিলাম। তিনি আমার দুই-তিনটি কবিতা একসঙ্গে ছেপে দিলেন। কথাটি বলছি এই কারণে, এই ধরনের অচেতনতা নিয়েই সাহিত্যে প্রবেশ করেছি। যখন সচেতন হয়েছি তখন বুঝতে পেরেছি যা কিছু লিখতে হবে, তাকে লালন করে লিখতে হবে। তার আগেপ্রচুর পাঠ করতে হবে। আমার আগে অনেক বড় বড় কবিরা কবিতা লিখেছেন। তারপর তো আমার কবিতা লেখার মানেই হয় না, যদি না আমি তাদের চেয়ে আলাদা কিছু লিখতে না পারি। বক্তব্যে বা শৈলীতে আলাদা কিছু একটা আনতে হবে। কবি হিসেবে নিজেকে মেলে ধরার গোড়ার দিকে কী ঘটেছিল? আমি যখন ঢাকা শহরে বসে সচেতনভাবে কবিতা লিখতে শুরু করেছি তখন বাংলাদেশে আরেকটি বিষয় চলছিল; আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার ভাঙা-গড়ার পালা। আমি তো ১৯৬৫ সালের পর ঢাকা এসেছি। তার আগে ১৯৪৭ সালে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, তবে পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে। অর্থাৎ পাকিস্তানের ভেতর বাংলাদেশ অংশটিও স্বাধীন সত্তা নিয়ে বসে আছে। অর্ধস্বাধীনও বলা যেতে পারে পাকিস্তানের একটা অংশ হিসেবে। ’৪৭ সালে জিন্নাহর কথা আমরা জানি। ভাষা নিয়ে চক্রান্ত শুরু করলেন। বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করলেন। তখনই তো বাঙালি পরিপূর্ণ জাতিসত্তা হিসেবে বিকাশের পথে পা বাড়াল। ১৯৫২ সালে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার প্রথম রক্তক্ষরণ হলো। আমার একটা কবিতা আছে-‘মায়ের ভাষার মান রাখতে জীবন দিল যারা/বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম শহীদ তারা।’ সালাম, বরকত, রফিককে আমরা ভাষা শহীদ বলি। আমি বলি, তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরও শহীদ। তাদের তো ভাষা শহীদ বলা হয়... তারা যদি মুক্তিযুদ্ধের গোড়াপত্তন না করতেন তাহলে কিছুই হতো না। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা ও সংস্কৃতির মাধ্যমেই বাঙালি একটা জাতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত ছিল। বাঙালি জাতীয়তা হাজার বছরের। কিন্তু পুনরায় এটা বিকশিত হয় ’৫২ সাল থেকে। বাংলাদেশ যখন এভাবে সংগ্রামশীল তখন পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশিকরা বাঙালিকে নানাভাবে দমিয়ে রাখার কৌশল নিয়েছে। আমরা কালো দশকের কথা জানি। কালো দশক যখন চলছে তখন সুদূর কক্সবাজারে বসে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছি ঈদগাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমি তখন ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে মিছিল করেছি ১৯৬৫ সালে। বুঝলাম আমাদের নিজেদের চিনতে হবে এবং আলাদা জাতিসত্তা হিসেবে বিকশিত হতে হবে। তারপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দিলেন। ওটা ছিল স্বাধীনতার রূপরেখা। তিনি এবং আমরা সবাই জানতাম এটা পশ্চিম পাকিস্তানিরা মানবে না। না মানলে যুদ্ধ হবে। আর একটা মানলে আবার দ্বিতীয় পর্যায়ে সংগ্রামে নামতে হতো। বাংলার প্রতিরক্ষা আর পররাষ্ট্রটা দফতরকেও দখল করার পর্যায়। আসলে ৬-দফা স্বাধীনতা সংগ্রামের এটা একটা কৌশলগত পর্যায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হয়েছিল... পশ্চিম পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়েছিল। এটাকে ষড়যন্ত্র মামলা বলি না, এটা আমাদের স্বাধীনতার মামলা। আমরা তো ষড়যন্ত্র করিনি, আমরা আমাদের স্বাধীনতার জন্যে রূপরেখা তৈরি করেছি। এটা ষড়যন্ত্র হবে কেন? তখন আমি টগবগে যুবক। পঁয়ষট্টির পর ঊনসত্তরের গণআন্দোলন যখন হলো তখন বুঝতে পারলাম বাঙালিকে আর ঠেকানো যাবে না। ষাট মানে বাংলা সাহিত্যের একটা অন্যরকম দশক। যে দশকে নন্দনতত্ত্ব, কাব্যিক আন্দোলন, কবিতার বিভিন্ন ধরনের নিরীক্ষা পশ্চিমবঙ্গেও হয়েছে, এখানেও হয়েছে। ১৯৬০ এমন একটি দশক যখন সারা পৃথিবীতে আধুনিকতাবাদ শেষ হয়ে গেছে। বিদায় ঘণ্টা বেজেছে। সারা পৃথিবীতে উত্তরাধুনিকতা শুরু হয়েছে। আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতা বিষয় বলতে কী বুঝাতে চাইছেন? এই দুটোর ভেতর স্পষ্ট ব্যাখ্যা আছে। আধুনিকতাবাদ যেখানে গ্র্যান্ড টেক্সট বা বড় বড় টেক্সটের কথা বলে,। উত্তরাধুনিকতাবাদ সেখানে ফ্র্যাগমেন্টেড বা টুকরো টুকরো টেক্সটের কথা বলে। এটা অন্য তর্ক। আমরা কি তখন উত্তরাধুনিকতার মধ্যে প্রবেশ করেছি? ওইভাবে প্রবেশ করিনি। উত্তরাধুনিকতা তখনো শুরু হয়নি। বরং আধুনিকতাই পরিপূর্ণভাবে বাংলা সাহিত্যে বা বাংলাদেশে রূপ পাচ্ছে। পঞ্চাশের দশকের লেখকরা ষাটের দশকের লেখকের মতো নয়, কারণ তারা তখন পর্যন্ত ৩০ এবং ৪০ দশকের ছত্রছায়ায় লালিত। ভালো কবি। বাংলাদেশ যে বিবর্তিত হচ্ছে, তার যে ভূখ-, জাতিসত্তা, বোধ বিবর্তিত হচ্ছে - এই বিষয়গুলো তারা খুব ভালোভাবে বলেছেন। হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ এবং সৈয়দ শামসুল হকের মধ্যে বিষয়গুলো খুব স্পষ্ট ছিল। ফলে জাতীয়তাবাদের চেতনা ও ভাষাভিত্তিক চেতনা তাদের কবিতায় নতুন স্বর দিয়েছিল। কিন্তু তারা প্রধানত সাহিত্যের টেকনিক বা কবিতার প্রকাশভঙ্গিতে ৩০ এবং ৪০-এর ভাষা বা ভঙ্গির অনুসারী ছিলেন। ষাটের দশকে এসে যে ‘না’ আন্দোলন, ‘স্বাক্ষর’ আন্দোলন শুরু হলো এসবই কলাকৌশলিক। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের কবিতা কলাকৈবল্যবাদী আন্দোলনে এক ধরনের নান্দনিক নিরীক্ষায় পর্যবসিত হয়ে যাবে। স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনের আঁচ সাহিত্যে কীভাবে লেগেছিল? তখন যেহেতু আমাদের স্বাধীনতা-স্বাধিকারের আন্দোলন শুরু হয়েছে, ফলে এইখানে জীবনের প্রয়োজনটা, বিবর্তনটা বিশেষভাবে ঢুকে গেল। কলাকৈবল্যবাদের আন্দোলনের সঙ্গে জীবনের আন্দোলনের যে সন্ধি, যুক্ততা বাংলাদেশের সাহিত্য, তার ফলে বিশেষ করে বাংলা কবিতা এক নতুন রূপ লাভ করল। ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে প্রথমার্ধের লেখকরা পরিবর্তিত হয়ে গেল। যেই রফিক আজাদ এক সময় লিখেছেন ‘বেশ্যার বেড়াল’ সেই তিনিই লিখেছেন ‘ভাত দে হারামজাদা’। ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ শীর্ষক পরাবাস্তব কবিতা লিখেছেন আব্দুল মান্নান সৈয়দ। সেই তিনিই আবার সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতা লিখলেন। আর ষাটের দ্বিতীয়ার্ধের অন্য কবিরা যেমন ধরা যাক নির্মলেন্দু গুণ, অঅভুল হাসান বা মহাদেব সাহা : আমরা বিষয়টিকে অন্যভাবে, একেবারে সামাজিক বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি তখন বুঝে গেছি, বাঙালি একটি জাতি হিসেবে বিকশিত হচ্ছে, এবং অবশ্যই যেকোনোভাবে, সেটা রক্তস্রোতের বিনিময়ে হলেও, পরিপূর্ণতা পাবে। সেই ঊনসত্তর সালে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমি লিখেছিলাম, জাতিসত্তাবিষয়ক আমার আদি কবিতা ‘শোভাযাত্রার দ্রাবিড়ার প্রতি’। যেখানে এই ভূখ-েই আরেকটি নতুন ভূখ-ের আবির্ভাবের কথা বলেছি; এবং নতুন মানুষ যারা আসবে তারা শ্রেণিহীন, সাম্যবাদী মানুষ এখানে থাকবে; ঞ্যাঁ, এমন একটা কথা আমি বলেছিলাম। ১৭টি খ- কবিতায় বিভক্ত একটি লম্বা কবিতা। ১৯৬৭-৯ সালে এর প্রথমাংশ লেখা হয়েছে। কবি হিসেবে কোন সৃষ্টি আপনাকে বেশি পরিচিতি দিয়েছে? ‘আমরা তামাটে জাতি’ নামক কবিতাটি আমাকে ‘জাতিসত্তার কবি’ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিতি দিয়েছে। সেটিও রচিত ঊনসত্তরের প্রেক্ষাপটে। তবে কবিতাটি আমি তাৎক্ষণিকভাবে লিখেই সঙ্গে সঙ্গে শেষ করি নি। াামি অনেক কবিতার ক্ষেত্রে এ-রকম করেছি বা এখনো করি। এটা না করার ক্ষেত্রে ¯েপন্ডারের একটি প্রবন্ধ আমাকে বিশেষভাবে আলোড়িত করেছিল, ‘দ্য ম্যাকিং অফ অ্যা পয়েম’। ¯েপন্ডার যখন কবিতার লেখার জন্য নিজের ভিতরে কোনো আলোকিত বোধ অনুভব করতেন তখন সঙ্গে সঙ্গে তা লিখে ফেলতেন। অনেক সময় তিনি পুরো কবিতা লিখতে পারতেন না। ওই সময় কেন্দ্রীয় যে চিত্রকল্প তা লিখে ফেলতেন। পরে লিখতেন, যখন পুরা ঘটনা বা বিষয়টি নতুনভাবে মনে পড়ত। এটা কাব্য রচনার একটি নতুন প্রক্রিয়া। অর্থাৎ আমরা যে রোমান্টিকতার কথা বলি, অনুপ্রাণিত মুহূর্তে কবিতা লিখতে পারি এটা যেমন সত্যি; তেমনি ক্লাসিক কালজয়ীরা বলেন, কবিতা লিখতে অনুপ্রেরণার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না, চিন্তা করলেই কবিতা লিখতে পারবে। অনুপ্রাণিত হয়ে চিন্তার স্তরে প্রবেশ করাটাই কবিতার জন্য মাহেন্দ্র মুহূর্ত। আপনার ভাষায় কবিতা কী? কবিতার অনেক সংজ্ঞা আছে। আমার কাছে, আলোকিতবোধের সচেতন সম্প্রসারণই কবিতা। আলোকিত বোধের সচেতন নির্মাণই কবিতা। একটা আলোকিতবোধ থেকে প্রথম পঙক্তিটা লিখলাম। শুরু করলাম। শেষটাও করতে হবে সচেতনতাবোধ নিয়েই। এই যে সচেতনতা, নির্মাণের তার কোনো ব্যত্যয় নেই। মনে হয়েছে বাঙালি একটা জাতিসত্তা, ডালপালা মেলছে চারার মতো, যখন তা পল্লবিত হবে সেদিন বাঙালি পরিপূর্ণ জাতি হিসেবে পরিণত হবে। এবং তাকে দাবিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময়, একাত্তরে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির সেই রূপ দেখেছি। এই রূপ দেখার জন্য আমাকে থাকতে হয়েছে সংগ্রামী বাঙালি-জনতার একজন হিসেবে। সংগ্রামী বাঙালি কবিদেরও একজন হয়ে। আপনার কবিতায় প্রকৃতি ওঠে এসেছে নান্দনিকতার হাত ধরে। এর পেছনের গল্পটা... প্রকৃতির যেসব জিনিস আমার বোধের মধ্যে ছিল সেগুলোই উঠে এসেছে কবিতায়। যেমন সমুদ্রের শোঁ শোঁ শব্দ শুনে প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে উঠতাম। কারণ, সমুদ্র আমার বাড়ি থেকে মাত্র এক থেকে দেড় মাইল দূরে। আবার পাহাড়। পাহাড় ছিল আমার বাড়ি থেকে দেড় মাইল দূরে পুবে; পশ্চিমে তরঙ্গ। অর্থাৎ পশ্চিমে সমুদ্র, পুবে লুসাই পাহাড়। পাহাড়ের ওপর বিচিত্র ধরনের গাছপালা। মাঝখানে যে সমতল ভূমি সেখানেই আমাদের বাস। বাংলাদেশের কোথাও কিন্তু এ রকমটি নেই। বরিশালের দিকে গেলে নদী পাব কিন্তু পাহাড় পাব না। সিলেট গেলে পাহাড় পাব সমুদ্র পাব না। কক্সবাজার, যাকে আমি দরিয়ানগর বলি, এটা এমন একটি জায়গা যেখানে বাংলাদেশের সবরকমের প্রাণী পাওয়া যাবে। যেমন, এখন সাফারি পার্ক হয়েছে। আগে পার্ক ছিল না। কিন্তু এই জীবজন্তু তো ছিল। বরং আগে আরও বেশি ছিল। ডুলাহাজারায় আমার নানা বাড়ি। শৈশবে ওই জঙ্গল দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়িতে আসা-যাওয়া করতাম। ফলে প্রকৃতি, পাখি এবং বিশেষ করে মাছের সঙ্গে আমার যোগসাজশ ছিল ভালোভাবেই। স্কুলজীবনের কোনো স্মৃতি কি মনে পড়ে? স্কুলজীবনে একটা বিশেষ প্রাণীর সঙ্গে আমার অদ্ভুত সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছিল। শামুক। যেটা বিলেঝিলে সবখানেই পাওয়া যায়। আমার বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার পথে একটা মাঠ ছিল, সেখানে একটা ডোবা ছিল। গ্রীষ্মকালে ওই ডোবায় অনেক শামুককে হেঁটে যেতে দেখতাম। এগুলো হেঁটে যাওয়ার সময় কাদার মধ্যে একটা পথরেখা তৈরি করত। দেখতে খুবই সুন্দর। আর ওই ছুটন্ত শামুককে একটু ধরলেই এটি থমকে দাঁড়াবে। আর হাঁটবে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকবে। বোঝা গেল, শামুক মানুষের উপস্থিতি টের পায়। যে তাকে আক্রমণ করছে না, তাকে নিয়ে সে চিন্তিত নয়। বরং যে তাকে ছুঁয়েছে সে থাকা পর্যন্ত শামুক দাঁড়িয়ে থাকবে, নড়বে না। মাটি কথা বলছে না। মাটিকে আমি আঘাত করছি না বলে সে কথা বলছে না। যদি তাকে আঘাত করি তাহলে সে তার প্রতিক্রিয়া দেখাবে। পরে স্কুলে আমি পড়েছি, গাছপালারও প্রাণ আছে। প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের বোঝাপড়ার শুরুটা কি এভাবেই? প্রকৃতির প্রাণ আছে, মানুষেরও প্রাণ আছে; তাহলে প্রাণের সঙ্গে প্রাণের যোগ তো হবেই। বহু পরে জেনেছি, পৃথিবীতে সর্বপ্রাণবাদ বলে একটা তত্ত্ব আছে। শুধু তত্ত্বই নয়, এটা আদিমানুষের ধর্মও। এজন্যই প্রকৃতির সঙ্গে প্রাণের এক ধরনের মিথস্ক্রিয়া তৈরি হয়েছে। আর একটা ঘটনা মনে পড়ে। যখন আমি বিকেলে খেলাধুলা করে বাড়ি ফিরতাম : অর্থাৎ সূর্যাস্তের সময়। পুবদিক থেকে পশ্চিমদিকে আসার সময় দেখা যেত, মহেশখালী পাহাড়, যেখানে আদিনাথ মন্দির। ওই মন্দিরে বড় বড় গাছ ছিল। ওই গাছের আড়ালে যখন সূর্য অস্ত যেত তখন সূর্যের লাল আলোকরশ্মি গাছের পাতার ভেতর দিয়ে দেখা যেত। মনে হতো পুরো গাছটি একটা আলোকবৃক্ষ। অনেকটা ক্রিসমাস ট্রির মতো। এই আলোকবৃক্ষ আমাকে নতুনভাবে একটা চিত্রসৌন্দর্য দিত। মনে হতো কারো আঁকা একটা ছবি। প্রকৃতিকে যদি আমি ভিন্নভাবে, ভিন্নরঙে, ভিন্ন আঙ্গিকে সাজাতে পারি তাহলে এটা ভিন্নরূপ ধারণ করতে পারে। প্রকৃতির শৈল্পিক হয়ে যাওয়ার এই ধারণাটিও তখন প্রকৃতির কাছ থেকে আঁচ করেছিলাম। মানুষের কাছ থেকেও অনেক কিছু পেয়েছি। আমাদের এলাকায় প্রচুর কৃষক এবং জেলে ছিল। জাল ধরা একটা বড় পেশা। আমি নিজেও জাল ধরতে বা মাছ মারতে পারি। আমার বাবার জাল ধরার দক্ষতা যেমন ছিল, মাছ ধরার দক্ষতা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। ওই সময় ওই এলাকায় মৎস্য ব্যবসা নতুনভাবে চালু হচ্ছিল। যে কারণে প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের যে বোঝাপড়া তা শুরু থেকেই হয়েছে। আপনারা যখন লেখালেখি শুরু করেন তখন বাঙালি সংস্কৃতির অবস্থা কেমন ছিল? বাঙালি সংস্কৃতি তখন প্রবল। বাঙালি সংস্কৃতি উৎসবমুখর হতো পয়লা বৈশাখে। আমরা তো এখন পয়লা বৈশাখ শহরজীবনে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি বলা যায়। ’৬৫-৬৬ সালে ঢাকা শহরে বৈশাখী মেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হয়। এটা করা হয়েছিল নগরে বৈশাখী উৎসবটাকে নিয়ে আসার জন্য। তবে গ্রামে এটি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। আমরা উন্মুখ হয়ে থাকতাম বিউ খেলার জন্য। পয়লা বৈশাখের আগে-পরে মেলায় গানবাজনা হতো। বিচিত্র ধরনের হস্তশিল্পের জিনিসপত্র আসত। সেই মেলায় আরেকটা জিনিস হতো, বলি খেলা। জব্বরের বলি খেলা বহু পরের ঘটনা। চট্টগ্রাম শহরের জব্বর বলি নামে একজন বলি চট্টগ্রামে শহরে এই খেলাটা শুরু করেন। তার আগে আমাদের কক্সবাজার এলাকাতে টেকনাফ, রেঙ্গুন থেকে বলিরা আসত। স্থানীয় বলিদের সঙ্গে তারা প্রতিযোগিতা করত। ঐতিহ্যটা সাংঘাতিক। এই ঐতিহ্যে আজকের বাঙালি সংস্কৃতির সব দিক ছিল। যেদিন বলি খেলা হতো সেদিন ঘুড়ি উড়ত। সকাল বেলা ষাঁড়ের লড়াই হতো, মোরগের লড়াই হতো। তীর-ধনুক দিয়ে শিকার করার প্রতিযোগিতা হতো। হা-ডু-ডু, ডাঙ্গুলির মতো লোকখেলা হতো। প্রকৃত লোকজ বাঙালি সংস্কৃতি ওই সময় আমার এলাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। সংস্কৃতি কি অপরিবর্তনীয় নাকি বহমান? সংস্কৃতি সবসময় পরিবর্তনীয় ও বহমান। সংস্কৃতি একটি মূল স্রোত। একেক এলাকার সংস্কৃতি বেরিয়ে আসে তার মানুষ এবং প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতির মধ্যে মাটি একটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার। আমাদের দেশে মানুষ, মাটি এবং জল। এই তিনটি জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। জল হলো নদী। নদী যেমন আঁকাবাঁকা হয়ে চলে, জলের রঙ পরিবর্তন করে তেমনি সংস্কৃতিও পরিবর্তন হয়। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি যদি দেখি, তার যদি উৎস বা বিবর্তন দেখি, তাহলে দেখা যাবে আদিতে যে সংস্কৃতি ছিল তার মৌলিক দিক এখনো আছে। কিন্তু সারা পৃথিবীতে যে সংস্কৃতিগুলো ছড়িয়ে আছে তার উপকরণগুলো এসে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে অভিনব বৈশ্বিক হয়ে উঠেছে। ফলে বাঙালি সংস্কৃতি এখন মিশ্র ও গতিশীলতার পথে এগোচ্ছে। তাহলে সংস্কৃতির বিবর্তন আছে? স্থবিরতা যেমন জীবন নয়, তেমনি বিবর্তনহীন সংস্কৃতিও সংস্কৃতি নয়। যেমন আমাদের যে জাতীয় সংগীত তার মূল সুর দিয়েছিলেন গগন হরকরা। ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যেরে।’ রবীন্দ্রনাথ জানতেন না এই সুরে লেখা তার একটি গান ভবিষ্যতে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে। তিনি লোককবি গগন হরকরার সুর নিয়ে লিখলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমার ভালোবাসি।’ দুই গানের সুরের কাঠামোটা এক। লেখার কাঠামোটাও এক। কবিতার কাঠামোও এক। রবীন্দ্রনাথ বলেই বাণীভঙ্গিতে এটাকে ভালো করে পাল্টে স্বীকরণ করতে পেরেছেন। আমাদেরকেও পাল্টাতে হলে সক্ষম হাতে কব্জির জোর রেখে পাল্টাতে হবে। তা না হলে বিকৃত হবে। না বুঝে এটা করা যাবে না। বাঙালি সংস্কৃতিকে এভাবে নবোদ্ভাবিত অগ্রযাত্রায় শামিল হতে হবে। এখন সংস্কৃতিতে কী ধরনের পরিবর্তন দেখছেন? এখনো বাংলাদেশ একটা বিশাল গ্রাম। বাংলাদেশ শহুরে সংস্কৃতিতে প্রবেশ করছে। তবে এখনো পুরোপুরি শহুরে সংস্কৃতিতে প্রবেশ করার অবস্থা আসেনি। কিন্তু যেভাবে বাংলাদেশ সম্প্রসারিত হচ্ছে, যোগাযোগ বেড়ে যাচ্ছে, ্সুদীর্ঘ বা উড়াল সেতুগুলো হচ্ছে তাতে আগামী একশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ পরিপূর্ণ একটি নাগরিক গ্রামে পরিণত হয়ে যেতে পারে। এখন আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি, পয়লা বৈশাখ যখন আসে তখন ঢাকা শহরে একটা বড় মিছিল হচ্ছে। মঙ্গলশোভা যাত্রা। এটাও বেশি সময় আগের নয়। ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে এটা হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে এই, বাঙালি তার মৌলিক লোকঐহিত্যকে হারাকে বসেছে। বাঙালি ঐতিহ্যের অনেক কিছু এখন নেই। সেগুলোকে ধরে রাখার জন্য পুনরায় আবিষ্কার করে নবায়ন করা জরুরি। আগে লোকমেলা লোকমানুষ করত। এখন নগরের মানুষ করে। রমনার বটমূলে যে বৈশাখী মেলা ও গানের আয়োজন করা হয়, তার আসল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের লোকজ ঐতিহ্য সবাইকে দেখিয়ে নতুনভাবে জানিয়ে দেয়া। এটা একধরনের নবায়িত সম্প্রসারন। বাঙালি যতদূর আছে ততদূর পর্যন্ত এই মেলার একটা ছোঁয়া আছে। আমাদের লোকগানগুলো এখন নতুন করে গাওয়া হচ্ছে... এটা ঠিক লালন সংগীত, বাউল সংগীত নতুন করে গাওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই সংগীতের অনেকগুলোকে আমরা নগরে এনে বিকৃতও করে ফেলেছি। লারেলাপ্পা গানে পরিণত করেছি। ব্যান্ড সংগীতের আদলে এগুলো নিয়ে আসায় একটা জিনিস ভালো হচ্ছে যে আধুনিক সংগীতের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া দিতে গিয়ে এটার যে একটা মৌলিক সত্তা ছিল সেটাকে অগ্রাহ্য করছি। লোকসৃষ্টির যে মৌলিক অবিভাজ্যতা ছিল সেটাকে নষ্ট করা হচ্ছে। সংস্কৃতির এই পরিবর্তনে ইতিবাচক দিক কী? লোকশিল্পকে আমরা এখন শুধু একটা খেলার পুতুল হিসেবে রাখিনি। এটাকে আমরা বাণিজ্যিক দ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করছি। আগে টেপা পুতুল, বাঁশি মেলা থেকে গ্রামের লোকজন কিনত। কাঁধে নেওয়ার থলে কিনত। এখন কিন্তু টেপা পুতুল সারা পৃথিবীতে চলে যাচ্ছে। বাংলার বাঁশি সারা পৃথিবীতে রপ্তানি হচ্ছে। ফলে সংস্কৃতির নান্দনিক ও সৃষ্টিশীল দিকের পাশাপাশি বাণিজ্যিক দিক যে আছে সেটিও নতুনভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। পোশাকেও ছোঁয়া লেগেছে। সেই ফতুয়া, পাঞ্জাবি বিচিত্রভাবে সামনে আসছে। ফলে সংস্কৃতির বিকাশ তো হচ্ছেই, পাশাপাশি অভিনবত্ব যোগ হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী অভিন্ন সংস্কৃতি চর্চার সমস্যা কোথায়? অভিন্ন সংস্কৃতিতে মানুষ কখনো যেতে পারে না। কোনো দুটি মানুষ এক নয়। তুমি, আমি যতকিছুই বলি না কেন আমাদের মধ্যে যে অভিন্নতা আছে সেটা স্পর্শযোগ্য নয়, অনুভব যোগ্য। বরং যেটা ভিন্নতা সেটাই স্পর্শযোগ্য। পৃথিবীতে যতদিন মানুষ থাকবে, প্রাণী থাকবে ততদিন প্রত্যেক মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকবে। ভৌগোলিকভাবেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আলাদা। সেখানকার মাটির বহুরূপতা, জীবনযাত্রায় মানুষের বোধও আলাদা। জাপানিরা যেভাবে জীবনযাপন করে সেভাবে বাঙালিরা পারবে না। তাদের খাবার, ভালোবাসা, বোধ তা কিন্তু বাঙালিদের চেয়ে আলাদা। এই ভিন্নতা থাকবেই। এটাকে স্বীকার করে নিয়ে অভিন্নতার কথা চিন্তা করতে হবে। যেটা সারা পৃথিবীর মানুষকে এক করে দেয়। যেমন Ñ মানবিক ঐক্য। কোনো মানুষ কোনো মানুষের চেয়ে বড় নয়। সবার ওপরে মানুষ সত্য। তবে ব্যক্তি কেবল মানুষ নয়, সামষ্টিক মানুষও বটে। রাজা কখনোই প্রজাদের চেয়ে বড় নয়। এজন্য বলে, আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজত্বে। ব্যক্তিকে স্বীকার করা বাঙালি সংস্কৃতির একটা মৌল উপাদান। প্রত্যেক মানুষকেই স্বীকার করে নেওয়ার একটা বৈশিষ্ট্য বাঙালি সংস্কৃতিতে রয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে যেমন ভিন্নতা আছে, বৈশ্বিক সংস্কৃতির মধ্যেও এক ধরনের ভিন্নতা থাকবে। সমস্ত ভিন্নতাকে অটুট রেখে, সবগুলোকে এক জায়গায় এনে বৈচিত্র্যময় বিশ্ব-সংস্কৃতির কথা বলতে পারি। এটার অর্থ একরৈখিক বা এক-বৈশ্বিক সংস্কৃতি নয়। এমনটা হলে বড় সংস্কৃতি ছোট সংস্কৃতিকে খেয়ে ফেলবে। যেমন, বড় শোলমাছ পুঁটি মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে। ধরা যাক হিন্দি সংস্কৃতিকে যদি বড় সংস্কৃতি বলা যায়, তাহলে তার প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতি তার পেটের ভেতর চলে যাবে। একইভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতিও সব সংস্কৃতিকে গ্রাস করতে পারে। তাহলে সংস্কৃতির মেলবন্ধনের সুযোগ কি মোটেও নেই? আমি বলবো, নিরপেক্ষভাবে প্রত্যেক সংস্কৃতিকে আলাদা আলাদা করে থাকার অধিকার দিয়ে সকলের মধ্যে একটা সম্মিলনের ব্যবস্থা করতে হবে। ধরা যাক আফ্রিকায় ইগবো উপজাতির অনেক উপজাতি আছে। তাদের কোনো কোনো সাংস্কৃতিক নিদর্শন বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। যেমন ওরা একটা বাঁশি ব্যবহার করে। যেটা গোল, একাধিক মুখও আছে। বাংলাদেশের মূরং উপজাতির একটা বাঁশি আছে তিং দেং ফ্লা বা ম্রো-বাঁশি নামে। এই বাঁশি এই মিলগুলোকে আমরা লক্ষ্য করব। কিন্তু অভিন্নতা বিষয়ে আমরা আমরা বলব, শত ফুল ফুটতে দাও। বাঙালি সংস্কৃতি বা বিশ্ব-সংস্কৃতি সম্পর্কেও আমার কথা এই একটাই। কিন্তু আমরা তো আন্তর্জাতিকভাবে একই গোষ্ঠীভুক্ত? আন্তর্জাতিক বিশ্ব বলা হয়, কারণ এখানে অনেক জাতি রয়েছে। যদি একটি জাতি থাকত তাহলে আন্তর্জাকিতাবাদ বলতাম কিভাবে? হয়তো বলা যেতো, বিশ্ব-জাতীয়তাবাদ। বিশ্ব-জাতীয়তাবাদের কথা মুখে বলতে পারব। কিন্তু এটা পৃথিবীতে কখনই সম্ভব নয়। যেটা হতে পারে, পৃথিবীর প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি আলাদা, আলাদাভাবে পরিস্ফুটিত হবে। বিশ্বায়ন মানে আরেকটি জাতিকে বা সংস্কৃতিকে গিলে ফেলা নয়, নষ্ট করা নয়। দেশি সংস্কৃতির মধ্যে আগ্রাসনের কথা বলা হয়... আগ্রাসন হচ্ছে যেটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। এটা ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিরা করেছে। পাকিস্তানিরা উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। পৃথিবীর খুব কম জানা-ভাষাই আছে, যে ভাষার শব্দ বাংলা ভাষায় নেই। যেই দেশের লোকজনই এই দেশে এসেছে সেই দেশের ভাষাও এসেছে। যেমন, কৌঁর। এটা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শব্দ। অর্থ গরুর মুখের ঠুলি। ফসলে যেন গরু মুখ দিতে না পারে সেজন্য পরানো হয়। কেন এটাকে কৌঁর বলা হয়, এটা খুঁজে বের করতে গিয়ে একটা সঠিক ধারণায় উপনীত হলাম। তা হচ্ছে, ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে : কভার। যা দিয়ে ঢেকে ফেলা বোঝায়। চট্টগ্রামের ভাষার একটা দিক আছে যেকোনো ভাষাকে ধরে ছোটো করে ফেলা হয়। সেভাবেই কভার থেকে কৌঁর হয়েছে (কভার=কওার=কওর=কৌঁর)। নাসিক্য ধ্বনি চট্টগ্রামে বহুল-প্রচলিত। যেমন, ‘আমি’কে চট্টগ্রামে বলা হয় ‘আঁই’। কোথায় থেকে ‘কন্ডে’ বা ‘কডে’। অর্থাৎ আমি বিদেশি শব্দকে আমার মতো করে বানিয়ে নিয়েছি। এটা হচ্ছে গ্রহণ। একটা হচ্ছে বন্ধুত্ব, অন্যটি আধিপত্য। সংস্কৃতি যখন আধিপত্য হয়ে দাঁড়ায় তখন এটা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। যখন বন্ধু হয়ে দাঁড়ায় তখন তা সাংস্কৃতিক সৌহার্দ্য। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের যারা লেখালেখি করছেন বা করতে চান তাদের নিয়ে কী ভাবেন? আমিও তো নতুন প্রজন্ম ছিলাম। ভালো ছাত্র ছিলাম। ভালো ছাত্র হয়ে আমি একজন লেখকের সঙ্গে দেখা করেছি। সে লেখক হয়ত অতদূর লেখাপড়া করেননি। কিন্তু শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল আমার চেয়ে অনেক বেশি। আমি তার কাছ থেকে ছন্দের পাঠ গ্রহণ করেছি। যেকোনো প্রজন্ম সম্পর্কে আমি একটা কথা বলব। লেখালেখির কাজে আসতে হলে পড়তে হবে। পড়, পড় এবং পড়। তোমার সমসাময়িক যারা লেখেন তাদের লেখা পড়তে হবে। তার আগে অন্তত গত একশ বছরের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো জানতে হবে। তুমি যদি আধুনিক কবিতা লিখতে চাও তবে ঈশ্বরগুপ্ত থেকে শুরু কর। ঈশ্বরগুপ্ত থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান পর্যন্ত যারা কবিতা লিখেছেন এরা কোন জাতের কবি। তা না জেনে, না শুনে কিছু হয় না। কবিতার ছন্দ, কবিতায় ছন্দ নিয়ে.... ছন্দ সম্পর্কে একটা কথা বলতে চাই। এখন গদ্য কবিতা লেখার একটা হিড়িক পড়েছে। এটা আসলে নব্বই দশক থেকে শুরু হয়েছে। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। গদ্যে যে কেউ কবিতা লিখতে পারে। গদ্যে কবিতা লিখতে পারাটা শক্তিমত্তার পরিচয়। কিন্তু সেই শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে হলে আগে যে পদ্যে কবিতা লেখার একটা চল ছিল সেই জিনিসটা রপ্ত করতে হবে। ছন্দ ভাঙতে পারি কিন্তু না জেনে তো ভাঙতে পারি না। তুমি যেমন আমার সম্পর্কে না জানলে প্রশ্ন করতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথ ছন্দের ব্যবহার করেছেন, জীবনানন্দ দাশ ছন্দের ব্যবহার করেছেন। বাংলা কবিতার অধিকাংশই কবিতায় শ্রেষ্ঠ ছন্দের ব্যবহার হয়েছে। গদ্যে যখন কেউ কবিতা লেখে সেই গদ্যেও একরকম ছন্দ তৈরি হয়। এসবকে আমরা মিলহীন প্রবহমান গদ্যছন্দ বলতে পারি। আমরা যারা টানা গদ্যে কবিতা লিখি, একটার পর একটা পঙক্তি সাজাই, সে পঙক্তিগুলোকে পাশাপাশি সাজিয়ে দিলেই তো পদ্য কবিতা হয়ে যায়। আমি নিজেই এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটিয়েছি। বিশেষ করে শৈলীগত বা আকৃতিগত পরিবর্তন আনতে হলে আগে পুরনো আকৃতি সম্পর্কে জানতে হবে। তাহলে ছন্দের বাইরে গিয়ে কবিতা লেখা কঠিন বলছেন? আপাতত আমার মনে হচ্ছে, ছন্দ না জেনে কেউ কবিতা লিখতে পারবে না। ছন্দের বাইরে গিয়ে টিকে আছে এমন একটি কবিতার কথাও আমার মনে নেই। থাকলেও তার সংখ্য খুব কম। শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি মাইকেলের কোনো কবিতা কি ছন্দহীন? নেই। অমিত্রাক্ষর আছে, এটাও তো ছন্দ। না রবীন্দ্রনাথ, না নজরুল কারো পক্ষেই এটা সম্ভব হয়নি। ঠিক একইভাবে বলব রবীন্দ্রনাথের কোনো কবিতাই ছন্দের বাইরে নেই। নজরুলের তো কোনো কথাই নেই। তিনি তো ছন্দ ছাড়া কোনো কবিতাই লেখেননি। বরং নজরুল ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ লিখছেন অথবা ‘আর যদি বাঁশি না বাজে।’ এসব গদ্যের মধ্যে অনেক কবিতা পাওয়া যায়। এগুলো আসলে কবিতার মতো। ঠিক এমনিভাবে ত্রিশের দশকের যে কবিতাটি আমরা সবাই পড়ি ‘বনলতা সেন’। ছন্দ জানলে তা থেকে ভালো কবিতা লেখা যায়। আমরা যদি শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদের কবিতায় আসি। তারপর শক্তি চট্টোপাধ্যায়। শক্তির প্রায় প্রতিটি কবিতা ছন্দবদ্ধ কবিতা। আমি যদি বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’র কথা বলি, তার পুরোটাই ছন্দের ভেতর। তার অন্যগুলোর কথা বলতে চাই না। কারণ, তার এটাই গ্রন্থটাকেই আমার কাছে আজো শ্রেষ্ঠ মনে হয়। কবিতা নিয়ে যারা নিরীক্ষা করতে চান তাদের জন্য কী বলবেন? কবিতার স্তরে এসে যারা নিরীক্ষা করবেন তাদেরকে বলি ভালো কবিতা রপ্ত করুন, রপ্ত করলেই তাকে ভাঙতে পারবেন। আমি একবার ১৯৬৯ সালে মস্কোতে গিয়েছিলাম। সেখানে হোটেল পিকিংয়ে একটা সংরক্ষিত কক্ষ আছে, তার পাশেই আমাকে একটা কক্ষ দেওয়া হল। একজন এসে বলল, পাশে এমন একটি কক্ষ আছে যেটা একজন কবির জন্য বরাদ্দ। তিনি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তাকে সাংঘাতিকভাবে তারা শ্রদ্ধা করত। তাকে পুরস্কারও দেওয়া হয়েছিল। জানতে চাইলাম ওখানে কী আছে? তিনি বললেন, ওখানে অসংখ্য ঘড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ওনার (সুভাষ মুখোপাধ্যায়) একটা বাতিক ছিল ঘড়ি খুলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। অর্থাৎ তিনি নতুন ঘড়ি আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন। নতুন ঘড়ি আবিষ্কার করতে হলে তার কাছে যেসব ঘড়ি আছে তা খুলে ভেতরে কী আছে তা রপ্ত করতে হবে। নতুন ছন্দের কবিতা যদি বানাতে চাই তাহলে ছন্দের ভেতরে কী আছে তা আগে জানতে হবে, ঠিক ঘড়ির মতো। ফলে আমি মনে করি অতীতের শ্রেষ্ঠ নিরীক্ষাগুলো পাঠ করাটা অতীব জরুরি। এটাই আসলে ডি-কনস্ট্রাকশন। যারা সমাজে উগ্রবাদী ও ধর্মান্ধ বলে পরিচিত তারাও তো পড়াশোনা করে। তাহলে আপনি কোন ধরনের পাঠের কথা বলছেন? আমি তো আগেই বলেছি, মুক্তভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা যার আছে তিনি মানুষ। আগের যেকোনো বিশ্বাসের সঙ্গে আমি পরিচিত হতে পারি। বিশ্বাস তো পৃথিবীতে এক ধরনের নয়, বহু ধরনের। আমি ধর্ম না বলে বলছি বিশ্বাস। মানুষের বিশ্বাসের তিনটি স্তর আছে। একটা হলো পূর্ব-বিশ্বাস, যা কার পূর্ব-জ্ঞান বা প্রায়র নলেজ থেকে জাত। আরেকটা হলো প্রাকৃকিতকভাবে যে জ্ঞানটা মানুষের ভেতরে থেকেই যায়। ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘সেলফ নলেজ’ বা ‘ইনটিউশন’। তারপর আসে ‘উইজডম’।এর মাধ্যমে আসে নতুন জ্ঞান, যেটা আমরা আবিষ্কার করব। একটা উদাহরণ দেই, আমি যদি বিশ্বাস করি বাষ্প ইঞ্জিন শ্রেষ্ঠ, তাহলে দপ দপ করতে করতে এখনো রেলগাড়ি চলত। এ আইডিয়াটাকে গ্রহণ করার পর আমাকে চিন্তা করতে হয়েছে এর পাশে নতুন আর কী করা যায়। জ্ঞান কিন্তু এভাবে এগিয়ে যায়। চিন্তা করার সময় যে মেধাটা সে প্রয়োগ করেছে এটা তার নিজের ক্ষমতা। চর্চালব্ধ। মানুষের ওই ক্ষমতা প্রকাশ করার পরে বাষ্প ইঞ্জিন আর বাষ্প ইঞ্জিন নেই। এখন স্মুথলি এক ইঞ্জিন হয়ে গেছে। যে ইঞ্জিন দিয়ে মানুষ গ্রহ, উপগ্রহ পার হয়ে আরো এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সৌর জগৎ পার হতে চাইছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মুক্তচিন্তা বিকাশের জন্য কতটুকু সহায়ক বলে মনে করেন? দেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার কারণেই মূল সমস্যা হচ্ছে। আমরা অন্ধত্ববাদিতার পাশাপাশি মুক্তচিন্তার শিক্ষা চালাই। একই সঙ্গে চালানোর ফলে এক ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আমি বলব ধর্মভিত্তিক, ঈশ্বরভিত্তিক, স্বর্গীয় বিশ্বাসভিত্তিক যে চিন্তা, সেগুলোও বদ্ধ চিন্তায় নেই। ¯্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে যদি আমরা বলি তা তো সর্বপ্রাণবাদের মতোই। আল্লাহ তো সর্বত্রই বিরাজমান। মসজিদে আছে, মন্দিরে কি নেই? গির্জায়ও আছে। অন্ধত্বকে বাদ দিয়ে সীমানার বাইরে যে অন্য কিছু থাকতে পারে এই বিশ্বাসটা সচেতন মানুষের থাকবেই। অচেতন মানুষের থাকবে না। অচেতন মানুষ জড়পদার্থ। ধর্মীয় বিশ্বাসের জেরে মানুষ হত্যা হচ্ছে... আমরা দেখেছি সর্বশেষ হত্যা করা হয়েছে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে। তাকে যারা হত্যা কে ছে, তাদের ভাষ্য মতে, তারা তো জানতই না ওয়াশিক কী করেছে। তারা মানুষ নাকি? তাদেরকে বলা যায় যন্ত্র; যেটাকে মানুষ মারার জন্য তৈরি করা হয়েছে। তাদের ভেতরের মানবিকতাবোধ নষ্ট করা হয়েছে। ইসলাম কিন্তু এটা বলে না। ইসলাম প্রতিটি মানুষকে এককভাবে বিকশিত হওয়ার কথা বলে। ইসলাম প্রতিটি পাশের মানুষকে সম্মান করার কথা বলে, শ্রদ্ধা করার কথা বলে। ইসলাম বলে প্রতিবেশীকে না খাইয়ে তুমি খেতে পারবে না। ইসলাম আরো বলে তোমার জন্য তোমার ধর্ম, আমার জন্য আমার ধর্ম। আর আল্লাহতায়ালা বা ¯্রষ্টা বা ঈশ্বর এত ঠুকনো জিনিস নয় যে, কেউ তাকে অস্বীকার করলো, আর সে নাই হয়ে গেল। তা হতে পারে না। যদি বিশ্বাস করি আমরা সবাই আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি, তাহলে তো বলবো, সৃষ্টি কি করে আল্লাহতায়ালাকে ধ্বংস করবে? এটা করার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। স্রষ্টার সৃষ্টি ¯্রষ্টাকে ধ্বংস করতে পারে না। ¯্রষ্টা নিজেকেই নিজেকে রক্ষা করার জন্যে যথেষ্ট। আর হত্যা করে পৃথিবীর কোনো মতবাদ বা বিশ্বাসকেও লুপ্ত করা যায়নি। মুসলমানরা ইহুদিদেরকে পারেনি। ইহুদিরা মুসলমানদের পারেনি। যুক্তি এমন একটা বিষয় একজনেরটা লোপ পেলে সেটা আরেকজনের ভেতর আশ্রয় নেয়। সেখানে আরেকটা যুক্তি তৈরি হয়। ফলে হত্যা করে অন্যকে যুক্তিকে বিলুপ্ত করার চেষ্টা অঅসলে একটা অন্ধত্ব। এটা চিরপরাজিতের একটা ভ্রান্ত বুদ্ধি। এটা দিয়ে সমাজকে বদলানো যাবে না। বরং শেষ পর্যন্ত নিজেরাই নিশ্চিহ্ন হতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের ভিড়ে ছাপা বইয়ের চাহিদা কমে আসবে বলে মনে করেন? না, মোটেও না। এটা বাড়বে। অন্যভাবে বলা যায় ছাপা বইয়ের গুরুত্ব কখনো কমবে না এ জন্য যে, ছাপা বই হলো একটা রান্না করার বিষয়ের মতো। যেটা আমি বহুভাবে তৈরি করতে পারি। যারা অগ্রভাগে যুদ্ধ করে তাদেরকে নাকি ট্যাবলেট বানিয়ে দেওয়া হয়। তাদের খাদ্য লাগে না, তারা একটি ট্যাবলেট খেয়ে তিনদিন না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারে। এটা বিশেষ মুহূর্তে শক্তি সঞ্চয় করার জন্য একটা জিনিস, খাবার নয়। বইয়ের কথা বলছি এ জন্য, বই এমন একটা জিনিস যাতে মানুষ একটা মূর্ত বস্তু। মানুষ যদি কোনোদিন বিমূর্ত হয়ে যায় সেদিন কিন্তু মানুষ পড়তে পারবে না। পড়ার কোনো অবকাশই থাকে না। মানুষ বিমূর্ত হয়ে যাওয়া মানে দেহত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়া। কোথায় চলে যায় আমরা সেটা জানি না। স্পষ্টভাবেই বলতে পারি, যে জানে সে জানে। আমি বলব আমরা জানি না। যতক্ষণ পর্যন্ত মূর্তদেহধারী মানুষ আছে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে খাবার গ্রহণ করে শরীরটাকে পুষ্ট রাখে ততক্ষণ পর্যন্ত সে মূর্ত আশ্রয়ের পাঠ গ্রহণ করবে। আমি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাব সাত ঘণ্টা ট্রেন জার্নি করে। আমার পক্ষে সব সময় ফেসবুক দেখে সময় কাটানো সম্ভব নাও হতে পারে। বরং আমি যদি একটি বই সঙ্গে রাখি এবং বইয়ের ভেতর একটি গল্প পড়ি, পাশাপাশি সেই গল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই, তাতে সময় ভালো কাটবে। পুরুষের সঙ্গে যেমন নারী, নারীর সঙ্গে যেমন পুরুষ : মানুষের সঙ্গে তেমন বই। চিরকালের জন্য হাতে রাখার একটা বই সেটা যেভাবেই থাকুক। ছাপা বইয়ের সুবিধা আছে, বিভিন্ন আকৃতিতে আমি সেটা বহন করতে পারি। এজন্য আমার ধারণা বই কখনো বিলুপ্ত হবে না। বরং আগে যেমন বই হারিয়ে যেত এখন আর তা হবে না। তখন শুধু ধারণ করতাম মস্তিষ্কে। এখন আমরা কম্পিউটারেও ধারণ করতে পারি। ডিজিটাল ইনফরমেশন স্টোরেও রাখতে পারি। সেটাও মানুষের মস্তিষ্কের মতোই সামষ্টিক একটা মস্তিষ্ক। যেকোনো মুহূর্তে আমি আবার সেটাকে বই হিসেবে বা সিনেমা হিসেবে পড়তে পারি। তাই মানুষ যতদিন মূর্ত সত্তা হিসেবে থাকবে বইও ততদিন মূর্ত সত্তা হয়ে টিকবে। এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ। তথ্যপ্রযুক্তি যুগে কবি, লেখকদের অনেকে ফেসবুকে বেশ অভ্যস্ত, আপনি কি... আমিও ফেসবুকে আছি। কিন্তু সব সময় থাকি না। আপনি কি মনে করেন এটা সময় অপচয়ের জন্য দায়ী? অবশ্যই অপচয়। এজন্য বলব যে, আমি যদি ফেসবুকে সারাক্ষণ থাকি তাহলে অন্য কাজ করার কোনো সময়ই থাকবে না। ফেসবুক হলো মানুষের অবসর কাটানোর একটা মাধ্যম। চিঠি বা ডায়েরি লেখা তো এখন হয়ই না। বরং ওই জিনিসটাকে ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখা হচ্ছে। সুতরাং ফেসবুক নিত্যসঙ্গী হতে পারে, কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বলে মনে করি না। ফেসবুককে আমি মনে করি অবসরের সঙ্গী হিসেবে। ফেসবুক অযৌক্তিক ধারণারও জন্ম দেয়। যেমন- কয়েকদিন আগে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ খেলা নিয়ে ফেসবুকে যত তর্কাতর্কি হয়েছে সবটাই কিন্তু অমূলক। এতে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি, কেউ কেউ দুই দেশের সম্পর্ককে একেবারে পরিকল্পিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ঠিক একইভাবে দুই ব্যক্তির মাঝে সম্পর্ক নষ্টের জন্য এটা একটা হাতিয়ার হয়ে ওঠেছে। এমন সব অপ্রয়োজনীয় চিত্র এখানে দেওয়া হয় যার কোনো মানে হয় না। আপনি কি বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতি নিয়ে কিছু বলতে চান? না বলে তো উপায় নেই। না বললে আমি বাংলাদেশে আছি কেন? কী বলতে চান? ফেসবুকে যেমন কা- হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তেমনি অযৌক্তিক কা--কারখানা হয়। রাজনীতি তো মানুষের জন্য। কিন্তু এখানে রাজনীতি মাত্র কয়েকজন সামান্য ব্যক্তির জন্য হয়ে উঠছে। কয়েকটা গোষ্ঠীর জন্য হয়ে গেছে। কয়েকটা দলের জন্য হয়ে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা প্রবণতা এসেছে ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতা না-ছাড়া। আর ক্ষমতায় না গেলে যাওয়ার জন্য নিজের ছেলেমেয়ে মারা গেলেও পরোয়ানা না করা। মনে রাখা দরকার চিরকাল কেউ বাঁচবে না। না বাঁচলে ক্ষমতাও মূল্যহীন। কাজেই একটা ঐতিহ্য সৃষ্টি করা দরকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে, বিশেষ সময় পর্যন্ত বিশেষ ব্যক্তি বিশেষ পদে থাকবেন। তাহলে বোধহয় সমস্যা কিছুটা কমবে। আপনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কী ভবিষ্যৎ দেখেন? বাঙালি জাতির যে নতুন বিবর্তন হয়েছে তাতে এই জাতি বহুদূর যাবে। সারা পৃথিবীতে বাঙালি ছড়িয়ে পড়ছে এবং পড়বে। বাঙালি জাতি শুরুতে একটা বৈশ্বিক জাতি হিসেবে ছিল। বাঙালি জাতিকে কিছুতেই আমি খারাপ বলব না। বাংলাদেশের বয়স ৪৪ বছর। এখনো বাঙালি জাতির বিরোধিতাকারীরা বেঁচে আছে। তারা যেদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তখন বাংলাদেশের বিরোধিতা করার কেউ থাকবে না। এখন আমরা কাউকে রক্ষা করার জন্য বহুদলীয় জিকির তুলি, তখন আর জিকির তোলার কেউ থাকবে না। একটা সময় আসবে বঙ্গবন্ধু যে বাঙালিকে নতুনভাবে জাগ্রত করেছেন এ বিষয় নিয়ে দ্বিমত পোষণ করার লোক থাকবে না। বাঙালি জাতিকে যদি এগিয়ে যেতে হয় তাহলে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চেতনাকেই কাজে লাগাতে হবে। আমার ধারণা, অনেক টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে, অনেক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অনেকভাবে নবজন্ম পাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলার কোনো নদী মরে যায়নি। বাংলার কোনো পাখি মরে যায়নি। বাংলার কোনো মানুষ শেষ হয় যায়নি। বরং বাড়ছে। সত্যিকারের বাঙালির সংখ্যা অবশ্যই বাড়বে। বাংলাদেশের এই ভৌগোলিক কাঠামোতেও বাড়বে। যদি তাই হয় বাঙালির ভবিষ্যৎ খারাপ হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সত্যিকারের বাঙালি বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন? বাঙালি বলতে বুঝি বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এমন মানুষ, যে মানুষ তার পাশের মানুষকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করে। তার পাশের দেশের মানুষকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করে। সারা পৃথিবীর মানুষকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু সে বলে এই গাঙেয় অববাহিকায় আমার জন্ম। আমি বাঙালি, এটাই আমার প্রথম পরিচয়। দ্বিতীয় পরিচয় আমি বাঙালি। শেষ পরিচয়েও আমি বাঙালি। আসলে জন্মে জন্মে আমি বাঙালি। একুশে সংবাদ ডটকম/আর/১৩-০৪-০১৫:
Link copied!