AB Bank
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

বাঙালি হইব, নাকি মানুষ হইব?


Ekushey Sangbad

১১:২৪ এএম, এপ্রিল ১৫, ২০১৫
বাঙালি হইব, নাকি মানুষ হইব?

একুশে সংবাদ : রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি!’ শুধু বাঙালি হলে কি চলে না? কেন মানুষ হতে হবে? বাঙালিত্ব বা মনুষ্যত্ব কি জন্মগত কোনো ব্যাপার? নাকি এসব গুণ অর্জন করতে হয়? কোথায় মনুষ্যত্বের শুরু? কোথায় বাঙালিত্বের শেষ? কোন কোন বৈশিষ্ট্য চলে গেলে মানুষ আর বাঙালি থাকে না? মানুষ আর বাঙালির কথা আপাতত মুলতবি থাক। ধরা যাক, আমরা জানতে চাই, ‘ছাগল’ কাকে বলে? ছাগলের সংজ্ঞা দিতে হলে ছাগলের স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্যগুলো জানতে হবে। ছাগল হচ্ছে চার পা, দুই কান, দুই শিং, এক লেজ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যযুক্ত একটি পশু। সমস্যা হচ্ছে, গরু এবং গাধারও এ একই বৈশিষ্ট্যগুলো রয়েছে। যে একটি বৈশিষ্ট্য গরুকে ছাগল থেকে পৃথক করতে পারে সেটি হচ্ছে, গরু আর ছাগলের ডাক- ‘ম্যা-ম্যা’ করলে ছাগল, আর ‘হাম্বা-হাম্বা’ করলে গরু। শ্রীকান্ত দ্বিতীয় পর্বে শরৎচন্দ্র যেমনটি লিখেছিলেন, বাঙালির ‘মা-মা’ আর ছাগলের ‘ম্যা-ম্যা’। গরু-ছাগল না হয় চিনলাম তাদের মুখনিসৃত ধ্বনি দিয়ে, কিন্তু বাঙালি চিনি কি দিয়ে? ভাষা মানুষের অন্যতম স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য। বাঙালি সমাজে জন্ম নিয়ে এবং বড় হয়ে বাঙালি শিশুরা বাংলা ভাষা অর্জন করে। বাঙালি হতে হলে সাবলীলভাবে বাংলা বলতে ও বুঝতে হবে। কিন্তু বহু বিদেশি বা বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরাও বাংলা ভাষা বেশ ভালোই বলতে পারেন। এরা কি বাঙালি? উত্তর- বাঙালিকরণ একটি ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় বহু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বাঙালি জাতির অঙ্গীভূত হয়েছে গত কয়েক হাজার বছরে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা যে বাঙালিদের অন্যতম পূর্বপুরুষ ছিল বাঙালির ভাষা-ব্যাকরণ ও চেহারায় তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। পান্তাভাত, শাড়ি-ব্লাউজ, ধুতি-পায়জামা-পাঞ্জাবি, পহেলা বৈশাখ- এগুলো কি বাঙালির বৈশিষ্ট্য নয়? বৈশিষ্ট্য অবশ্যই, কিন্তু এসব বৈশিষ্ট্য বাঙালির স্বাতন্ত্র্যসূচক নয়। ভাত খাওয়ার শুরু বাংলা অঞ্চলে আর শেষ সেই প্রশান্ত মহাসাগরের পারে জাপানে গিয়ে। আধুনিক বাঙালি নারী যেভাবে শাড়ি পরে, তা চালু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বৌদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী মাত্র শ’ দেড়েক বছর আগে। তখন সেমিজ দিয়ে শাড়ি পরা হতো। আমার ছোটবেলায়ও সেমিজের ব্যবহার দেখেছি। আধুনিক ব্লাউজের বয়স ১০০ বছরও হবে কিনা সন্দেহ। শাড়িটা বাঙালি নারী বহুদিন ধরে পরছে বলে ভাবা হয়, কিন্তু এ ব্যাপারে গবেষণার অবকাশ আছে। ছোটবেলায় চট্টগ্রামে মুসলমান মহিলাদের শাড়ি খুব একটা পরতে দেখিনি। তারা ওপরে দোপাট্টা পরত, নিচে লুঙ্গির মতো করে একপাট্টা। গত ১০০ বছরে ধুতির স্থান দখল করেছে দক্ষিণ ভারত বা মিয়ানমারের লুঙ্গি। নীহাররঞ্জন রায় বাঙালির ইতিহাসে লিখেছেন যে, বাঙালি ঊর্ধ্বাঙ্গে সাধারণত কিছু পরত না। প্রয়োজন হলে একটা চাদর জড়িয়ে নিত। বাঙালি ফতুয়া বা পাঞ্জাবি পরছে অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে। নামেই বোঝা যায়, পাঞ্জাবির উৎস পাঞ্জাব অঞ্চল, অন্ততপক্ষে উত্তর ভারত। সুতরাং বাঙালি পোশাক বলতে আমরা আজ যা বুঝি তার বয়স সাকুল্যে শ’ দুয়েক বছরও হবে কিনা সন্দেহ। পহেলা বৈশাখ শুধু বাঙালির উৎসব নয়। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ও আসামের অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ‘অধিবাসী’ এ উৎসবটি পালন করে আসছে হাজার বছর ধরে। আসামে এ উৎসবটি ‘বিহু’ উৎসব নামে পরিচিত। বাংলাদেশের কোনো কোনো নৃগোষ্ঠীর ভাষায় ‘বিঝু’। চট্টগ্রামে আমরা বলতাম ‘বিউ’। সম্ভবত বছরের সর্বশেষ দিন মূল বিউ এবং তার আগের দিন ফুল বিউ। চৈত্রের শেষ দিনগুলোতে সন্ধ্যা নামার সময় বাড়ির বাইরে আগুন জ্বালিয়ে সেখানে ‘বিষকাঁটালি’ নামের একটি আগাছা পোড়াতাম। আগুনের ধোঁয়া উপরে উঠতে শুরু করলে চিৎকার করে আমরা বলতাম- ‘জাগরে বিশু জাগ’। ফুল বিউর দিন হলুদ ইত্যাদি গায়ে মেখে স্নান করতে হতো। স্নান করানো হতো গরু-বাছুরকেও। মূল বিউর দিন কমবেশি ৩৬ ধরনের তরকারি মিশিয়ে একটি ব্যঞ্জন রান্না করা হতো। আদিবাসীদের মধ্যেও এ প্রথাটি প্রচলিত আছে। এ তরকারিতে দেয়ার জন্য আমরা বনবাদাড় থেকে ‘কাট্টইস’ নামের কাঁটাগাছ খুঁজে নিয়ে আসতাম। এ ‘কাট্টইস’ শব্দটি সম্ভবত ক্যাকটাসের অপভ্রংশ। ফুল বিউর দিন খুব ভোরে খালের পাড়ে গজানো বিশেষ এক কাঁটাগাছের বেগুনি রঙের ফুল তুলে আনতাম (কাঁটার খোঁচা আর কাদার কারণে এ ফুল তোলা বেশ কঠিন ছিল)। এ ফুলের মালা গেঁথে আমরা ঘরের দরজা-জানালায়, গুরুত্বপূর্ণ সব আসবাব (এমনকি গরুর গলায়ও) ঝুলিয়ে দিতাম। এ ফুল শুকানোর পরও সারা বছর প্রায় একই ধরনের থাকত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে গাছগুলো থেকে আমরা এ ফুল তুলতাম, সেই গাছের কালচে সবুজ পাতা ও সিঁদুরে লাল রঙের ফলের আকৃতি অবিকল ক্রিসমাস উপলক্ষে ইউরোপের কিছু দেশের ঘরে ঝোলানো পাতা ও ফলের মতো। লাতিন আমেরিকায় কালচে সবুজ ও সিঁদুরে লাল ক্রিসমাসের রঙ। পন্ডিতরা মনে করেন, ক্রিসমাস উৎসবটি সুদূর অতীতে অন্য কোনো (বৃক্ষ বা ঋতু) উৎসব ছিল, পরে এটি যিশু খ্রিস্টের জন্মোৎসবের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। মহাবিষুব সংক্রান্তিতে বাংলা অঞ্চলে নববর্ষ হয়। ‘বিউ’, ‘বিহু’ বা ‘বিঝু’ ইত্যাদি শব্দ কি ‘বিষুব’ শব্দ থেকে এসেছে? হয়তো প্রাক হিন্দু যুগের কোনো আঞ্চলিক দেবতার নাম ছিল বিশু। হতে পারে এ দেবতা শিব বা বিশ্বনাথের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে কালক্রমে। বিশ্বনাথের কথা মনে এলো, কারণ পহেলা বৈশাখের আগের দিন চৈত্রসংক্রান্তি এবং এ দিনে চড়কপূজা হয়। চড়কপূজার প্রাক হিন্দু উৎস থাকলেও এটি এখন একান্তভাবে শিবেরই পূজা। চট্টগ্রামের বিউ, আসামের বিহু এবং আদিবাসীদের বিঝু আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে- ১. বর্ষবরণ উৎসবটি বাঙালির একার নয়, ২. আকবর বা শশাঙ্কের জন্মের বহু আগ থেকেই এ বাংলা সনটি প্রচলিত আছে, ৩. বাংলা ভাষার মতোই ‘বঙ্গাব্দ’ নামে প্রচলিত সনটির উৎস অনুসন্ধানের সময় ‘আদিবাসী’ বা নৃতাত্ত্বিক উপাদানগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। ভাষা-ব্যকরণ, সংস্কৃতি বা জিনবৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বাংলা অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে বাঙালিদের কোথায় কোথায় মিল আছে বাঙালি জাতির বিবর্তনের প্রকৃত ইতিহাস রচনার প্রয়োজনে তা খুঁজে বের করতে হবে। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্রথম পৃষ্ঠায় আছে, ‘ইস্কুলের মাঠে বাঙালি ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ’। এ উপন্যাসের প্রথম পর্বের পটভূমি বিহার অঞ্চল, বিশেষ করে ভাগলপুর জেলা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিহারে বসবাসরত বাঙালিদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু। ‘বাঙালি’ বলতে সে কালে এবং সে স্থানে ‘হিন্দু বাঙালি’ বোঝাত এবং ‘মুসলমান’ বলতে স্থানীয় বিহারি মুসলমান বোঝাত। তবে এমন একটা সময় ছিল যখন হিন্দু লেখকরা ‘বাঙালি’ বলতে বাঙালি হিন্দুদেরই বোঝাতেন। এটা তাদের জানার ভুল বা ইচ্ছাকৃত ভুল। এ ভুলের যত ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণই থাকুক না কেন। বাংলা অঞ্চলে বসবাসরত বাংলাভাষী মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই যে একই বাঙালি জাতির সদস্য, ১৯৪৭ ও ১৯৭১ এর পর তা নিয়ে কোনো সন্দেহই আর থাকা উচিত নয়। হ্যাঁ, বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমানের ধর্ম ও সংস্কৃতিতে পার্থক্য আছে। কিন্তু তাদের মধ্যে আছে ভাষার মিল, ইতিহাসের মিল, সংস্কৃতির মিল, জিনগত মিল। এক জাতি হওয়ার জন্য যতটুকু মিলের দরকার এ অঞ্চলের বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে তার চেয়ে হয়তো কিছু বেশিই আছে। আমরা বাঙালি, নাকি বাংলাদেশী? ইংরেজিতে ‘নেশন’ শব্দটির দুইটি অর্থ আছে- ‘জাতি’ এবং ‘রাষ্ট্রজাতি’। বাংলায় ‘জাতি’ শব্দের এ দ্ব্যর্থবোধকতা আছে। ‘ব্রিটিশ’ শব্দে ‘জাতি’ বোঝাতে পারে আবার আইরিশ, স্কটিশ, ওয়েলশ, ব্রিটিশ ইত্যাদি জাতি মিলিয়ে একটি ‘রাষ্ট্রজাতি’ও বোঝাতে পারে। নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হতে পারে ‘জাতি’। কোনো বিশেষ রাষ্ট্রের অধিবাসী সেই বিবেচনায় ‘রাষ্ট্রজাতি’। স্কটিশদের জাতীয়তা স্কটিশ, ব্রিটিশদের জাতীয়তা ব্রিটিশ, কিন্তু উভয় জাতির রাষ্ট্রীয়তা ব্রিটিশ। একইভাবে একজন চাকমা বা মারমার জাতীয়তা হতে পারে চাকমা বা মারমা, কিন্তু তাদের রাষ্ট্রীয়তা বাঙালি। পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের জাতীয়তা ‘বাঙালি’, কিন্তু রাষ্ট্রীয়তা ‘ভারতীয়’। সুতরাং ‘বাঙালি’ শব্দে জাতি বোঝাতে পারে, আবার রাষ্ট্রজাতিও বোঝাতে পারে। কিছু রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও টকসওয়ার নিজেদের বিশেষ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ‘জাতি’ ও ‘রাষ্ট্রজাতি’- এ উভয় অর্থে ‘বাংলাদেশী’ শব্দটা ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। রাষ্ট্র কিছু দিন পর পর বদলাতে পারে, জাতি গঠিত হতে হাজার বছর লেগে যায়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা ব্রিটিশ আমলের আগেও আমরা বাঙালিই ছিলাম। আমি মনে করি, শুধু ‘রাষ্ট্রজাতি’ অর্থে ‘বাংলাদেশী’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে পারে, ‘জাতি’ অর্থে নয়। বাঙালি হইব, না মানুষ হইব? যে অমানুষ, সে বাঙালি হলেই কী, বাংলাদেশী হলেই কী! রাষ্ট্রপিতা শেখ মুজিবুর রহমান (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা : ১৯১) মরণাপন্ন সহকারাবন্দি চন্দ্র ঘোষকে বলেছিলেন, ‘আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নেই। সবাই মানুষ।’ সুতরাং বাঙালি বা বাংলাদেশী পরিচয় নিয়ে অকারণ দ্বিধাগ্রস্ততা পরিহার করে মানুষ হওয়াটাকে অগ্রাধিকার দিলে ভালো হয়। শিশির ভট্টাচার্য : অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একুশে সংবাদ ডটকম/আর/১৫-০৪-০১৫:
Link copied!