বাংলা কবিতায় বৈশাখ...
একুশে সংবাদ : পহেলা বৈশাখ। জাতি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই প্রাণের উচ্ছ্বাসে মাতে এদিনে। কবি সাহিত্যিকরা বৈশাখ বিষয়ে আন্দোলিত হন। তারা গদ্যে ও কাব্যে বৈশাখের প্রতি ভালোবাসা নিবেদন করেন। ধ্বংস-সৃষ্টি, বিরহ-মিলন, সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সব কিছু উঠে আসে শিল্পীদের বিভিন্ন প্রকার শিল্পের বাঁকে বাঁকে। সাহিত্যে বৈশাখের পদচারণা ব্যাপক। বৈশাখের পটভূমি নিয়ে বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে কবিতা, ছড়া, গল্প ইত্যাদি। ঋতুর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সহজেই সাহিত্যিকদের আন্দোলিত করে, বিভিন্ন বিষয়ে লিখতে অনুপ্রেরণা জোগায়। সম্রাট আকবরের সময় থেকে খাজনা আদায়ের মাস বৈশাখ থেকে শুরু হলেও বর্তমানে তা পরিবর্তিত হয়ে প্রাণের মেলার উৎসবে পরিণত হয়েছে। কবি সাহিত্যিকগণ প্রাণের মেলার এ উৎসবকে শব্দে ধরে রাখতে বারবার প্রয়াসী হয়েছেন। বৈশাখকে নিয়ে কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী কলম চালিয়েছেন এভাবে-
‘‘বৈশাখে অনলসম বসন্তের খরা।
তরুতল নাহি মোর করিতে পসরা
পায় পোড়ে খরতর রবির কিরণ।’’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঋতুভিত্তিক লেখা লিখেছেন। বৈশাখের বারতা তাঁর কবিতায় সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। নিমগ্নভাবে বৈশাখ বন্দনা করেছেন। একদিকে বৈশাখের ধ্বংসরূপ, পাশাপাশি নতুন বছরের আগমন সৃষ্টিকে নতুনরূপে উৎসাহিত করে, এমন সত্য তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তার ‘‘বৈশাখ আবাহন’’ কবিতায়-
‘‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক
যাক পুরাতন স্মৃতি যাক ভুলে যাওয়া গীতি
অশ্রু বাষ্প সুদূরে মিলাক
মুছে যাক সব গ্লানি। মুছে যাক জরা
অগ্নিবাণে দেহে-প্রাণে শুচি হোক ধরা।’’
বৈশাখের মতোই রুদ্র, অশান্ত, বিপ্লবী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বৈশাখের আগমনে মুক্তির উল্লাসে কবি মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন। নতুনের আহবান ও সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবি উদ্দীপ্ত হন। কাব্যিক ব্যঞ্জনার মাধ্যমে দৃপ্তকণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করেন-
ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বৈশাখীর ঝড়
তোরা সব জয় ধ্বনি কর
তোরা সব জয় ধ্বনি কর
ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর
প্রলয় নতুন সৃজন বেদন
আসছে নবীন জীবন ধারা অসুন্দরে করতে ছেদন।’’
জীবনান্দ দাশ একজন জীবন ঘনিষ্ট নিমগ্ন কবি। তার কবিতার অনুভূতি ব্যাপক ও দীপ্রতর। তিনি বৈশাখ নিয়েও কবিতা লিখেছেন-
‘‘ঘুমিয়ে পড়ব আমি একদিন
তোমাদের নক্ষত্রের রাতে
শিয়রে বৈশাখ মেঘ সাদা
যেন কড়ি শঙ্খের পাহাড়।’’
কবি ফররুখ আহমদ তাঁর বিখ্যাত ‘‘বৈশাখ’’ কবিতায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রলয়ের আহবান জানাচেছন এভাবে-
‘‘ধ্বংসের নকীব তুমি হে দুর্বার, দুর্ধর্ষ বৈশাখ
সময়ের বালুচরে তোমার কঠোর কণ্ঠে
শুনি আজ অকুণ্ঠিত প্রলয়ের ডাক।’’
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন বৈশাখকে নিয়ে অন্তরের সূক্ষ্মতম অনুভূতি প্রকাশ করেছেন এভাবে-
‘‘বোশেখ শেষে বালুচরের বোরো ধানের ধান
সোনায় সোনা মিলিয়ে দিয়ে দিয়েছে কেড়ে প্রাণ’’
কবি গোলাম মোস্তফা নববর্ষের আগমণকে আশির্বাদ হিসেবে দেখেছেন। নতুন ভাবে জেগে ওঠার আহবান রয়েছে তার কবিতায়। বৈশাখকে তেজদীপ্ত ঘোড়ার দেŠড়ানোর সাথে তুলনা করেছেন। ‘‘নববর্ষের আশির্বাদ’’ কবিতায় তিনি বলেছেন-
‘‘ওই এলোরে ওই এলো
নতুন বর্ষ ওই এলো
তরুণ তপন উঠলোরে
ধ্বস্ত তিমির ছুটলোরে
নওরোজের এই উৎসবে
ওঠ জেগে আজ ওঠ সবে।’’
বর্তমান বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি আল মাহমুদ ‘‘বোশেখ মাসে এ কোন খরা’’ কবিতায় কলম চালিয়েছেন এমনিভাবে-
‘‘ঋতুর রাজা বোশেখ এসো,
খোলো স্রোতের মুখ
তৃষ্ণাকাতর হাজার বুকে
লাগুক পানির সুখ।’’
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বৈশাখকে দেখেছেন ভিন্ন মাত্রায়। কবি বৈশাখকে প্রকৃতি ও মানুষের নবরূপে জেগে ওঠার অফুরন্ত শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ‘‘বৈশাখী’’ কবিতায় তিনি বলেছেন-
‘‘এসো এসো এসো হে নবীন এসো এসো হে বৈশাখ
এসো আলো এসো হে প্রাণ ডাক কালবৈশাখীর ডাক
বাতাসে আলো ঝড়ের সুর
যুক্ত করো নিকট দূর
যুক্ত করো শতাব্দীতে দিনের প্রতিদানে।’’
কবি মোশাররফ হোসেন খান বৈশাখ নিয়ে মনের ভাব ব্যক্ত করেছেন এভাবে-
‘‘সকল জীর্ণতা দীর্ণ করে তুমি এসো হে বৈশাখ
এসো উত্তপ্ত বদ্বীপে, সবুজ পল্লবে, নবরূপে
এসো স্বপ্ন-সম্ভাবনা বুকে নিয়ে, এসো বারবার,
মুছে দাও ব্যর্থতার যত গ্লানি, জীবনের ভার।’’
নিজেকে নতুন করে অদম্য ভঙ্গিতে দেখার প্রয়াস পেয়েছেন কবি সৈয়দ শামসুল হক তার ‘‘বৈশাখ’’ কবিতায় নতুন পৃথিবী, নতুন নীলিমা, নতুন চোখ উম্মোচিত হয়েছে কবির বোধে। কবি সচকিত হয়েছেন, নিজেকে চিনতে পেরে আনন্দিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন-
‘‘আমি কে
আমি পারিনে চিনতে আজ
কি অবাক কি অবাক
পুরোনো আমাকে নতুন নতুনে
সাজিয়েছে বৈশাখ
দুচোখ আমার নতুন নীলিমা
নতুন পৃথিবী ডাকে
দেখি বার বার উৎসব দিনে
বাংলায় বাংলা।’’
কবি হাসান হাফিজ বৈশাখ নিয়ে কলম চালিয়েছেন এভাবে-
‘‘এসো বৈশাখ, আবেগস্নিগ্ধ অভিষেকে
নিজকে তুমি স্থাপন করো
ভালোবাসায় আপ্লুত হও আরও….।’’
মারুফ রায়হান বৈশাখ নিয়ে লিখেছেন-
‘‘আতঙ্কিত কবি বিনিদ্র ভাবেন;
এই রাত কি হবে না শেষ?’’
সূর্য পুষ্ট আলোকিত নতুন সকাল আসবে না!
চৈত্ররাত্রি শেষে ফিরবে না বাংলার বৈশাখ-বৈভব?
শব্দের কারিগর কবি আবিদ আজাদ তার বৈশাখের স্মৃতি কবিতায় লিখেছেন-
‘‘বৈশাখের কথা মনে হলেই আমার মনে পড়ে যায়
সবুজ পাতার চাপা-গুঞ্জন বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ফেরারি এক যুবকের কথা
মনে পড়ে স্বপ্নের হয়রানি নিয়ে সেই কথন ঘুমিয়ে পড়েছে ছোট্ট ইস্টিশান
মনে পড়ে হলুদ দেয়ালের পাশে ক্লান্ত- হয়ে দাঁড়ায়ে আছে বসন্তের ঠেলাগাড়ি
সামনেই ফুটপাতে উড়ছে ছেঁড়া কাগজ, ছেঁড়া মেঘ, ছেঁড়া তাবু আর
ছেঁড়া ফাড়া অনেক মানুষ…..।’’
এমনিভাবে বৈশাখ নিয়ে বহু কবি সাহিত্যিকগণ কবিতায় তাদের মনোভাব প্রকাশ করেছেন। চমৎকারভাবে সাবলীল ভঙ্গিতে তারা বৈশাখের জয়গান গেয়েছেন। এর মাধ্যমে কবি সাহিত্যিকগণ তাদের কবিতায় বৈশাখের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। নববর্ষের এই চেতনা সমগ্র জাতি সত্তাকে নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগাবে।
একুশে সংবাদ ডটকম/আর/১৫-০৪-০১৫:
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :