হরতালের দু:খ
শামসুল আলম স্বপন : সকলের দু:খ কষ্টের কথা লেখা হলেও আমার কষ্টের কথা কেউ লেখেনা, কেউ বলে না । আমাকে ডাক দিলে সাংবাদিক ভাই বোনেরা আগাম প্রস্তুতি নেয় আমি কতটা দেশ জাতি ও মানুষের ক্ষতি করলাম তা লেখার জন্য । ফটো সাংবাদিক ও টিভি ক্যামেরা ম্যানরা ওৎ পেতে ক্যামরা তাক করে বসে থাকেন আমার ডাকে কতটি গাড়ি ভাংচুর হলো, কতটা গাড়ি পুড়লো আর ক’জন মানুষ রাজপথে প্রাণ দিলো, অগ্নিদগ্ধ হলো কিম্বা গুলি বিদ্ধ হলো তার ছবি তোলার জন্য। আমাকে সফল করতে রাজপথে নেমে কতজন পুলিশী পিটুনী খেল, কতজন গ্রেফতার হলো কোন কিছুই বাদ যায় না সাংবাদিক ভাইদের লেখুনী থেকে। সকলের দু:খ কষ্টের কথা লেখা হলেও আমার কষ্টের কথা কেউ লেখেনা, কেউ বলে না । আমার ভিতরে কত যে কষ্ট কত যে যন্ত্রণা রয়েছে তা কেউ বোঝে না। কেউ জানতেও চায় না সে সব যন্ত্রণার কথা। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিজের কষ্টের ঢোল নিজেই বাজাবো। অন্যের হাতে দিতে চাই না, দিলে আমার ঢোলটি যদি ফাঁটিয়ে ফেলে!
শুনুন আমার কষ্টের মর্মস্পর্ষী কথা গুলো:
বৃটীশ শাসনামলে আমার নাম ছিল “বন্দ”। বৃটীশ বেনিয়াদের পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকে তাড়ানোর জন্য তখন আমাকে ডাক দিতেন গান্ধিজী এবং তার অনুসারীরা। তখন আমার কি যে আনন্দ হতো তা বলে বুঝাতে পারবো না। আমাকে ডাকলে গোটা ভারত বর্ষ অচল হয়ে যেত। আমার সম্মান এবং মর্যাদা ছিল অন্যরকম। অত্যাচারি নীলকর শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করতে আমাকে সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করা হতো। সে সময় আমাকে ডাকা হতো দেশ-জাতি ও মানুষের স্বাধীনতা ও সুখ শান্তির জন্য। সে সময় আমাকে ডাকতেন দেশবরেণ্য দেশপ্রেমিক নেতারা । তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন,গান্ধিজী,জহল্লাল নেহেরু,নেতাজী সুভাষ বোসু,মাওলানা আকরাম খান,হোসেন শহীদ সারওয়ার্দী,শেরে বাংলা এ,এম,ফজলুল হকসহ আরও অনেকে। যারা ছিলেন দেশ-জাতি ও মানুষের আর্শীবাদ । নেতাদের দেশপ্রেম আর আমার কারণে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট বৃটীশ বেনিয়ারা ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়। পাক ভারত উপ-মহাদেশ ভাগ হয়ে যায় দুটি খন্ডে। জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দু’টি দেশের। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব-পাকিস্তান মিলে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি। চিন্তা ভাবনা করতে থাকি অবসরে যাওয়ার। কিন্তু না । ১৯৪৮ সাল থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠি বৃটীশ বেনিয়াদের মত পূর্ব-পাকিস্তানে শোষণ নির্যাতন চালানো শুরু করে। এ দেশের সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে যেতে লাগলো পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে বসানো হলো উর্ধভাষী পাকিস্তানীদের। শোষণ বঞ্চণার শিকার হতে লাগলো পূর্ব-পাকিস্তানের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ। শেরে বাংলা এ,কে ফজলুল হক.মাওলানা ভাষানী তুখোড় ছাত্র নেতা শেখ মুজিবর রহমান পাক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। সংগঠিত করতে লাগলেন দেশের জনগণকে। স্বৈরশাাসকের ভিত কাঁপাতে আবার প্রয়োজন পড়লো আমাকে। বদলে ফেলা হলো আমার নাম। “বন্দ” থেকে হয়ে গেলাম “হরতাল”। ১৯৫২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর নুরুল আমীন বাঙ্গালীর ঐতিহ্য বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করার এক নীল নকশা হিসেবে ঘোষণা দিলেন “ উর্ধ উইলবি ষ্টেট ল্যাঙগুয়েজ অব পাকিস্তান” গর্ভনর নুরুল আমীনের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে রোষে ফেঁটে পড়লো বাঙ্গালীরা। সিদ্ধান্ত হলো ২১ ফেব্রুয়ারী আমাকে ডাকার। আনন্দের বন্যা বয়ে গেল আমার মাঝে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী । সারা দেশ উত্তাল । ভাষা আন্দোলনের নামে রাজধানীর রাজপথ মুখরিত হলো পাক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা ভোর থেকে রাজপথ দখল করে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে লাগলো। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই মুর্হুমুহ শ্লোগান দিয়ে প্রকম্পিতি করেছিল রাজপথ । ভিত কেঁপে উঠে স্বৈরশাসকের। অবস্থা বেগতিক দেখে নিরিহ ছাত্রনেতাদের উপর গুলি চালায় পাক-স্বৈরশাসক। সে দিন রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল সালাম,জব্বার,রফিকসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র নেতার রক্তে। স্বাধীনতার ভিত রচিত হয়েছিল মুলত ৫২’র ২১ শে ফেব্রুয়ারী । দেশের স্বাধীনতা আনতে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে যেয়ে শেখ মুজিবর রহমান কতবার জেলে গিয়েছেন তার হিসেব আমার কাছে নেই তবে বলতে পারি যতবার তিনি জেলে গিয়েছেন ততবারই রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে আমাকে ডাকা হয়েছে। বাংলাকে ভালোবেসে নিজের জীবনকে উৎস্বর্গ করার জন্য দেশেবাসী শেখ মুজিবকে উপাধি দিয়েছিলেন “বঙ্গবন্ধু”। স্বৈরচারের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আমাকে ডাক দিলে স্বত:ষ্ফুর্ত পালিত হতাম আমি। আমিই ছিলাম রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রধান হাতিয়ার। আমার কথা শুনলে ভয়ে কেঁপে উঠতো পাক-স্বৈরশাসক। আমি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠতাম। আমার কারণে জেল থেকে বঙ্গবন্ধুকে বার,বার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল পাক-স্বৈরশাসক। ৬৯’র গণ-আন্দোলন , জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে ৭১’র স্বাধীনতা আন্দোলন সব খানেই ছিলাম আমি। রাজনৈতিক দল ও নেতাদের কাছে আমার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
৯০’এ স্বৈরচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আমার অবদান কমছিল না। আমার কারণে লৌহমানব খ্যাত হু,মু এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন । আমার জন্য ১৯৯৫ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারীর ভোটার বিহীন নিবার্চন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলেন ম্যাডাম জিয়া। সে সময় আমাকে লাগাতার ডাক দেয়া হয়েছিল।
আমি খুব খুশি হয়েছিলাম ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা কুষ্টিয়ার কুমারখালীর জনসভায় যখন ভাষণ দিলেন এই বলে যে, “আমরা ক্ষমতায় না থাকলেও আর কোন দিন হরতালের ডাক দিবো না”। সে দিন আমি যে কত খুশি হয়েছিলাম তা বলে বুঝাতে পারবো না। আমাকে ডাকলে সুযোগ সন্ধানীরা সুযোগ পায়। ক্ষতি গ্রস্থ হয় নিরিহ মানুষ। অচল হয়ে যায় দেশের অর্থনীতির চাকা। স্বাধীনের পর আমাকে ডেকে দেশের যে ক্ষতি করা হয়েছে তা কল্পনারও বাইরে। আমার মনে হয় আমাকে না ডাকলে বাংলাদেশ এতদিন উন্নত বিশ্বের কাতারে গিয়ে দাঁড়াতো। যাই হোক যা বলছিলাম। জননেত্রীর ঘোষণায় আমি আশস্ত হয়েছিলাম এই ভেবে যে এবার বোধ হয় আমাকে বাতিল করার জন্য জাতীয় সংসদে তিনি বিল উত্থাপন করবেন, কিন্তু না। জননেত্রী কথা রাখলেন না। এরপর পটপরিবর্তন হলো ক্ষমতার । স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতার হালুয়া-রুটি দিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষমতায় এলো জামায়াত-বিএনপি জোট। স্বাধীন বাংলার পতাকা শোভা পেল স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে। কষ্ট পেলেও আমার করার কিছুই ছিল না । বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামীলীগ বিভিন্ন কর্মসুচি নিয়ে মাঠে নেমে ব্যর্থ হয়ে আবারও ডাক দিলো আমাকে। সুযোগ পেয়ে বিটিভি জননেত্রী শেখ হাসিনার কুমার খালীর সেই ভাষণ “আমরা ক্ষমতায় না থাকলেও আর কোন দিন হরতালের ডাক দিবো না” বার বার প্রচার করতে লাগলো। আমি লজ্জা পেলেও উনারা ভ্রুক্ষেপ করলেন না। বার বার ডাকলেন আমাকে। জ্বালাও পোড়াও,রাজপথে মানুষকে দিগম্বর করা,নারী আন্দোলনকারীদের রাজপথে পুলিশী নির্যাতন, আর নিরিহ মানুষ খুন দেখতে দেখতে আমি হাফিয়ে উঠলাম। আবারও ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলো । ক্ষমতায় এলো স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন আওয়ামীলীগ। বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত মিলে ভোট চুরির অভিযোগে বার বার ডাক দিলো আমাকে। বিএনপি-জামায়াত জোটের গলাবাজি শুনে হাসি পেতাম এই ভেবে যে, ঝাজর নিন্দে করে খইচালাকে। আমাকে ডাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হতে লাগলো দেশ। আমাকে কেন আইন করে বাতিল করা হলো না এই ভেবে দু:খ পেতাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কারণ ক্ষমতা থেকে কাওকে টেনে হিছড়ে নামাতে হলে তো আমাকেই প্রয়োজন । রাজনৈতিক দল গুলোর সহিংস ঘটনার কারণে সৃষ্টি হলো ১/১১ এর মত একটি অধ্যায়। রাজনৈতিক নেতাদের ভুলের মাশুল দিতে হলো দেশের জনসাধারণকে।
২০১৫ সালের ৫ই জানুয়ারী সংবিধান সমুন্নত রাখতে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলো বর্তমান সরকার। বিরোধী দলের বক্তব্য ক্ষমতা পাকা-পোক্ত করতে ওটা ছিল প্রহসনের নির্বাচন । বিরোধী দল উঠে পড়ে লাগলো ওই নির্বাচন বাতিল করার জন্য। শুরু হলো আন্দোলন। প্রথমে ডাকা হলো আমার ছোট ভাই ‘অবরোধ’কে । তাতে যখন কোন কাজ হলো না তখন অবরোধের সাথে ডাকা হলো আমাকে। এবার আমাকে চাঙ্গা করার জন্য তৈরী করা হলো প্রেট্রোল বোমা । যা আগে কখনো শুনিনি। যানবাহনে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে জ্বালিয়ে দেয়া হলো শত শত গাড়ি। আগুনে পুড়ে নিহত হলো শিশু নারীসহ শতাধিক মানুষ । আহত হলো কয়েক হাজার। ক্ষতি হলো লক্ষ হাজার কোটি টাকা।
এরপরও আমাকে বাতিল করার কোন উদ্যোগ নেই। আমি সব চেয়ে বেশী কষ্ট পায় তখন; যখন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবির আমাকে ডাক দেয়। তখন মনে হয় ওদের দু’গালে দুটি চড় কষে দিই কিন্তু আমার তো হাত নেই। এই স্বাধীন দেশে ওরা কেন আমাকে ডাকবে? ওরা আমাকে ডাকার কারণে দেশের মানুষ কেন বলির পাঁঠা হবে। এ সব ভেবে মাঝে মধ্যে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারি না। তবে মাঝে মধ্যে আশস্থ হই এই ভেবে যে, আমার কারণে প্রভাবশালী মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী জেলে তসলিমা নাসরিন পরবাসে। আমাকে ডাকলে পুলিশ ভাইদের ইনকাম বেড়ে যায়, কিন্তু এর পরও আমার শান্তি নেই। কারণ এখন আমাকে আর কেউ মানছে না। আগে আমাকে ডেকে মাঠে থাকতেন নেতা-কর্মীরা । শ্লোগান দিতেন “গাড়ির চাকা ঘুরবে না-দোকান পাট খুলবে না”। আমি পালিত হতাম স্বত:ষ্ফুর্ত ভাবে। এখন আমাকে ডাকা হয় গোপনে থেকে টেলিভিশনে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। রাজপথে থাকে না নেতা-কর্মীরা। শুনি আমাকে ডেকে ঘরে বসে ভুনা খিচুড়ি-গোস্ত খায়,কেউ কেউ নাকি বসে বোতল গেলাস নিয়ে। দিন আনি দিন খায় মানুষের কি যে কষ্ট হয় ওরা তা বুঝতে চায় না। একদল চায় ক্ষমতায় থাকতে আরেক দল চায় ক্ষমতা থেকে নামাতে। নেতা-কর্মীরা এখন পুলিশের প্যাদানির ভয়ে থাকে গা ঢাকা দিয়ে। গাড়ি চালকেরা পান চিবুতে চিবুতে আমাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে রাজপথ ধরে চলে যায় গন্তব্যে। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়। আমার ইজ্জত সম্মান বলে কিছুই বাকী নেই আর । কেউ আর আমাকে মানছে না। মানবেই বা কেন? দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য যদি আমাকে ডাকা হতো তা হলে সকলেই আমাকে মানতো । এখন আমাকে ডাকা হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়া জন্য। যে কারণে কেউ আমাকে মানছে না। আমি চরম লজ্জিত,অপমানিত, আমি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত,। লেজে-গোবরে অবস্থা আমার। আমি সকলের কাছে মাফ চাই। প্লিজ আমাকে ডেকে আর দেশের মানুষের সর্বনাশ করবেন না।
ভেবে দেখুন আমার কারণে দেশের কতটা ক্ষতি হয়েছে। আজ আর আমার কোন মর্যাদা নেই। তাই দেশবাসীর কাছে আমার শেষ আবেদন আমার ইজ্জত থাকতে থাকতে আমাকে আইন করে বন্ধ করার জন্য সকলে মিলে আর একবার আমাকে অর্থাৎ “হরতালের ডাক” দিন।
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :