AB Bank
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

বন্ধুর সহমর্মী হাত


Ekushey Sangbad

১০:৩৫ এএম, মার্চ ২৬, ২০১৪
বন্ধুর সহমর্মী হাত

ভারতের সরকার ও সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির সবচেয়ে বড় সহমর্মী বন্ধুর ভূমিকা পালন করে। তারা নানা দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা করে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার দায়িত্ব পালন করে ভারতে থেকে। ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়, অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করে এবং বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। বিশ্বব্যাপী ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বড় ভূমিকা রাখে। আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতের দিকে তাকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভূমিকাকে সহযোগিতামূলক বলার উপায় নেই। বার্মা ও শ্রীলঙ্কা ছিল পাকিস্তানের মিত্র। নেপালের প্রতিক্রিয়াও ইতিবাচক ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিম-উত্তর পূর্ব দিকে সীমান্তসংলগ্ন ভারতের পক্ষে কোনো প্রকার ধোঁয়াটে অবস্থান নেওয়া সম্ভব ছিল না। বলা যায় ভূ-রাজনৈতিক এবং ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, প্রত্যক্ষ ও সুনির্দিষ্ট। প্রবাসী সরকার গঠনে সহায়তা ৩ এপ্রিল ১৯৭১ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের আলোচনার আগেই ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় বক্তৃতায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ভারত সরকারের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মধ্যে আশা সঞ্চার করে। যুদ্ধ পরিচালনা এবং সহানুভূতি ও সমর্থনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রয়োজনে সরকার গঠনও জরুরি হয়ে পড়ে।| ১৭ এপ্রিল বিএসএফের সক্রিয় সহযোগিতায় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় নবীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের আনুষ্ঠনিক শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। ১৭ এপ্রিলের অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পর্কে আমিরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘বিএসএফের চট্টোপাধ্যায়কে (শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায়) বলি আমাদের জন্য ১০০টি গাড়ির ব্যবস্থা করতে। এর ৫০টা থাকবে প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের বহন করার জন্য। অবশিষ্ট ৫০টার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছানো হবে।’ ভারতীয় সীমান্তে এক কন্টিনজেন্ট বিএসএফকে সতর্কাবস্থায় রাখা হয় সম্ভাব্য পাকিস্তানি আক্রমণের মুখে ফায়ার কভার দেওয়ার জন্য। ভারতের পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকদের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণার ক্ষেত্রে ভারতের সম্পৃক্ততা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৮ এপ্রিল ডেপুটি হাইকমিশন ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে এই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্য সচিব নতুন প্রতিষ্ঠিত মিশনের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় এই সরকার ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতা লাভ করে। ভারতের আশ্রয় ও সাহায্যের ওপর এই সরকারের সাফল্য বহুলাংশে নির্ভরশীল ছিল। এই সরকারের ওপর আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ব ধরে রাখার ক্ষেত্রেও ভারতের কার্যকর সহায়তা অব্যাহত ছিল। প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় অস্ত্রের সংস্থান করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। মার্চ-এপ্রিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার দায়িত্ব বিএসএফের তত্ত্বাবধানে থাকলেও ৩০ এপ্রিল তাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নিযুক্ত করা হয়। প্রায় দুই হাজার তরুণের সামরিক প্রশিক্ষণ মে মাসের শেষ দিকে শুরু হয়। এর মধ্যে বাছাই করা যুবকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হতো; যেমন লক্ষেৗতে গোলন্দাজ প্রশিক্ষণের জন্য, দেরাদুনে সিগন্যাল, আসাম ও নাগাল্যান্ডে কমান্ডো ট্রেনিং, নৌ ও বিমান সৈনিকদের জন্যও প্রশিক্ষণের পৃথক ব্যবস্থা ছিল। মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করার পাশাপাশি এপ্রিল-মে মাসের দিকে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর কারণে বাংলাদেশ সংকটের সামরিক সমাধানের কথা ভাবতে শুরু করে ভারত সরকার। ডিরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনস লে. জেনারেল কে কে সিংকে সামরিক পরিকল্পনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ নীতিমালা প্রণয়নের দায়িত্ব ছিল যৌথভাবে বাংলাদেশ বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স এবং ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের। বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তে বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে গমনে ইচ্ছুকদের জন্য ‘যুব শিবির’ এবং ‘অভ্যর্থনা শিবির’ স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ থাকলেও প্রত্যেক যুব শিবিরে ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার একজন ভারতীয় সেনা অফিসার ‘ক্যাম্প প্রশাসক’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে মেজর জেনারেল উবানের তত্ত্বাবধানে উত্তর প্রদেশের দেরাদুনে এবং আসামের হামলংয়ে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিশেষভাবে নির্বাচিত আনুমানিক ৪০০ জন যুবককে ‘সফিস্টিকেটেড টেকনিকস অব ওয়াটারবর্ন অ্যান্ড আন্ডার-ওয়াটার স্যাবোটাজ’-এর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শরণার্থীদের সহায়তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম আঘাত এসেছিল হিন্দুদের ওপর, যা পরে ধর্মীয় পরিচয়ে আবদ্ধ থাকেনি। জুন মাস পর্যন্ত ত্রিপুরা রাজ্যে দেখা যায় শরণার্থীদের মধ্যে সিংহভাগই ছিল মুসলমান। শরণার্থীদের প্রাথমিক চাপ পড়ে সীমান্তসংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে। সর্বাধিক শরণার্থী আশ্রয় নেয় পশ্চিমবঙ্গে, এর পরে ত্রিপুরায়। ত্রাণকার্য তদারকির জন্য পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে কলকাতায় শাখা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। আসাম ও ত্রিপুরায় এর লিয়াজোঁ অফিস খোলা হয়। ত্রাণকার্যে সমন্বয় ও শরণার্থী শিবির প্রতিষ্ঠার মূল দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল পিএন লুথার। তিনি সাতটি রাজ্য সরকার, ২৪টি ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং ১২টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ে কাজ করেন। কর্নেল লুথার নয় মাসের কম সময়ের মধ্যে ৮৯৬টি শরণার্থী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন এবং ৬.৮ মিলিয়ন শরণার্থীর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। অবশিষ্ট প্রায় তিন মিলিয়ন শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান না করলেও নিয়মিত রেশন ও চিকিৎসা সহায়তা পেতেন। অক্টোবর মাসের দিকে এসে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এর প্রভাব ভারতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। শরণার্থী সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের শেষ কূটনৈতিক উদ্যোগ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর তিন সপ্তাহের সফরে ইউরোপ সফরের প্রাক্কালে শরণার্থীদের জন্য ক্রমবর্ধমান ঘাটতি ব্যয় মোকাবিলায় ৭০০ মিলিয়ন রুপির অতিরিক্ত করারোপের রাষ্ট্রপতির অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। প্রায় এক কোটি শরণার্থীর ব্যয়ভার বহনের জন্য ভারতকে এক বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতকে ব্যয় করতে হয় ২৬০ কোটি টাকা। শরণার্থী শিবিরেআন্তর্জাতিক জনমত সংগঠন আন্তর্জাতিক জনমতকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনতে ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মুসলিম বিশ্বের জোরালো সমর্থন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। অন্য পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নও জুন-জুলাই মাস মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি। এই পটভূমিতে ভারত বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে প্রতিনিধিদল পাঠায়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর বিভিন্ন মন্ত্রী এ সময়ে বহু রাষ্ট্র সফর করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা ও ভারতীয় ভূমিকার যথার্থতা ব্যাখ্যা করার জন্য ৬৭টি রাষ্ট্রে ১৮টি সরকারি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে ভারত সরকার। এর মধ্যে চারটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক মন্ত্রী সরদার শরণ সিং। ভারত সরকার নিজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি প্রেরণ করা ছাড়াও বাংলাদেশ সরকারকেও বহির্বিশ্বে তার অবস্থান তুলে ধরতে সহায়তা দেয়, বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর করেন আবদুস সামাদ আজাদ। বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রাধান্য দেওয়া হয় ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রকে, বিশেষভাবে জাতিসংঘকে কেন্দ্র করে দুটি দেশ পরিকল্পিত প্রচারণা চালায়। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় দূতাবাসসহ প্রবাসী ভারতীয় নাগরিকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ভারত সরকারের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রচার বিভাগ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে পুস্তক, পত্রিকা, দলিল, প্রামাণ্যচিত্র, চলচ্চিত্র তৈরি করে ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ব্যাপক প্রচার করে। এসব পুস্তক-পত্রিকায় পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন ও শরণার্থী সমস্যার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। জনগণের সহযোগিতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতের রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা জনগণের সহানুভূতি ও প্রতিক্রিয়া একই সমান্তরালে প্রবাহিত হয়নি। সরকারি দল হিসেবে কংগ্রেসের ভূমিকা সূচনালগ্নে ছিল অনেকটা সতর্কতামূলক এবং রক্ষণশীল, অন্যদিকে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং উৎসাহব্যঞ্জক। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষভাবে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সীয়), সোশ্যালিস্ট পার্টি, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এবং জনসংঘ বাংলাদেশকে কার্যকর সাহায্যের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়। বলার অপেক্ষা রাখে না রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ আদর্শ ও লাভ-ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তাদের করণীয় স্থির করে। দক্ষিণপন্থী দলগুলোর কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সাতচল্লিশ-পূর্ব ভারতে ফিরে যাওয়ার পথে প্রথম সোপান। অন্যদিকে বামপন্থী দলগুলো বাংলাদেশ সমস্যাকে বিবেচনা করেছে বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম হিসেবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সূচনালগ্নেই ভারতব্যাপী এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করে। পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের বিপরীতে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার আদর্শিক আবেদন ছিল অনেক তীব্র, যা ভারতের সাধারণ জনগণ ও বিভিন্ন সংগঠনকে অনুপ্রাণিত করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনে ও শরণার্থীদের মধ্যে আহার-বাসস্থানের সংস্থান করতে তাদের ভূমিকা ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের অধিকাংশ কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষাবিদ, শিল্পী মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিহার, কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ, মেঘালয়, উড়িষ্যা, রাজস্থান ও আসামের বিধানসভা পাকিস্তানকে নিন্দা জানিয়ে এবং বাংলাদেশকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ভারত সরকার তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ আন্দোলনকে সমর্থন করে। প্রশ্ন দেখা দেয় স্বীকৃতিদানসহ মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে। এসব ইস্যুতে ভারত সরকার সতর্কতা ও ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করে। বিশ্ব-জনমত যাতে বিপক্ষে চলে না যায়, সে জন্য সূচনাপর্বে সহানুভূতি ও নৈতিক সমর্থন দেওয়া ছাড়া ভারত সরকার সক্রিয় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ৯ আগস্ট, ১৯৭১ ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এর কারণে নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত সমর্থন যেমন নিশ্চিত হয়, তেমনি চীন-পাকিস্তানের সম্ভাব্য আক্রমণের মুখে ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস পায়। বাংলাদেশ প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় ও সামরিক প্রস্তুতি সমান্তরালে চালিয়ে যায় ভারত সরকার। বলা যায়, শরণার্থী সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে সুনির্দিষ্ট ও প্রত্যক্ষ করে দেয়। এদিকে অক্টোবর মাসের মধ্যে ভারত-পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্র সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে নিজ নিজ সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ও যুদ্ধের সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যবস্থা প্রায় সম্পন্ন করে আনে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার নানা ভাষ্য রয়েছে। অধিকাংশ গবেষক জাতীয় স্বার্থের আলোকে এর ব্যাখ্যা করে থাকেন। কারণ, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের মতো যুদ্ধবাজ প্রতিবেশী ভারতের দুই প্রান্তে না থাকলে ভারতের নিরাপত্তাঝুঁকি ও ব্যয়—দুটোই হ্রাস পায়। আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য চলে আসে ভারতের অনুকূলে। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ভারতের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করেছে। উপমহাদেশে পাকিস্তানও আর আগের মতো কার্যকর ভারসাম্য স্থাপনকারী শক্তি থাকল না। উত্তর সীমান্তের ভীতি মোকাবিলা করাও অনেক সহজসাধ্য হয়েছে। বৈরী নাগা ও মিজোরাম এখন আর পূর্ববঙ্গে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের জন্য যাবে না। চীনের ভয়ে পূর্বাঞ্চল নিয়ে ভারতকে আর উদ্বিগ্ন থাকতে হবে না। অস্বীকার করার উপায় নেই যে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অনুসৃত নীতি ও কর্মপদ্ধতির বিষয়টি নির্ধারিত হয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের দুই অংশের সম্পর্কের পটভূমিতে। বিভাগোত্তরকালে আড়াই দশক ধরে কাশ্মীর ইস্যু ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ককে কেবল তিক্তই করেছে। এর সঙ্গে আঞ্চলিক প্রভাববলয় বিস্তার এবং স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা পর্বে পরাশক্তির সহায়তার বৈশ্বিক রাজনীতিতে নিজ নিজ দেশের অবস্থান সংহত করার তীব্র প্রতিযোগিতা থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র দুটির মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ ও শত্রুতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে।
Link copied!