সুশাসন বহুদূর
একুশে সংবাদ : দুই প্রধান দলের নির্বাচনী অঙ্গীকারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় বারবার ব্যক্ত করা হলেও সুশাসন এখনো বহুদূরে। বলা সম্ভব যে সুশাসন অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। পাল্টা যুক্তি হলো, ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময় নিতান্ত কম নয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুশাসন অর্জন সম্ভব। এ কথা প্রায় সব সময় শোনা যায়। কিন্তু যে গণতন্ত্র একমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভের চেষ্টা, সে ধরনের গণতন্ত্রে সুশাসন অর্জন সম্ভব নয়। গত সপ্তাহের কয়েকটি দৈনিকে এ-সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু খবর প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি খবর বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন এক. ১৭৮ জন পুলিশের দুই কোটি টাকা আটক বাণিজ্য এবং দুই. প্রশাসননির্ভর আওয়ামী লীগ। প্রথম খবরের সঙ্গে একটি বাংলা দৈনিকে অন্য একটি খবরও প্রকাশ করা হয়। এ খবরে পুলিশের আটক বাণিজ্যের বিষয়ে শিরোনাম ছিল, 'সরকারি দলের নেতা-কর্মীরাই আটক বাণিজ্যের সহযোগী!' এ খবরের ভিত্তি গোয়েন্দাদের গোপন প্রতিবেদন। আটকদের অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার শীর্ষে ছিল কুমিল্লার পুলিশ। এক হাজার থেকে ১৪ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্যও এ খবরের মূল অংশ। তবে গোয়েন্দাদের গোপন প্রতিবেদনের যে কয়েকটি কেস স্টাডি প্রকাশ করা হয়েছে, তার মধ্যে কুমিল্লার কোনো কেস স্টাডি পাওয়া যায়নি। যা পাওয়া গেছে তা হলো অন্য জেলার। প্রথম কেস স্টাডি রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার। আটক আসামিকে ছেড়ে দেওয়া হয় মাত্র আট হাজার টাকার বিনিময়ে। ক্ষমতাসীন দলের একজন ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা এ বিষয়ে মধ্যস্থতা করেন। একই থানার অন্য এক তথ্যে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে আটক এক ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্য কয়েকটি কেস স্টাডি কুমিল্লার পাশ্বর্বর্তী অন্যান্য জেলার। তবে চমকপ্রদ বিষয় হলো, টাকার বিনিময়ে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে জামায়াতের নেতা-কর্মীরাও রয়েছেন। কিছু ছাত্রদল কর্মীও রয়েছেন। প্রতি ক্ষেত্রে মুক্তি পাওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরাই মধ্যস্ততা করেন বলে খবরে প্রকাশ।
সুশাসন বহুদূর
সরকার অবশ্য এ বিষয়ে একেবারেই নীরব নয়। খোদ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ প্রতিবেদন পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ খবর কালের কণ্ঠ ৭ এপ্রিল প্রকাশ করে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলো হলো নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও মৌলভীবাজার। তবে এর আগে লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, যশোর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, মাগুরা, মেহেরপুর, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, জামালপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জ। এ দীর্ঘ তালিকা থেকে সহজেই অনুমান করা সম্ভব যে হাতেগোনা কয়েকটি জেলা বাদে দেশের প্রায় সব জেলায় ব্যাপকহারে আটক বাণিজ্য হয়েছে। বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো দুর্নীতি মহামারি আকার ধারণ করেছে। কেবল আটক বাণিজ্যই নয়; বরং দুর্নীতির ক্ষেত্রে ভিন্নরূপ বাণিজ্যও রয়েছে। যেমন নিয়োগ বাণিজ্য ও ছিনতাইয়ের মাধ্যমে টেন্ডার বাণিজ্য। বলা যায় যে পুলিশের আটক বাণিজ্য কম মাত্রায় অতীতে সব সময়ই হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তার আকার ভয়াবহ। ১০ এপ্রিল অন্য একটি দৈনিকে কুমিল্লার কোনো তথ্য না থাকলেও কালের কণ্ঠে ৭ এপ্রিল প্রকাশিত সংবাদে কুমিল্লা জেলার বিশদ তথ্য প্রকাশ করা হয়।
জানা গেছে যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশের অনুলিপি পুলিশ অধিদপ্তরসহ র্যাবকেও পাঠানো হয়েছে। ধারণা করা যায় যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পুলিশ অধিদপ্তর ও র্যাব এ বিষয়ে অনুসন্ধান করবে। এতে সময়ের প্রয়োজন হবে। তবে ইতিবাচক বিষয়টি হলো, গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নামও প্রকাশ করা হয়েছে। এতে আরো আছে আটক ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা, যা অবশ্য সংশ্লিষ্ট খবরে পাওয়া যায়নি। ঠিকানা কী করে খুঁজে বের করা হবে, এর জন্য প্রধান সূত্র হলো থানায় এ বিষয়ে কোনো জিডি বা এফআইআর লিপিবদ্ধ করা হয়েছে কি না। থানার নিয়ম অনুযায়ী এ তথ্য লিপিবদ্ধ করার কথা। তবে লিপিবদ্ধ না করা হলে এর হদিস খুঁজে বের করা কঠিন হবে। অন্য বিষয়টি হলো, একই নামে বিভিন্ন ব্যক্তি। এ কথাও বলা যায়, টাকার বিনিময়ে যেসব আটক ব্যক্তি মুক্তি পেয়েছেন, তাঁরা কি সহজে স্বীকার করবেন যে টাকা দিয়ে তাঁরা মুক্তি পেয়েছেন! বাস্তবতা হলো তাঁরা সহজে স্বীকার করবেন না।
অন্যদিকে যেসব স্থানীয় নেতা-কর্মী মুক্তির বিষয়ে মধ্যস্থতা করেছেন, তাঁরাও সহজে স্বীকার করবেন না। এসব কারণে তদন্তের ফল নিয়ে সংশয় রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী আটক কোনো ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির করার কথা। এ দেশের জনমানুষ সব সময়ই মামলা-মোকদ্দমা, বিশেষ করে ফৌজদারি মামলা থেকে বিরত থাকেন। কারণ মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। আর রয়েছে পুলিশের রিমান্ডের ভয়। আর রিমান্ডে নিলে পুলিশের হাতে নির্যাতনের ভয়। এসব কারণেই যেকোনো মূল্যে আটক ব্যক্তি সহজে মুক্তি পেতে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে অন্য কারণ হলো, আদালতে গেলে প্রচুর অর্থ ব্যয় হবে। কাজেই থানা পর্যায়ে মুক্তিই একমাত্র সহজ পথ। বিগত কয়েক বছরে বিদেশি অর্থায়নে পুলিশ সংস্কারের সরব কথা আমরা শুনেছি। সংস্কারের মাধ্যমে মডেল থানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মডেল থানা মানে আদর্শ থানা, যা থাকবে দুর্নীতিমুক্ত এবং এ কারণে এটি হবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সহায়ক উৎস। অথচ প্রকাশিত খবরে মডেল থানায়ও দুর্নীতি হয়েছে, যা আশাব্যঞ্জক নয়। এ বিষয় নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পুলিশ অধিদপ্তরকে আরো ভাবতে হবে। অবশ্য বিগত কয়েক দশক ধরে পুলিশ অধিদপ্তরকে আর অধিদপ্তর বলা হয় না। এর নাম পরিবর্তন করে এখন বলা হয় পুলিশ হেডকোয়ার্টার। যেমন আছে সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে। তবে বলাবাহুল্য, সামরিক বাহিনী জনমানুষের সঙ্গে দৈনন্দিনভাবে যুক্ত নয়।
এ কথা নিঃসন্দেহে সত্যি যে বিশাল পুলিশ বাহিনীর সবাই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন। তবে আটক বাণিজ্যদুষ্ট জেলার দীর্ঘ তালিকা থেকে অনুমান করা সম্ভব যে দুর্নীতির মাত্রা অত্যাধিক। ৫ জানুয়ারির আগে ও পরে আন্দোলনরত ব্যক্তিদের আটক করার জন্য যে অভিযান চালানো হয়, তখনো এর যথার্থতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল। এর বিপরীতে পুলিশের পক্ষে বলা হয়েছিল যে আটক ব্যক্তিদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই গ্রেপ্তার করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় হাজারো মামলা হয়েছে। এ কথা মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হলেও এ কথাও জানা যায় যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তিকে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকার গঠন করাও হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের অর্থই হলো এফআইআর হয়েছে। তবে এ কথাও বলা হয়েছে, বেশির ভাগ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। কারণ তাদের নাম-ঠিকানা নেই। এ কথা যদি সত্যি হয় তাহলে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নিয়ে মামলা কেন?
৮ এপ্রিল অন্য একটি বাংলা দৈনিকের প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল প্রশাসননির্ভর আওয়ামী লীগ। এর এক অংশে বলা হয়েছে, দলের নেতা-কর্মীদের একটা অংশ সাংগঠনিক কাজের চেয়ে যেকোনো উপায়ে টাকা-পয়সা উপার্জনে বেশি মনোযোগী হয়েছে। ফলে কার্যকর হয়নি অনেক সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত। সাংগঠনিক ভিত মজবুত না হওয়ায় সরকার প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল। এতে আরো বলা হয়েছে যে 'উপজেলা নির্বাচনে দলের অনেক কর্মকাণ্ডে গোয়েন্দা সংস্থাকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায়ও গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করতে দেখা গেছে।' অন্য একটি সংবাদও একই দৈনিকে প্রকাশ করা হয়। এর শিরোনাম ছিল 'বিএনপিতে হতাশা'। উপশিরোনাম ছিল 'আটকে গেছে দলের পুনর্গঠন'। তৃতীয় খবরটি তথাকথিত সংসদীয় বিরোধী দলের। এর শিরোনাম ছিল "সরকার ও স্ত্রীর 'অনুকম্পা'নির্ভর এরশাদ।" সার্বিকভাবে বলা যায়, প্রধান দুই দলসহ তৃতীয় দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা এখনো রয়ে গেছে। সার্বিকভাবে বলা যায় যে রাজনীতিতে এখন বেহাল অবস্থা। এ অবস্থার জন্য সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলই কমবেশি দায়ী। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের পক্ষে ক্ষমতা সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এ কারণেই সুশাসন এখনো বহুদূরে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক বিদ্বেষ এখনো দূর হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় দুই দলের সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির এখনো অবসান হয়নি।
প্রশাসন শব্দটি ব্যাপক। একক প্রশাসন বলতে এখন কিছু নেই। কারণ প্রশাসনের এক অংশ রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। এর কিছু নজির উপজেলা নির্বাচনের সময় মিডিয়া প্রকাশ করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খবর ছিল পোলিং কর্মকর্তাদের জাল ভোটে অংশগ্রহণ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ব্যালট বাক্স ভর্তি করা এবং পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বহুলাংশে প্রতিদ্বন্দ্বিতাশূন্য ছিল। উপজেলা নির্বাচনের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য নয়। তবে মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর থেকে অনুমান করা সম্ভব যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ উপজেলা নির্বাচন ব্যাপক অনিয়মের ফলে কলুষিত হয়েছে। এসব নিয়ে বিদেশেসহ দেশের অভ্যন্তরে অনেক প্রশ্নই হয়েছে। এখনো হচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, এ অবস্থার অবসানের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার। এ শব্দটি একাডেমিক বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই ব্যবহার করেন। বাস্তবতা হলো, এ শব্দটি অনেকটা 'বায়বীয়'। শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু এর বাস্তব প্রয়োগ কঠিন। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের খুব একটা ভূমিকা নেই। কারণ প্রশাসনে কর্মরত ব্যক্তিদের ক্ষমতার প্রয়োগ বা ব্যবহার রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত। এর মধ্যেও কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা আইনকানুন মানার চেষ্টা যে করেন না, তা নয়। এর দৃষ্টান্তও অতীতে আছে। তবে বর্তমানে এ ধরনের দৃষ্টান্ত বিরল বা নেই বললেই চলে।
একুশে সংবাদ ডটকম/এমপি/১৩-০৪-১৪
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :