AB Bank
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

কবিতার দায়দব্ধতা


Ekushey Sangbad

০৮:০৫ এএম, এপ্রিল ২০, ২০১৪
 কবিতার দায়দব্ধতা

mmmmmmmmএকুশে সংবাদ : কবিতার দায় কবিতার অঙ্গীকার এসব কথা বেশ চালু আছে। আছে একটি সামাজিক দায় মেটানোর দাবি। তাকে আমরা দেখি বা না দেখি, স্বীকার করি বা না করি, সেটি পাঠকের দরবারে বেশ ঝেঁকেই বসে আছে।। সেই মোতাবেক প্রশ্ন আসে- কবিতা একটি শিল্প মাধ্যম হিসাবে আমাদের কাছে কীভাবে দায়বদ্ধ? আসলেই কি কবিতার কোনো দায়বদ্ধতা আছে? এটি কি শুধু ভাবের বিমূর্ত রূপ বা চিন্তা-কল্পনার অ্যাবসার্ড ভাষাখেলার শিল্প? নাকি এটি আমাদের মনে এমনভাবে দানা বাঁধবে যে আমরা বস্তুর দৃশ্যমান উপস্থিতি আর তার প্রকৃত বাস্তবতার মধ্য পার্থক্য আবিষ্কার করে, আমাদের জ্ঞানকে সত্য দৃষ্টি দিতে পারব। মানুষের মধ্যে তৈরি কৃত্রিম শ্রেণী বিভাজনের সত্যমিথ্যার ফারাকটা বুঝে উঠতে পারব। আমার ‘আমি’র অন্ধকার জায়গাটিকে আলোকিত করতে পারব বা সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও আন্তর্জাতিক শোষণ শাসনের দুষ্টায়নকে চিহ্নিত করতে পারব। পারব ইতিহাসকে পুর্নবিবেচনা করতে, সমাজের জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। পারব সাম্য আর ন্যায় ভিত্তিক একটি সমাজ তৈরি করতে। এদিক থেকে চিন্তা করলে দুটি পাঠক দলের কথা আমাদের মাথায় আসে। প্রথম দলটি কবিতাকে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ, স্বাধীন সত্তা ভেবে এর টেক্সটকে বিশ্লেষণ করে এর নান্দনিক মূল্যের উপর গুরুত্ব দেবেন, তাকে সৌন্দর্য-অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে তাৎক্ষণিক আনন্দ কুড়াতে চাইবেন। কবিতার আনন্দটি কবিতার ভেতরে ‘হয়ে ওঠা জগৎ’ থেকে পাবার চেষ্টা করবেন। আর দ্বিতীয় দলটি কবিতাকে কবির ব্যক্তিগত বোধ বা অভিজ্ঞতার বাইরে রেখে এর সাথে জড়িত সামাজিক বয়ান তথা এর মাঝে বাস করা সমাজ, সমাজের সাথে রাষ্ট্রের সাংঘর্ষিক সূত্র, এর শত্রুমিত্র চিহ্নিত করণের উপর গুরুত্ব দেবেন। দেখবেন এ-থেকে মানুষের বা সভ্যতার উপযোগী, মূল্যবান কিছু পাওয়া যায় কিনা। এই দুটি দলের বিশ্বাস কোনটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য- এটি বিচার না করেও বলা যায় শিল্প যেহেতু সময় এবং স্থান পরিবেশ ছাড়া বা ঐতিহাসিক পূর্বাপর সম্পর্ক ছাড়া এমনিতেই লিখিত হয় না, তাই এর নান্দনিক মূল্যের সাথে এর সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা আপনা আপনি চলে আসে। তাই কবিতা লেখা হয়ে যাওয়ার পর যখন এর পাঠমূল্য তৈরি হয় তখন লেখক-পাঠক সেখানে একটি প্রচ্ছন্ন ভ্রাম্যমাণ কোর্ট নিয়ে বসে থাকে। সেখানে ওরা কবিতার সৌন্দর্যতত্ত্বের সাথে ব্যক্তি-জীবনের প্রায়োগিক দিকটাকে বিচার বিশ্লেষণের আওতায় রেখে তাকে বন্দি করেন বা মুক্তি দেন। বন্দি করেন মানে এর ব্যবহারিক মর্যাদাটাকে তার অভিজ্ঞতার সাথে মিশিয়ে নেন- তাই এর কার্যকরি দিকটার গুরুত্ব বাড়ে। মুক্তি দেন মানে একে নিজের আর্কিটাইপ পঠন-অভিজ্ঞতা থেকে ছেড়ে দিয়ে একে শুধু ভাষা-খেলা বা শিল্পের কাছে শিল্পের দায়বদ্ধতা এমন আপাত সীমাবদ্ধ বিবেচনার কাছে সঁপে দেন। একটি কবিতা কেবলমাত্র যদি কবির খুব ব্যক্তিগত একলা একটি নির্জন বাড়ি সম্পকির্তও হয়, তাও হয়ত শেষ পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত অবস্থানের সাথে তার সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, তার অভ্যন্তরীণ ঈসথেটিক ভ্যালুর তার বাহ্যিক সংগ্রামমূহ প্রথমে বিমূর্ত, পরে বোধগম্য অবস্থায় একটি সাংকেতিক ভাষায় লিপিবদ্ধ হতে চায়। বাড়িটি যদি একটি স্মৃতি হয়ে থাকে বা একটি ধারণা হয়ে থাকে তা হলেও এর বাড়িবোধের সাথে সাথে এর বস্তুনির্ভরতা এর ভেতরের মানুষজনের সাথে সামাজিক সম্পর্কগুলো তার নানাবিধ মুখ মুখোশ নিয়েই উঠে আসে। কারণ আমরা এরকম চেতনার কবিতার ভাষা আমাদের সামাজিক জিনে নির্ধারণ করে নিয়েছি। একটি অদৃশ্য ভাষা লাইব্রেরি তৈরি করে নিয়েছি- যেখানে এই দায়বদ্ধতার মাস্টারেরা গোপন নির্দেশনা দিয়ে পাঠকের পাঠকত্বের কিছু ট্যাবু তৈরি করে দিয়েছে। তাই মানুষের সামাজিক ভূমিকার সুত্র ধরেই এখানে কবিতার টার্গেট-ভাষা পাকাপোক্ত হচ্ছে। আমরা হয়ত টেরও পাই না। আমাদের ব্যক্তিগত রুচি যাই থাকুক না কেন, এটি দায় দায়িত্বের পক্ষ বিপক্ষে থাকুক না কেন- এই দাবীর মুখটি মানুষের কৌমতাড়িত, ব্যবহারিক সত্য অভিজ্ঞতা হিসাবেই লুকিয়ে থাকে। অন্তত পক্ষে কিছু পাঠকের কাছে চিরদিন। একে আমরা পাঠকের রুচি বা পঠন-শিক্ষার অবমূল্যায়ন হিসাবে চিন্তা করে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারি। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে পাঠকের এই রুচি, শিক্ষা তাদের একটি পঠন-ঐতিহাসিকতাকেই নিদের্শ করে যা হাজার বছর ধরে আমাদের বাছ বিচারকে প্রভাবিত বা প্রতারিত করছে। তাই এটি আসলে পাঠকের মনোজগতের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা তার সামাজিক দায়বদ্ধ অবস্থানকেই চিহ্নত করে। সত্য যে বিশ্ব বাজার ব্যবস্থার আগ্রাসী বিস্তার আর প্রভাবের কারণে আমাদের মনোজগত আজ একটি করুণ ভোক্তায় পরিণত। আমার সামনে যা আছে আমি তার উপযোগিতা মান্য করি, তাকে কেজো বানানোর আশায় তার লাগা না লাগার সত্তায় বিচার করি। তাই দুভার্গ্যজনকভাবে কবিতাকেও এই ব্যবস্থার মধ্যে যেতে হচ্ছে। তাকে সম্পূর্ণ একটি কনজ্যুমার কালচারের মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু কবিতা তো এসব শুনবে না, পরওয়া করবে না। সে পাচিল ভেঙ্গে পালিয়ে আসবে বা পাচিলের উপরই ঘাস হয়ে জন্মাবে, জাগোয়ার হয়ে চাঁদকে হানবে। সামাজিকভাবে মানুষের অস্তিত্ব, কৌমবদ্ধতার সামুহিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক বা ভিনদেশি আক্রমণ ইত্যাদির কারণে কবিচৈতন্য যতই জর্জড়িত হোক না কেন। এতে কবিতার কোনো যায় আসে না। কারণ কবিতা রচিত হওয়ার পর তা একটা আলাদা সত্তা যা একান্তই কবির গোপন, সুপার কনশাসনেস থেকে বেরিয়ে আসে। মানে তার ভাষা একটি পর্দার আড়ালের ভাষা, তার ভাষা একরকমের ‘নাই’ভাষার মতোই যা ক্রমাগত ভাব ও ভাষার মধ্যে বিদ্যমান টেনশনকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য কখনো শূন্যতা কখনো সেই ‘গ্যাপ’কে ভরিয়ে তোলার জন্য সংকেত, চিহ্ন, শূন্যতার ভেতর দিয়ে কবি চৈতন্যকে যেতে হয়েছে। এর খবর কেউ রাখুক বা না রাখুক, এতে কেউ মাথা দিক বা না দিক এতে তার কোনো লাভ ক্ষতি হয় না। কিন্তু আসলেই কি তাই? মানুষের কবি-সত্তা কি এই সামাজিক, বাহ্যিক বস্তুরাশি, প্রতিষ্ঠান, সভ্যতা আচার আচরণ ছাড়া?সে কি রাজনীতি ছাড়া? সে কি এই চারপাশ ছাড়া, দোকানপাট ছাড়া, বাস ট্রেন ছাড়া? তার ‘আমি’ স্বভাব যে বিশ্বাস, অভ্যাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে- এইগুলির সাথে তার অন্য ‘কবি-আমি’র কি কোনো যোগাযোগ নাই? কবিকে যদি একটি রক্ত মাংসের মানুষ হিসাবে চিন্তা করা যায়, যদি তাকে এই বস্তু বাচকতার মধ্যখানে দাঁড়ানো আলাদা একটি সত্তা হিসাবে চিন্তাও করি, তাহলে তো তাকে তার যেমন ভেতর, তেমনিভাবে বাহির নিয়ে, তার সম্পূর্ণতাকে নিয়ে বিচার করতে হবে। কবি সচেতনে হোক আর অবচেতনে হোক, কবির গহীন সত্তা তার ব্যক্তিগত স্বাভাবিক গতি অগতি, তার সামাজিক দেয়া-নেয়া, চিন্তাচক্র থেকে দূরের নয়। সে যা ভাবে- যেখানে যা ভাবে, যে পরিস্থিতিতে ভাবে তার একটি অবয়ব আছে, আছে আকার ও আধার-বাটি। এটি ধীরে ধীরে একটি কবি সত্তার কাছে একটি আবছা প্রতিবিম্ব তৈরি করে। তাই হয়ত তার সৃষ্টি তার কাছ থেকে দূরের বা অ্যালিনিয়েটেড নয় একেবারে। কিন্তু পাঠককে এটিও আবার মনে রাখতে হবে যে কবিতার ভাষা সরাসরি কোনো সামাজিক ভাষা নয়, ‘চাঁদের আলো গলে গলে যায়’ বা ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়’ এই ভাষা নিয়ে আমরা সামাজিকতা করি না। কবিতা মানুষের কল্পনা ও শুদ্ধ চিন্তাজাত, অজানা অদেখা অপ্রতিষ্ঠিত কিন্তু সকল সম্ভাবনার একটি ভাষা-দরোজা। তাই কবির দায়, কবির কবিতা-ভাষার ঐতিহাসিক দায়িত্ব-ধারণা থেকেই আসে। কবি সামাজিকভাবে যে কাঠামোতে বেড়ে ওঠেন, যে ভাষায় কথা বলেন, যে দেশে তার অস্তিত্ব তার দেশ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় তার চেতনা(কনশাসনেস) গড়ে ওঠে। সেই মোতাবেক ফিলিস্তিনি কবির সাথে একজন ব্রিট্রিশ বা আমেরিকান বা জাপানি কবির, বাংলাদেশের কবির সাথে অস্ট্রেলিয়ার কবি এমন কি একই বাংলা ভাষার দেশ ভারতের পশ্চিম বঙ্গের কবির কবিতার চিন্তা, বিষয় এবং ভাষার মধ্যে একটি পার্থক্য থাকে। এখানে কবিতার ভাষা একটি ভূমিকা রাখে সত্য, কিন্তু ভাবের আগে ভাষা তো আসে না। যে ভাব আমার মনে দেশ কাল বিশেষ রাজনৈতিক বা সামাজিক মুহূর্ত সহকারে আগে থেকেই জিন্দা হয়ে আছে, আমার শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে আমার কবিচেতনায় দানা বাঁধে, তার হাত ধরেই তো একটি কবিতার ভাষা তৈরি হয়। বাংলা কবিতার ইতিহাসে অনেক কবিতা আছে যেগুলি এই দুটি সম্ভাবনাকেই একত্রে ধরতে পেরেছে। যেমন কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতাটির। এই কবিতাটির মধ্যে কবিতার দুটি সত্তাই— শিল্প ও সামাজিক দায়বদ্ধতা লতাপাতার মতো জড়িয়ে আছে। এটি যেমন কবিতার চরম শিল্প মূল্য- যেমন ভাষাগত ও টেকনিকের পরাকাষ্ঠা মিটিয়ে দিয়েছে ঠিক তেমনিভাবে এটি কবিতার সামাজিক দায়বদ্ধতার মোক্ষম একটি পাঠ হিসাবে তৈরি হয়েছে। বাংলা ভাষা তথা বিশ্ব কবিতার অঙ্গনে একটি মিলিট্যান্ট কাব্যভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু একটি গভীর পাঠে এই বিষয়টি শুধুই উপরের একটি আচ্ছাদন মনে হতে পারে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন একটি উপলক্ষ্য মাত্র, আসল কথা এটি একটি অ্যান্টি- পোয়েম। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রোমান্টিক পেলবতা ও আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তু আর আপাত সরল এক রৈখিক চিন্তা আর কল্পনার বিরুদ্ধে এটি শুধু অন্যন্য বিপ্লবী ধারার কবিতা হিসাবে দাঁড়ায়নি, এটি তখনকার কবিতাচিন্তা ও ভাষার বিরুদ্ধে একটি বিশেষ কবিতাভাব ও ভাষাযুদ্ধ। কবির সামাজিক ‘আমি’ যেমন আমরা মানে সমষ্টির আমি, তেমনিভাবে কবিতার ‘আমি’ মানে ভাষা-বিদ্রোহী, প্রতিষ্ঠিত ঠাকুর ভাষার উল্টা দিকে যার যাত্রার আর এক আমি। আবার মনে করুন জীবনানন্দ দাশের সেই ‘বোধ’ কবিতাটির কথা। আধুনিকতার প্রথম ‘শহীদ’ এই কবি যতই কবিতাকে আড়াল করে তার মরবিডিটি তার অনিকেতের সাধনা, মানুষের আস্তানা মানুষের সংঘ থেকে স্বেচ্ছা নিবার্সনের অবস্থানটির কথাটি বলতে চান না কেন, শেষ পর্যন্ত এটি মানুষের হারিয়ে যাওয়া সংঘবদ্ধতাকে ফিরে পাওয়ার বেদনাক্লান্ত অস্তিত্বকেই প্রকাশ করে। ‘মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!’ তিনি তার অন্যান্য লেখায় কবিতার সামাজিক মূল্যকে কবিতার শিল্পমূল্যর বিনিময়ে হীন মনে করতে চান না কেন- তার কবিতায় ঘুরে ঘুরেই এক হরানো মানবের কথা শোনা যায়। ধরুন সেই বিনাশি লাইন— ‘আলো- অন্ধকারে যাই— মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে! স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়— ভালোবাসা নয় হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!’ এরূপ সুপার-আমি তাড়িত আধুনিক মানুষের বিং অ্যন্ড নাথিংনেস জনিত অন্ধ কাতরতা থাকলেও কবিতাটি শেষ পর্যন্ত মানুষের ছিটকে পড়া কৌম-স্বভাবের কথাই হাজির করে। বিশ্বযুদ্ধজাত কু-রাজনীতি ও অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাবের কারণে মানুষের মহান ট্রাজিডির কথা, হেমলেটিয় সন্তাপ আর দ্বিধার নিচে চাপা পড়ে আছে মানুষ আর এই মানবতাড়িত সভ্যতার কাছে চলে যাবার চোরা আকুলতা। তার ‘বনলতা সেন’ কবিতায় হাজার বছর ধরে যে পথিক হেঁটে যায়- এটি আসলে কে? এটি যেন কোনো পয়গম্বর! তার পরম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে— পরমের সান্নিধ্য খোঁজার জন্য ঘুরছে ঘুরছে। মানুষের সাথে সেই পরমের বন্ধন প্রতিষ্ঠা কল্পে একটি আপাত শান্তিপথের সন্ধানে যাত্রী হচ্ছেন। যেখানে যেতে পারলে এই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া রুহ তার প্রার্থীত স্রষ্টার কাছাকাছি আসল পরম শান্তি খুঁজে পাবে। বনলতা সেন কী? বনলতা সেন একটি আইডিয়া, একটি আশা, মানুষের হারানো আর্থ-প্যারাডাইস- যা একটি নারীময়ী সত্তায় পৃথিবীর সবুজ কল্যাণঘর আর তার ভেতরে শান্তিবাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ তাকে খুঁজছে। পাগলের মতো। তাই আড়ালের আড়াল- কবিতার আসলে একান্ত নেগিটিভ বৈনাশিক কোনো আড়াল নাই, কবিতা সব সময় ভাব আর ভাষার হাতধরে, ভাষান্তরে ঘুরে ঘুরে তার কৌমের কাছে ফিরে আসে। ফিরে আসে সোনালি কাবিন নামে, আসাদের সার্ট হয়ে, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছকে পিছনে ফেলে চক্ষুষ্মান, সমাজবাদি মানুষের কাছে। তারপরও তো কথা থেকে যায়। কবিতার আর একটি চিকন ভেইন পাওয়া যায় তার শরীরে যেখানে সে একা একা আলো আঁধারিতে যায়, রৌদ্র করোটিতে বসে, কাফকার জামা পরে, মর্নিং গ্লোরি দেখে, নো ম্যানস জোন পেরিয়ে যায় - নিজেকে চেনার নিজেকে জানার আশায়। কোথাও সেই অস্তিত্ববাদী নায়কদের মতো পড়ে থাকে নক্ষত্রের নিচে- ঘাস হয়ে আকাশের ওপারে আকাশ হয়ে। কখনো নার্সিসাসের মতো নিজের প্রতিবিম্বের কাছে নিজেই আপ্লুত হয়, হয় বৈনাশিক। আমরা ভাবি এইগুলির অর্থ কী? এই আপাত প্যারাডক্স আসলে মানুষের স্বভাবজাত- সেই হাবিল আর কাবিলের মতো- এক দিকে শান্তি আর এক দিকে রক্তপাত। ‘এটি’ না ‘অন্যটা’ ইত্যাদি স্ববিরোধী ভাবনা হয়ে, ‌একটি ঝুলন্ত ধাঁধা হয়ে, আস্তে আস্তে নিজ অস্তিত্ব জানান দেবে এই কঠিন পৃথিবীর কাছে। এই যে পৃথিবী যেখানে বিশ্বজিৎ নামের বা এমন আরো তরতাজা যুবককে ঘাতকেরা চাপাতি দিয়ে মেরে ফেলে, বাসের মধ্যে কোনো এক অসহায় দামিনিকে পশুরা বলৎকার করে! তাই কবিতার নগ্নতা তো শুধুই শিল্প দিয়ে ঢাকা যাবে না। কবিতা সময় আর সভ্যতার ভাষা নিয়ে এক পাশ আগুন আর এক পাশ পানি নিয়ে আমাদের কাছে জেগে উঠবে। টি এস এলিয়ট ব্যক্তিগত আবেগ— যা কেবলই ব্যক্তির নিজের ভেতর থেকে অনায়াসে বের হতে থাকে, তার থেকে শিল্পকে মুক্ত করার কথা বলেছেন। বললেন- ওবজেক্টিভ কোরিলেটিভিটির কথা— নৈর্ব্যক্তিক সম্পর্ক স্থাপনার কথা যেখানে ব্যক্তি নয় ব্যক্তির চারিপাশের অবস্থাই বলে দেবে চরিত্রের মনোকথা। শিল্পি সাব্জেক্টিভ উৎসারণ থেকে যত সম্ভব দূরে থাকবেন। কিন্তু তার ‘লাভ সং অব আলফেড পুফ্রক’ থেকে তিনি কি তার নিজের ‘আমি’কে বাদ দিতে পেরেছেন? ফ্রুফকের সদা দ্বিধাগ্রস্ততা, বিষণ্নতা তথা আধুনিকতার শূন্যতা কি কবির নিজের নয়? বিশ্ব যুদ্ধের দানবিকতা, পরবর্তীতে চারিদিকে শিল্প নগরি নির্মাণের পর, মানুষের মানবিক অস্তিত্বকে ধুলায় মিটিয়ে দিয়ে তাকে যন্ত্র করার পাঁয়তারার ফলে ‌আধুনিক কবির মনে যে বিশাল শূন্যতা তৈরি হল- সেটি কি তিনি লুকোতে পেরেছেন? তার ওয়েষ্ট ল্যান্ড কি তার সেই সময়কার তার নিজের মনের ও চারিদিকের ধ্বংসস্তুপের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা জ্বলন্ত রিয়েলিটি নয়? তাই কবিতা শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি নৈর্ব্যক্তিক থাকে না। কবি-ব্যক্তির নিজস্ব আবেগ-আচরণ, তার চেতন অবচেতন— যা তার সামাজিক ও রাষ্ট্রিক তথা বিশ্ব কন্ডিশনের কাছে নিবেদিত- তাই যেন ধরে রাখে। রবীন্দ্রনাথ এমন একটি কবিতা কি লিখেছেন যেখানে কবির ‘আমি’ পরোক্ষভাবে হলেও আমাদের চারপাশ, সত্য চারপাশ, তার মূল্য তার দাবী নিয়ে ওঠে আসে নি? তার প্রেম প্রীতি দু:খ আনন্দবোধ বা সন্তসম ধ্যানে মানুষের শুভবোধকে দেখার চোখ— তার চারিদিকের মানুষজন, সমাজ, প্রকৃতি ও প্রতিদিনের ধুলোবালির গান তার কবি-ব্যক্তিটিকেই বার বার প্রকাশ করে। আমি এই যে একলা ঘরে একটি জলপোকা হয়ে আরাম করে বসে লিখছি, তার ভেতরে সত্য হয়ত নাই অতটুকু, যেমন পাথর ধরে পাথরের অস্তিত্বটুকু আগুনের মতো আঙুলে জ্বলে উঠল, যেমন সকালের সূর্য— সত্য একটি গ্যাসখণ্ড হয়ে আমার রোপকূপে আগুন জ্বালিয়ে ধরল। এসব অভিজ্ঞতা কবিতায় একেবারে নিরেট সত্য হয়ে ধরা দেয় না। তারপরও কবিতার এক একটি পংক্তিতে কি রক্তগন্ধ নাই? নাই আগুনের ভেতর পুড়ে যাওয়া হাড়ের ছাইগন্ধ? নাই কি সূর্যফোটা আর সূর্যগ্রহণের স্মৃতি? নাই কি পৃথিবীর এক অসভ্য মানুষের লোভ আর লালসার কারণে বাংকারে লুকানো একটি শিশুর প্রথম মৃত্যুরঙ? ঠিকই আছে। খালি চোখে দেখা যায় না এগুলোকে। ওরা আমার এই রক্তমাংসের আমি, আমার মায়ের গর্ভে প্রথম জন্মকলি ফোটার স্মৃতি নিয়ে কবিতার ‘হয়ে ওঠার’ সাথে মিশে থাকে। না হলে তো এটি একটি শব্দ হয়ে ওঠার কৌশল মাত্র, ম্যাজিক বাক্য হয়ে ওঠার চতুর ছল মাত্র। তখন আমার রচনা কি কবিতা হল- এই আমি আমার উপলদ্ধির সত্যকে ছাপিয়ে? কবিতার দায়বদ্ধতার মতো ভারি জিনিসটার কথা না তুল্লেও কবির সামাজিক বা ভূ-প্রাকৃতিক নীরব অঙ্গীকারের কারণে কবিতা শেষ পর্যন্ত শুধুই একটি শিল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না। কবির সৃষ্টিকাজ- কবিতা, তার মধ্যেই হয়ত লুকিয়ে থাকে সেইসব সম্ভাবনার সূত্রগুলি। কবিকে আমরা শেষ পর্যন্ত যদি মানুষ হিসাবে চিন্তা করে থাকি তাহলে কবির এই অবস্থানগত বসবাসের কারণে, কবিতায় তার রক্তমাংসজাত, তার আত্মগত উচ্চারণগুলি কবিতার শব্দ ধরে, কবিতার ডালপালার নিচে মানুষের জিনের মতো লুকানো অবস্থায় থাকে। কবিতা দিয়ে সমাজ পাল্টানো যায় না, কাউকে দেশপ্রেমিক করাও যায় না, কিন্তু তার ভেতরে জমে থাকা কবির মাটিচাপা খণ্ড খণ্ড আত্মদান দিয়ে, মানুষের মনকে একটি আয়নার কাছে দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়। একুশে সংবাদ ডটকম/এমপি/২০-০৪-১৪
Link copied!