নৌকায় আড্ডা
একুশে সংবাদ : বর্ষা। শব্দটির ভেতর যেন বৃষ্টিরানী লুকোচুরি করে। আকাশে পরীর মতো ডানা মেলে ঘুরে বেড়ায় মেঘ। কখনো অভিমানে টিপটিপ রিমঝিম, কখনো অঝোর ধারায় ঝড়ে বৃষ্টি। এসে যায় বর্ষা। গ্রামের মাঠ-ঘাট, খাল-বিল জলে থৈ থৈ, টইটম্বুর চারিদিক। নৌকা ছাড়া কোথাও চলাফেরা করা দায়। যে দিকে দুই চোখ যায়, সে দিকেই শুধু জল আর জল।
বর্ষা এলেই রিকু মাছ ধরে। কখনো বড়শি দিয়ে, কখনো জাল দিয়ে। এ সময় সে স্কুলে যেতে পারে না।
এবার বর্ষায় রিকুর মামাতো ভাই রকি ওদের বাড়িতে এসেছে। শহর থেকে তারা এসেছে গ্রামের বর্ষা দেখার জন্য। চারদিকে থৈ থৈ বর্ষার জল দেখে রকি মহাখুশি। কিন্তু তারপরও একটা জিনিসের জন্য তাদের মন খারাপ। জিনিসটি হলো নৌকা।
রকি নৌকায় ঘুরবে, মাছ ধরবে- তাহলেই না এই বর্ষায় মজা হবে। কিন্তু রিকুদের তো নৌকাই নেই।
আচ্ছা একটা নৌকার দাম কত?
প্রশ্ন করতেই রিকু বলে, কত আর হবে, দুই হাজার টাকা।
রিকুর কথা শুনে রকি নৌকা কেনার আবদার নিয়ে সোজা মায়ের কাছে হাজির হলো। সঙ্গে রবিন কাকাও অবশ্য ছিল। টাকা পেয়ে তারা নৌকা কিনতে চলল সূত্রধরপাড়া। একটু দেখেশুনে ছোট্ট একটা নৌকা কিনে ফেলল ওরা। সেই নৌকা নিয়ে রিকু আর রকি বের হলো স্কুলের উদ্দেশে। পথে নৌকায় তুলে নিল রাহা, রুমি, রতন, পন্টু, ঠান্টু এবং কানুকে। এই খুশি কী একা একা উপভোগ করা যায়!
রকিই প্রথম প্রসঙ্গটা তুলে বলল, আচ্ছা এখানে সবারই তো নৌকা নিয়ে কত স্মৃতি আছে, তাই না? সবারই কমবেশি নৌকা নিয়ে কিছু না কিছু ঘটনা আছে। সেগুলো মনে পড়ে যাওয়ায় সবাই হৈ চৈ করে উঠতেই নৌকা দুলে উঠল।
রিকু সবাইকে থামিয়ে বলল, নৌকা দুলছে। চুপ করে বয়। নইলে ডুবে যাবে।
কিন্তু কে শোনে সে কথা! নতুন নৌকায় উঠে সবাই বেশ উত্তেজনা অনুভব করছে। রাহা বলল, আমি আগে বলি। গত বর্ষায় আমার পিসতুতো বোন মুক্তি দিদির বিয়ে হয়েছে। দিদির বৌভাতে যাচ্ছি। পিসেমহাশয় নৌকা ভাড়া করেছে। উফ! কী যে আনন্দ লাগছিল আমার। অবশ্য একটু ভয় ভয়ও করছিল। কারণ নৌকাটা ভরে গিয়েছিল। প্রায় ডুবুডুবু অবস্থা। মাঝি অবশ্য অভয় দিয়ে বৈঠা চালিয়ে যাচ্ছে শক্ত হাতে। ফলে জল কেটে নৌকা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তরতর করে। আমি বাবার কোলে বসে আছি আর ভাবছি দিদিকে এখন দেখতে কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর করে বউ সাজিয়ে রেখেছে! ভাবতে ভাবতে কখন যে দিদিদের বাড়ির ঘাটে এসে পৌঁছেছি খেয়ালই করতে পারিনি। ঘাটে ধাক্কা লেগে হঠাৎ নৌকা দুলে ওঠায় আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল। কিন্তু ভয়াবহ ঘটনা ঘটল একটু পরেই। সবাই হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে নৌকা গেল উল্টে। বাবা আমাকে ধরে রেখেছিলেন তাই রক্ষা। তাছাড়া সেখানে খুব বেশি জল ছিল না।
রুবির গল্পটাও প্রায় একইরকম। ও বলল, গতবার বাবার সঙ্গে নৌকা বাইচ দেখতে গিয়েছিলাম কাচুর বিলে। আমাদের নৌকার সঙ্গে অন্য নৌকার ধাক্কা লেগে নৌকা ডুবে গিয়েছিল। পরে সাঁতরে পাড়ে উঠতে হয়েছে।
রতন বলল, আমি এবার অদ্ভূত একটা ঘটনা বলি। গত বর্ষার এক রাতে আমি আর গণেশ দাদা নৌকায় ঘুমিয়েছি। আমরা প্রতি রাতে নৌকা নিয়ে মাছ ধরতাম। রাত বেশি হলে নৌকাতেই ঘুমিয়ে পড়তাম। একদিন মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমাদের নৌকা ভাসতে ভাসতে সাধুর জঙ্গলে চলে এসেছে। অথচ আমাদের স্পষ্ট মনে আছে সেদিন রাতে নৌকা আমাদের বাড়ির পাশের ঘাটে বাঁধা ছিল। আমি আর দাদা তো এ ঘটনায় অবাক। কে এ কাজ করল? নিশ্চয় রণক আর কনক দুষ্টুমি করে নৌকার দড়িটা খুলে দিয়েছে। আর তা না হলে সাধুর জঙ্গলের ভূত এ কাজ করেছে। যাই হোক এই রহস্য আজো উদ্ধার করতে পারিনি।
রকি শুনেই চোখ বড় বড় করে বলল, খুব রহস্যময় ঘটনা তো। কিন্তু এ ঘটনা শুনে পল্টুর কোনো ভাবান্তর হলো না। উল্টো বলল, আরে এ তো কিছুই না। আমি তো মরেই গিয়েছিলাম।
সবাই চমকে উঠে বলল, কীভাবে?
পল্টু বলল, তোরা তো জানিস আমি সাঁতার জানি না। এখন এই আমি যদি ডুবে যাই তাহলে আমার কী হবে ভাবতে পারিস?
রকি অধৈর্য হয়ে বলল, আহা কী হয়েছিল সেটা বেলবি তো।
পল্টু রহস্যের হাসি দিয়ে বলল, কী আর হবে, নৌকা ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরও বেঁচে আছি দেখতেই পাচ্ছিস।
ঠান্টু নৌকার গলুইয়ে বসা ছিল। এবার ওর অভিমানী কণ্ঠ শোনা গেল- তোরাই বলে শেষ করলি, আমি বলব কখন?
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, বল শুনি।
উৎসাহ পেয়ে কানু বলতে শুরু করল, আমি একবার পেয়ারা চুরি করে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। তো কী আর করা! মায়ের বকুনি খেয়ে নৌকার মাচালের নিচে গিয়ে লুকিয়ে ছিলাম। পরে দাদু টের পেয়ে কান ধরে সেখান থেকে বের করে এনেছিল।
এবার রিকুর পালা। রিকু হাসতে হাসতে বলল, আমার তো অসংখ্য স্মৃতি। কোনটা থেকে কোনটা বলি? তবে যেটা না বললেই নয় সেটা বলছি :
যে ধরে নৌকার হাল
সে শালার শনে গাল।
আমি নৌকার হাল ধরে বসে ছিলাম তখন আমার পাশের বাড়ির দূর সম্পর্কের ঠাকুমা এই কথা বলেছিলেন। শুনে খুব রাগ হয়েছিল। আমি বুড়িকে উচিৎ শাস্তি দিতে রাতুলকে নিয়ে শয়তানি করে নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। বুড়ির যে তখন কী অবস্থা! বুড়ি এখনও আমাদের দেখলে তেড়ে আসে।
এবার রকির বলার পালা। কিন্তু রকি তো কখনও বর্ষা দেখেনি। নৌকাতেও সেভাবে ওঠা হয়নি। সুতরাং ও আর কী বলবে?
রিকু বলল, এই যে আজকের নৌকা ভ্রমণটাই তো তোর অভিজ্ঞতা। তুই আমাদের সঙ্গে আরও বেশ কিছুদিন থাক, তাহলেই দেখবি কত ঘটনা ঘটে গেছে।
নৌকা স্কুলের ঘাটে এসে ভিড়ল।
একুশে সংবাদ ডটকম/আর/২১-০৭-০১৪:
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :