AB Bank
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

আলো | মাহমুদুর রহমান


Ekushey Sangbad

০৫:৪৩ এএম, জুলাই ২৪, ২০১৪
আলো | মাহমুদুর রহমান

একুশে সংবাদ : “বউ, ও বউ” মজিদ মিয়া কিছুক্ষণ পরপর ডাক দেয়। তার ডাকে কোনো কাজ হয় না। আশেপাশে কেউ সাড়া দেয় না। সে আবার নতুন উদ্যমে ডাক শুরু করে— “বউ মা, ও বউ মা” বউয়ের সাথে মা শব্দটি যুক্ত হয়। সে ডাকছে তার বড় ছেলের বউকে। মা শব্দটি যুক্ত হওয়ায় কাজ হয়েছে। ছেলের বউ ফুলজান সাড়া দেয়— “কী হইছে, এই মাঝ রাত্তিরে ডাকেন ক্যান?” “বউ মা, বড় পেছছাব পাইছে। বাইরে যাবো। ঘরের আলোডা এটটু জ্বালায়ে দেও।” “আব্বা আপনে খুবই ত্যাক্ত করেন।” ফুলজান পাশের ঘর থেকে ঘুম চোখে বেরিয়ে আসে। তার চোখেমুখে রাজ্যের বিরক্তি। ঘরের বেড়ার সাথে লাগোয়া তাকে দেশলাইয়ের বাক্স খুঁজতে আর রাগে গজগজ করতে থাকে সে। “এই ঘরে কুনোকিছু ঠিক থাকে না। সব কিছুর পাঙ্খা গজায়। এক জায়গায় রাখলে আরেক জায়গায় উড়াল দেবে।” দেশলাইয়ের বাক্স পাওয়া গেছে। মজিদ মিয়া প্রস্রাব করা সেরে ফিরে আসে। আসার পথে ফুলজানকে বলে— “বউ মা, শরিফরে কইয়া আমার ঘরে একটা হারিকেনের ব্যাবস্থা করে দেও। বুড়া মানুষ রাতবিরাতে উঠা লাগে।” “আপনে কন আপনার ছেলেরে। সে কি আর আমার কথা শোনে। আমি কোনোকিছু কইলে সে তেলে বাগুনে জ্বলে ওঠে। দশটা উল্টা কথা শোনায়। কয়— কেরেছ ত্যালের লেটার এখন বাইশ টাকা। সারারাত হারিকেন জ্বালাইলে মাসে কয় লেটার কেরেছ ত্যাল লাগবে হিসাব কইরা দেখছো। সে আরও কয়— আব্বা তো খালি আমারে চিনছে তার ছোট পুলা মফিজরে তো সে কিছুই বলবেনা।” “সে হচ্ছে আমার বড় পোলা। বাপের কিছু লাগলে তো বড় পোলার কাছেই বলবে নাকি?” কার্তিক মাস। বাঁশের চাটাই দেয়া বেড়া। সেই বেড়ার ফাঁক গলে হুড়হুড় করে উত্তুরে বাতাস ঢুকে পড়ে ঘরে। এরই মধ্যে শীত আসতে শুরু করেছে। শেষরাতে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে। মজিদ মিয়ার শীত লাগে। ঘুম ভেঙে যায়। একবার ঘুম ভাঙলে আর সহজে ঘুম আসতে চায় না। রাতজাগা বড় কষ্টের। একটু পরপর প্রস্রাবের বেগ আসে। তখন আবার ডাক শুরু করতে হয়— “বউ, ও বউ আলোডা একটু জ্বালাও। বড় পেচ্ছাবের বেগ পাইছে।” আশপাশ থেকে কোনো সাড়া আসে না। সবাই গভীর ঘুমে অচেতন। বুড়া বয়সটা বড়ই যন্ত্রণার। কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। মজিদ মিয়ার তিন ছেলে মেয়ে। দুই ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলে ক্ষেত খামারে কামলার কাজ করে। ছোট ছেলে গঞ্জে এক গো-ডাউনে কাজ করে। সে তার বউ নিয়ে গঞ্জেই থাকে। মজিদ মিয়ার এই ভিটেটুকু মাত্র তিন কাঠার মতো। এছাড়া ডাঙায় বাপ তার বারো কাঠা ফসলি জমি করেছিল। বড় অভাবের সংসার। তিনবেলা খেতে পারাই এই সংসারে বড় কষ্টের। তারপরও মজিদ মিয়ার খুব ইচ্ছা রাতে তার ঘরে একটা হারিকেন জ্বালানো থাকুক। বুড়ো মানুষ। রাত-বিরাতে কতবার জাগতে হয়। বারবার কাউকে ডাকতে ভালো লাগে না। আজকাল তার অন্ধকার বড় ভয় লাগে। অন্ধকারে হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় পেছন থেকে কেউ এসে তার ঘাড়ে হাত রাখছে। সে চমকে ওঠে। পেছনে ফিরে দেখে কিছুই নেই। সে ডাক দেয়— “বউ, ও বউ আলোডা একটু জ্বালাও। ভয় লাগে। অন্ধকারে বড় ভয় লাগে।” এই অন্ধকার নিয়ে তার বড় ছেলে শরীফ মিয়ার কঠিন যুক্তি। অন্ধকাররে ভয় পাওয়ার কী আছে। খাঁ বাড়ির নিজাম খাঁ। সে তো অন্ধ বুড়া মানুষ। সে তো দিব্যি দিন কাটাচ্ছে। তার কাছে তো দিন রাত সবই আন্ধার। এখন সাদ্দাম-বুশ যুদ্ধ চলছে। সারা বিশ্বে জ্বালানি তেলের সংকট। বাংলাদেশেও পেট্রোল, ডিজেল কেরোসিনের দাম বাড়ছে। প্রতি হাটবারে লিটার প্রতি দুই টাকা করে দাম বাড়ে । সারাবাড়ি একটা মাত্র হারিকেন। সেটা বড় ঘরে রাখা লাগে। অন্তু মিয়া (মজিদ মিয়ার পোতা) কিছুক্ষণ পরপর ট্যাঁও ট্যাঁও করে কান্না কাটি শুরু করে। দুধ খাবার জন্য। দেখতে দেখতে শীত চলে এসেছে। তীব্র শীত পড়েছে এবার শুভদিয়া গ্রামে। মজিদ মিয়া দিনের বেলায় বারান্দায় বসে থাকে। শরীরে রোদের আলো পড়ে। চকচকে রোদের আলো। এই আলোতে বসে মজিদ মিয়া সুর ধরে। আল্লাহ পাকের কুদরত আমার বোঝা বড় দায় নবী ইব্রাহীম... মরুর বুকে বিবি পুত্র ফেলিয়া সে যায় কান্দে বিবি হাজেরায়, আমার বিবি হাজেরায়... তার সামনে একজন মাত্র শ্রোতা। আটমাস বয়স্ক অন্তু মিয়া। সে শুয়ে আছে। সেও কান্না শুরু করে। বিবি হাজেরার দুঃখে না। খিদায়। তার মা তাকে দাদার কাছে রেখে বাড়ির কাজ সারছে। মজিদ মিয়ার আসল কষ্টটা শুরু হয় রাতে। সে বুঝে উঠতে পারে না বৃদ্ধ মানুষের রাত এত দীর্ঘ হয় কেন? যৌবন কালের রাত কত ছোট ছিল। তার মনে পড়ে তার বউ সফুরা বেগম। কেবল নয়া বউ হিসেবে বাড়িতে এসেছে। সে তখন সন্ধ্যা রাতেই বাড়ি ফিরে আসতো। এসেই বলতো— বউ, ঘুম পাইছে। ভাত দাও। খাইয়া ঘুমাবো। এই নিয়ে বড় ভাবিসাব কতো হাসি তামসা করতো। “কী দেবর, বিয়ার আগে তো মাঝরাত্তিরে ঘুম আসতো। কৃষ্ণনগর থিকা পালাগান শুনে বাড়ি ফিরতা সেই কতো রাইতে। আর অহন দেখি সন্ধ্যার সময় ঘরের খিল লাগাও। একটু পর দেখি কুপিডাও নিভে গেছে। হা হা হা।...” কৃষ্ণনগর। এখানকার হিন্দু প্রধান একটি গ্রাম। যেখানে প্রায়ই যাত্রাগান, পালাগানের আসর বসে। নয়াবউ সফুরাকে পাশে নিয়া ঘুমাইলে এক নিমেষে রাত কাবার। আর এখন বুড়া বয়সের এক একটা রাত যেন সহস্র রজনী। এরকম এক শীতের রাতে মজিদ মিয়ার হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। বুকের ব্যথা বাড়ে। সে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে শ্বাস নিতে চেষ্টা করে। তবু সেই শ্বাস কিছুতেই তার বুক পর্যন্ত পৌঁছায় না। সে কাউকে ডাকতে চায়। মুখ দিয়ে শব্দ বের হয় না। প্রচণ্ড তেষ্টা পেয়েছে। সিথানের ডান পাশে মাটির কলসে পানি রাখা আছে। সে উঠে বসতে চেষ্টা করে। ঘরভরতি গাঢ় অন্ধকার। কৃষ্ণপক্ষ চলছে। সে ডানবাম কিছুই ঠাহর করতে পারে না। তার মনে হয় সে মারা যাচ্ছে। অন্যকোনো জগতে চলে যাচ্ছে। মজিদ মিয়ার জ্ঞান ফেরে শেষ রাত্রে। চোখ মেলে তাকায়। এখনও তার সামনে অন্ধকার। এইটা কবর নাকি। সে কি মারা গেল? তার গোসল জানাজা এইগুলা কখন হইলো। মুনকার নাকির কি এখনই আসবে? সওয়াল জবাব শুরু করবে! মৃত্যু আর বাস্তবতার মাঝামাঝি কোনো এক জায়গায় দোল খায় মজিদ মিয়া। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। মজিদ মিয়া বুঝতে পারে সে মরেনি। বেঁচে আছে। তার নিজের ভিতর কবরের ভয়টা প্রবল হতে থাকে। কবরে থাকবে বিস্তৃত এক গাঢ় অন্ধকার । সেই অন্ধকারে সবাইকে পড়ে থাকতে হবে। তবু একটা কথা মনে করে সে সান্ত্বনা পায়— মিত্তুর পরে তো কারো নিশ্চয়ই বারবার পেশাবের চাপ থাকবে না। নাকি থাকবে? শুভদিয়া জামে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে বিষয়টা জানা যেতে পারে। মাওলানা সাহেব বড় জানলেওয়ালা আলেম। তবে তার ধারণা কবরে কাউকে ডাকতে হবে না— “ও বউ, বউ আলোডা একটু জ্বালাও। বড় পেশাব লাগছে। কেমুন অন্ধকাররে বাবা। কিছুই তো দেহি না। ও আনিস, আনিস । বাজান কুপিডা একটু ধরাবি। পেশাব লাগছে তো।” একদিন মজিদ মিয়ার ছোট ছেলে গঞ্জ থেকে আসে। সাথে নতুন একটা হারিকেন আর তিন লিটার কেরোসিন তেলের একটা ক্যান। এসব কিছু তার বাবা মজিদ মিয়ার জন্য। সে তো বেজায় খুশি। প্রাণভরে ছেলের জন্য দোয়া করে দিলেন— “বাজান, বউ বাচ্চা নিয়া তুমি এই দুনিয়াতে সুখে শান্তিতে বাস করো। আল্লাহ তোমার আয় ইনকামে বরকত দিক। তোমার জন্য প্রাণ ভরে এই দুয়া করি।” মজিদ মিয়া তার ছেলেকে তুমি বলে সম্বোধন করে। কারো জন্য দোয়া করলে তো আর তুই বলা যায় না। ছোটছেলে মফিজ মিয়া এবার তার আসল কাহিনী শুরু করে— “হ, বাজান। সেই জন্যই তো আসছি। যেন আপনার বউ আর পোতাডা একটু ভালো থাকে সেই ব্যাবস্থা করার জন্য।” “বোঝলাম না , বাজান।” “বোঝবেন না ক্যান। আমাগে উত্তর ডাঙার বারো কাঠা জমি আছে না? অই জমিডার একটা বিধি ব্যবস্থা করেন। আর এই বাড়িতে তো আমরা থাকি না। বড় মিয়াই থাকে।” “কী কও বাজান, বাড়ির জমি আর কতটুকু, তিন কাঠাও হবে না। আর ওই বারো কাঠা জমি বড়মিয়া কইরা কাইটা দুইডা ফসল ফলায়। ওই জমিটুক আছে বলেই তো আমারে চাইরডা খাইতে দেয়। নাইলে তো পথে বইসা আমার ভিক্ষা করতে হবে।” “এইডা আপনে কী কন। আপনার বড় পোলা কি একাই আপনার পোলা আমি কি পোলা না?” বাপ বেটার মধ্যে কথা চলে। মাঝপথে যোগ দেয় বড় ছেলের বউ ফুলজান। “ও ছোড মিয়া, ভালই তো নিজেরটুক বোঝো। বুড়া বাপডারে তিন বেলা খাওয়ায় পরায় কেডা? এই বড়মিয়া। দুইমাস পর একদিন বাড়িতে আসো। বাপের জন্য দরদ তো একদম উতলায় পড়ে। আসলে কী জন্য আসো তাতো বুঝি।” শুধু ফুলজান না। পিতা মজিদ মিয়াও বুঝতে পারে। নতুন হারিকেন, ৩ লিটার কেরোসিনের মহত্ত্ব। এই ছেলেকেই সে একবার বলেছিল— আমারে একটা হারিকেন কিনে দে, আন্ধার বড় ডর লাগেরে বাপ। “এইডা কী কন বাজান, আপনার এখন অন্ধকার কব্বরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেবার বয়স। এখন যদি আপনে অন্ধকার ভয় পান তাইলে চলে!” মজিদ মিয়া মনেমনে বলে— আরে হারামজাদা পুলা, আমারে আধ্যাত্নিক কথা শোনাও। আধ্যাত্নিক কথা তোর পেছন রাস্তা দিয়ে ভরে দেওয়া দরকার। এই কথাগুলো সরাসরি বলতে পারলে তার মনটা ঠাণ্ডা হতো। এই বয়সে এসে এই দামড়া ছেলেকে সেটা বলা সম্ভব না। বড় হতেহতে মানুষ একটা সময় ছোট হয়ে আসে। মজিদ মিয়ার ঘরে এখন মিটমিট করে একটা হারিকেন জ্বলে। সে জেগে উঠলে হারিকেনের পাওয়ার বাড়িয়ে নেওয়া হয়। আবার শোয়ার সময় পাওয়ার কমিয়ে নেয়। কিন্তু সেই পাওয়ার কমানো বাড়ানো খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না। সাদ্দাম-বুশ যুদ্ধ চলছে। পৃথিবীব্যাপী জ্বালানি তেলের বিশাল সংকট। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ভালো না। জামাত-আওয়ামী লীগ একসাথে মাঠে নেমেছে । ভাইভাই হয়ে। গনতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য। দুইদিন পরপর শুভদিয়ার বাজারে মিছিল নামে। “খালেদা জিয়ার গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে।” মজিদ মিয়া গাইল পাড়ে— শালার বেটা শালারা, আগুন এত গদিতে জ্বালাইতে পারো। তাইলে আমার হারিকেনে আগুন জ্বলে না ক্যান? আয় আমার হারিকেনে আগুন জ্বালায়ে দিয়ে যা, হারামজাদা গুলান। ভর মাঘ মাসের রাতে শীতের প্রকোপ বাড়ে। মজিদ মিয়ার বারবার পেশাবের বেগ বাড়ে। প্রতি হাটবার লিটার প্রতি দুই টাকা করে কেরোসিনের দাম বাড়ে। একুশে সংবাদ ডটকম/আর/২৪-০৭-০১৪:
Link copied!