AB Bank
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

ফুলের ফসল | মেহেদী উল্লাহ


Ekushey Sangbad

১১:২৩ এএম, আগস্ট ১২, ২০১৪
ফুলের ফসল | মেহেদী উল্লাহ

একুশে সংবাদ : কোমরের দিককার মেরুদণ্ড সামনে বাঁকিয়ে শরীরের উপরের অংশ নিচতলার সিঁড়ির চিপায় ঢুকিয়ে মস্তক আরো অবনত করে কী জানি দেখে দিলদার। তারপর গুনতে থাকে, এক, দুই. তিন....আষ্ট— এভাবে। সেরকম একটা সময়ে, কোনো একটা সংখ্যা গুনতে যাবে আর ওমনি পেছনে এসে দাঁড়ায় দিলদারের স্যার অথবা এই বাড়ির মালিক ফখরুল ইসলাম। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকতা, সারাদিন বাসায় থেকে পত্রিকা মুখস্ত করেন। জানতে চাইলেন,‘কী গুনছো দিলু?’ দিলদার গোনা ছাড়ে না, তারপর আঠারো বলে গোনায় ইস্তফা দিয়ে পেছন ফিরে জানায়, ‘স্যার, মেটকুটির বাসার ছ্যাদা গুনি, এই বাসাটায় মোটমাট আঠারোটা ছ্যাদা আছে।’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ফখরুল সাহেব। তার আগে ধমক দেয় ‘থামো’ বলে। ‘ছ্যাদা’ মানে কী? ‘ছ্যাদা মানে ফাঁকা, মানে ছ্যা, ছিদ্র স্যার।’ উত্তর দেয় দিলদার। ফখরুল সাহেব দিলদারের মাকড়শার বাসার ছিদ্র গোনার কৌতূহলকে পাত্তা দিয়ে বলেন, ‘রাতে সময় করে গুনবে, এখন গাধাটা কোথায় গেছে খুঁজে বের কর।’ এই বাড়িতে গাধা একটাই, তাই খুঁজে পাওয়া সমস্যা না, বরং দিলদার অবাক হয়ে স্যারকে প্রশ্ন করে ‘রাতে আন্ধারিতে কিভাবে গুনবো স্যার?’ ‘মোবাইলে টর্চ নাই, টর্টলাইট?’ উত্তর দেয় স্যার। খুব খুশি হয়ে ‘আচ্ছা’ বলে গাধাকে খবর দিতে যায় দিলদার। গাধাটা হলো ফখরুল ইসলামের একমাত্র কন্যা সায়মা ইসলামের স্বামী রশিদ উদ্দীন। বাংলায় এম.এ। একাডেমিতে নামের শুরুতে ডক্টরেট হোল্ডার। বাসায় আরো বেশি কদর তার। শ্বশুরমশাইয়ের গাধা সম্বোধন শুনেই বোঝার বাকি থাকে না! ২. ফখরুল সাহেব পত্রিকার উনিশ নম্বর পৃষ্ঠার ৬ কলামে তখন, বেশ মনযোগ দিয়েই পাঠ করছিলেন। জামাই রশিদ উদ্দীনের কদম ধ্বনি শুনতে পেয়েও থামালেন না। দিলদারকে ছাড়া তিনি আগ বাড়িয়ে বাড়ির কাউকে কিছু বলেন না। কেউ কথা শুরু করলেই উত্তর দেন। রশিদ বললো, ‘আব্বা, ডেকেছেন?’ এবার ‘হু’ বলে চোখের আড়াল করলেন ৬ নম্বর কলামটা। ‘শোনো, বাসার সামনে আমি ত্রিভুজ আকৃতির একটা বাগান করবো। সামনে বর্ষা, সব গাছ বর্ষার হবে বুঝলে, বর্ষায় ফুল ফোটে যেগুলোতে; তুমি তার ম্যানেজার।’ বললেন ফখরুল সাহেব। জামাই জানালো, ‘কিন্তু আব্বা, আমি তো বেসিক্যালি বাংলাটা ভালো বুঝি, কৃষি না।’ ‘তোমাকে কৃষি বুঝতে হবে না, নার্সারিতে গিয়ে বললে ওরাই সব করে দিবে, গাধা কোথাকার, যাও আয়োজন করো গিয়ে।’ ধমক মারলেন তিনি। ‘জি আব্বা’ বলে চলে গেল রশিদ। কদিন বাদে বাদেই এরকম কিছু জিনিসের শখ জাগে ফখরুল সাহেবের। এই তো কদিন আগে, দিলদারকে ডেকে বলেছিলেন, ‘দিলু, একটা তেলাপোকা ধরে আন তো, গুনে দেখি কয়টা পা।’ দিলদার অবশ্য এ জাতীয় কাজে দেরি করে না। তবে করার আগে বেশির ভাগ সময় ফিসফিসায়। যেমন, তেলাপোকা ধরে আনার হুকুমের মনে মনে জবাবে সে বলেছিল,‘র্ধু বুইড়া, কোনো কাম নাই, তেলাপোকার পাও গোনবে!’ রোগটা দিলদারেরও হয়েছে। সে জন্যই কি সে মাকড়শার বাসার ছিদ্র গোনে? রাতে ছিদ্র গোনার সময় হয়তো বাসন্তিকেও তার প্রয়োজন হতে পারে। তাকে ডেকে বলবে, ‘বাসন্তি, মোবাইলে তো দেহি চার্জ নাই, ভাইজানের টর্চলাইটটা আনতো দেহি।’ বাসন্তি এই বাড়ির রাঁধুনি। আরো কাজ আছে তার— ঘর ধোয়ামোছা, কাপড় ধোয়াসহ নানান রকমের কাজ আর ভাইজানটা হলো রশিদ উদ্দীন। সে মাঝেমাঝেই ছাদে গিয়ে উপরের দিকে টর্চ মেরে আকাশে সিগনাল পাঠায়। স্ত্রী সায়মা ইসলাম প্রথম দিন অবাক হয়ে জানতে চায়, ‘এমন করছো কেন, র্টচ ফেলে কোথায়?’ ‘ডাকাত-ডাকাত খেলি, আগের দিনে কোনো বাড়িতে ডাকাত পড়ার আগে ডাকাতরা এভাবে টর্চ মেরে এক দল আরেক দলকে সিগনাল পাঠিয়ে জানাতো লাইন ক্লিয়ার, বুঝলে।’ এবাড়িতে কোনো মা নাই। সায়মা ইসলামের মা কানাডার একটা ইউনির্ভাসিটিতে পড়াতে গিয়ে আর আসেন নি। তখন সায়মার বয়স পনের। শোনা গেছে, ওখানে বিয়ে করেছেন তিনি, ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছেন সায়মার বাবাকে। অবশ্য এ নিয়ে এবাড়ির কারো মাথা ব্যথা নাই, সায়মার বাবার তো নাই-ই। সবার কাছে, এইটা উনার একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে ধারণা। উনি বিয়ে করবেন কি ছাড়বেন এটা তার একান্ত বোধগত ব্যাপার! ৩. রাতে জামাই এসে বললো, ‘আব্বা, নার্সারিতে গিয়েছিলাম।’ ফখরুল সাহেব জানতে চাইলেন, ‘বর্ষার কী কী ফুল পেলে?’ তার উত্তর, ‘দাঁড়ান আব্বা, নাম মনে থাকে না তাই লিখে নিয়ে এসেছি।’ তারপর ফরমাল প্যান্ট থেকে একটা কাগজের টুকরো বের করে পড়ে শোনায়— মালতীলতা, ঝুমকোলতা, হাউড্রেনজিয়া, গমফ্রেনা, মোরগঝুঁটি, দোপাটি, ইয়েলো কসমস, টিথোনিয়া, টোরেনিয়া, কলাবতী, বেলি, টগর, ভাদ্রা, গন্ধরাজ, বাগানবিলাস, জুঁই, শ্বেতরঙ্গন, অলকানন্দ, ফুরুস, জিনিয়া, রেইনলিলি, স্বর্ণাচাঁপা, বোতাম আর ফোর-ও-ক্লক ফ্লাওয়ার। এক নিঃশ্বাসে পাঠ করে শোনায়। এবার শ্বশুরমশায় জামাইকে একটা প্রশ্ন করে— আচ্ছা ড. রশিদ উদ্দীন, বলো তো ফোর-ও-ক্লক ফ্লাওয়ার কখন ফোটে? আমি কী করে জানবো আব্বা! আমি তো বাংলার ছাত্র। এজন্যই তুমি একটা গাধা। আমার মেয়েটা যে কী করে তোমাকে জুটালো! আরে, নামের মধ্যেই তো আছে উত্তর। ঠিক ঘড়িধরা বিকেল চারটায় ফোটে। শোনো, এইটা ছিল তোমার শাশুড়ির প্রিয় ফুল। আমিও জানতাম না, সে-ই আমাকে বলেছিল একবার। এর ফুল দেখতে কলমির মতো। তবে কলমির চেয়ে অনেক ছোট। ফুলের রং লাল, ম্যাজেন্টা, সাদা, হলুদ, কমলা, এমনকি মিশ্র বর্ণও হয়। ফুলে মৃদু সুগন্ধ আছে। এ ফুলের আকর্ষণ ততটা না। তবে সন্ধ্যায় যখন বেশির ভাগ গাছের ফুল শুকিয়ে যায়, তখন এর আদর বাড়ে। গোধূলি আলোয় অন্য রকম লাগে। অনেক বছর আগে একদিন এক গোধূলির আলোয় বাসন্তীরঙা এ ফুলসহ তোমার শাশুড়ি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। শুনে অবাক হয় রশিদ। শাশুড়ির প্রিয় ফুল-টুলে না। আসলেই কি চারটায় ফোটে! লাগানোর পর একদিন দেখবে। ফখরুল সাহেব আরো জানতে চান— আচ্ছা, ওই যে বোতাম বললে, এর আগে পরে কিছু নেই? জি না আব্বা। তুমি আসলেই একটা গাধা। বোতাম তো শার্টের বোতাম, শুধু বোতাম কি কখনো ফুলের নাম হয়! বলো যে, বোতামফুল। এখন ভাগো সামনে থেকে। ফখরুল সাহেবের এমন নির্দয় আচরণে মোটেও অবাক হয় না রশিদ। সে জানে, টুকটাক এসব ধমক দিলেও রাতে ঠিকই খাওয়াপাতে বসে আদর করবে তাকে। তার কন্যার চেয়েও বেশি আদর করে পাতে মাছের বড় টুকরোটা তুলে দেবে। ড. রশিদ উদ্দীনের অবশ্য জানা নাই, সে যে থাকে এইটাকেই ঘরজামাই বলে কি-না? সে, তারা তো থাকে, এই থাকছে, অসুবিধা নাই। শ্বশুরই জোর করে রেখে দিয়েছে। এতবড় বাড়িতে তিনি একা তাই মেয়েকে ছাড়তে নারাজ। শুরুর দিকে একদিন বিদ্রোহ করে বসে রশিদ। গিয়ে বলে, আব্বা আমরা আলাদা হয়ে যাই। এখানে থাকতে কেমন যেন শরম করছে। জবাবে শ্বশুর বলেছিল, ‘শোনো, সব সময় মনে রাখবে কথাটা, তুমি হচ্ছো মাথা আর আমার মেয়ে হচ্ছে কান। কান এই বাড়িতেই থাকবে, আমার সঙ্গেই থাকবে, এবার মাথা তুমি কোথায় যাবে যাও।’ তারপর থেকে টু-শব্দও করে নি এই নিয়ে রশিদ উদ্দীন। থেকে যাচ্ছে মিলজুলে। ৪. দুপুরটা ছিল চৈত্রের শেষদিকের। দিলদার প্রচণ্ড রোদের মধ্যে বাগানের জন্য ত্রিভুজ আকৃতির ছক কেটে এখন কোদাল দিয়ে মাটি কাটছে। দিলদার কাজটা সকালেও করতে পারতো। কিন্তু তার স্যারের নির্দেশ, ‘শোন দিলু, বাগানের মাটি ঝুপড়া করবি দুপুরের কড়া রোদের মধ্যে। আমি তিনতলার বারান্দায় বসে দৃশ্যটা দেখবো।’ দিলদার জানে, বুইড়ার সাথে অমত করে লাভ নাই। তাই কোদাল চালাচ্ছে। হঠাৎ এদিকেই দৌড়ে আসলো বাসন্তি। স্যার উপরে বসে সব দেখছে তাই আস্তে আস্তে একটু আড়ালে থেকে তাকে হুকুম দিলো— আস্তে কোপা হারামজাদা। ক্যান? তুই জানস না! দিলদার বিষয়টা জানে এমন একটা ভাব করে সে এবার আস্তে আস্তে কোপাতে থাকে। বাসন্তি বলে, ‘এই বার ঠিক আছে। এমনে আস্তে আস্তে কোপা।’ ওই দিকে আস্ত একটা টিপের পাতা গায়েব। এর আগেও একদিন একটা গোলাপি রঙের লিপস্টিক হাওয়া। তাই না পেয়ে বাসন্তিকে ডাকতে থাকে সায়মা ইসলাম। বাসন্তি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে যায়। আর দিলদার নিচেই থাকে। ৫. বিকেলের দিকে ঘরে ফুলের আসর বসে। শুরুতে রশিদ উদ্দীন শ্বশুরের কাছে জানতে চায়, আব্বা, বড় ঝোঁপালো গাছগুলো কিনারে দিই, আর মাঝে মাঝারিগুলো আর এর তিনদিকে ছোটগুলো লাগাই। গাছ দিয়ে গেছে নার্সারি থেকে। কাল-পরশু লাগানো যাবে। ফখরুল সাহেব জবাব দিলেন, ‘তোমার ইচ্ছা মতো লাগাও। স্ত্রীর হেল্প নাও প্রয়োজনে।’ স্ত্রীর হেল্প চাইলে নিশ্চিত সে তাকে ঝাড়ি দেবে এমন আশঙ্কায় দিলদারের কাছেই জানতে চায় রশিদ, ‘তুমি কি বাগানের কোনো ডিজাইন পারো?’ দিলদার আর বাসন্তি নিচে বসেছে গা জোড়া দিয়ে। সে জানায়, ‘জি ভাইজান, আমি ফুলগাছ দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকতে পারি। দেশের বাড়িতে থাকতে একবার করছিলাম। অভিজ্ঞতা আছে।’ শুনে রশিদ উদ্দীন হাতে থাকে স্মার্টফোনটা খোঁচাতে খোঁচাতে মিচকি হাসি হাসে। আর কথা আগায় না দিলদার। এবার শ্বশুরই কোশ্চেন ধরে জামাইকে। দিলদার মনে মনে ভাবে, ‘শালা গাধা গর্তে পড়ছে এইবার।’ ফখরুল ইসলাম প্রশ্ন ধরে জামাইকে। জানতে চায়— ফুল নিয়ে কোনো কবিতা জানো ড. রশিদ উদ্দীন। জ্বি আব্বা জানি। ওই যে, জোটে যদি মোটে একটি পয়সা, খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি, দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার, ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী! লিখেছেন ছন্দের জাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। জন্ম ১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২, মৃত্যু ২৫ জুন ১৯২২। বাহ! বেশ বেশ। তোমার শাশুড়ির আরেকটা প্রিয় ফুল ছিল, অলকানন্দ। বলো তো, এই ফুলের নিবাস কোথায়? আমি কী করে জানবো আব্বা! আমি তো বাংলার ছাত্র। আহ্, এটা জানতে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্র হতে হয় না। এই ফুলের নিবাস ব্রাজিলে। ফুলটি দেখতে ঠিক ঘণ্টার মতো। আর এ কারণেই এই ফুলকে অনেকে ‘ঘণ্টাফুল’ বলেন। বর্ষা এলেই ফুলে ফুলে ভরে যায় গাছ। এবার মেয়েকে একটা কোশ্চেন ধরে বাবা। জানতে চায়— আচ্ছা, তুই বলতো মা, ঝুমকোলতার বাড়ি কোথায়? আমি কী করে জানবো বাবা! আমার ব্যাংকে তো তার কোনো একাউন্ট নাই। তুইও একটা গা, থাক। আরে, সে কি পয়সাওলা যে, তার একাউন্ট থাকতে যাবে। তারও আদি নিবাস ব্রাজিলে। এসব ফুল এ দেশে কিভাবে এলো সে এক রহস্য বটে! একেক জন একেক কথা বলে। কেউ বলে অতিথি পাখি নিয়ে এসেছে। আবার কেউ বলে ব্রিটিশ, পর্তুগিজ বা ফরাসিরা এনেছে। সে যাই হোক, ফুলের ব্যাপারটাই আলাদ। ফুল তো! যেভাবেই তা আসুক। আসর ভাঙার আগে ফখরুল ইসলাম জামাইকে একটা উপদেশ দিতে ছাড়লেন না। তিনি বললেন, ‘এই যে পিএইচডি হোল্ডার, আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, আপনি দুই এক দিনের মধ্যে একটা বই কিনবেন, নাম বাংলার ফুল। লিখেছেন মাহফুজুর রহমান। ফুল বিষয়ে অনেক শেখার আছে। ‘জি আব্বা’ বলে সায় জানালেও রশিদ উদ্দীনের মাথায় ঢোকে না, নার্সারি থেকে যে ফুলগাছগুলো এনেছে তার নিরান্নবই ভাগই বিদেশি, বাংলার ফুল দিয়ে কী করবে সে? যাই হোক, আসর ভেঙে গেলে থাকে শুধু দিলদার আর বাসন্তি। বাসন্তিও মাঝে মাঝে দিলদারকে একটা কোশ্চেন ধরে। একটাই প্রশ্ন তার দিলদারের কাছে। আজও করলো— ফরিয়াদ জানাইছিস স্যারের কাছে? না, আমি পারবো না, আমার হাটু কাঁপে। তুই তো স্যারকে ডরাইন্না মানুষ না, ঘটনা কী ক। কোনো ঘটনা নাই, আমার হাঁটু কাঁপে। না বলতে পারলে আর কি করবি, থাক্, এইবাজে। ফিসফিসানি তো ভালোই পারস! ৬. আষাঢ় চলে যায়, শ্রাবণ আসে। নার্সারির অধিকাংশ গাছেই ফুল ফুটতে শুরু করেছে। ফখরুল ইসলাম তিনতলার বারান্দা থেকে চা খান আর ফুল দেখেন। তেমনই এক সকালে কেউই আর বাড়িতে দিলদার আর বাসন্তিকে খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে রশিদ উদ্দীন শ্বশুরকে বলে, ‘আব্বা, বাগানে, বাগানের মাঝখানে ইয়া বড় একটা গর্ত। পুরাতন কবরের মতো সুড়ঙ্গ। ভয় লাগছে আব্বা আমার। এদিকে দিলু আর বাসন্তিকেও পাওয়া যাচ্ছে না।’ ফখরুল সাহেব শান্ত স্বরে জানতে চাইলেন, ‘গর্তের সাথে ওদের সম্পর্ক কী?’ জানি না আব্বা। যাও। নিজের ঘরে যাও, দেখো তোমার স্ত্রীটি আছে কি-না? ‘জি আব্বা’ বলে চলে গেল রশিদ উদ্দীন। থানায় সাধারণ ডায়রী করবে কিনা ভাবছে ফখরুল ইসলাম। ৭. সেদিন সন্ধ্যার দিকেই ফিরলো দিলদার আর বাসন্তি। বাসন্তির মাথায় একটা বড় বস্তা। কেউ তাদের ফিরতে দেখে অবাক হলো না। যেন খুব স্বাভাবিক ঘটনা এইটা। ফখরুল সাহেবকে দু’জনেই পায়ে ধরে সালাম করলো। তারপর বসলো পায়ের কাছে, বস্তাটা আলগোছে পাশে রাখলো বাসন্তি। ফখরুল সাহেব জানতে চাইলেন দিলদারের কাছে। ‘দিলু বস্তায় কী?’ এই বাড়ির একমাত্র মানুষ, যার সঙ্গে কি এক অজ্ঞাত কারণে তিনি আগ বাড়িয়ে কথা বলেন। সেটা এক রহস্য! দিলুও জানে না কেন। দিলু জানালো, ‘আমি নিষেধ করছিলাম বাসন্তিরে, সে শুনে নাই। বস্তায় কাপ-পিরিচ-চামচ-থালা-বাসন-দা, টিপ, কাজল, লিপস্টিকসহ আরো অনেক জিনিস! খুলে দেখাই স্যার?’ না ঘটনা বুঝতে আর কারোই বাকি নাই। বাসন্তি জমিয়েছে বস্তায়— তাদেরই ঘরের জিনিস সব। একেকদিন একেকটা নিয়ে বাগানটা যেই জায়গায় করা হয়েছে ঠিক তারই মাঝখানে মাটির নিচের বস্তায় রেখে আসতো বাসন্তি। এক বছর আড়াই মাস আগ থেকে জমাচ্ছিল। তখন তো বাগান ছিল না, এমনি মাটির তল, দুই-তিন হাত নিচে বস্তার মুখ। বস্তাটার শেষপ্রান্ত আরো গভীরে ছিল। কেউ আর কোনো কথা বললো না। সবাই অবাক, কিন্তু গেলই বা কেন, ফিরেই আসলো কেন তারা! বিরাট রহস্য, অথচ কারো মধ্যেই এর কুলকিনারা করার টেনশন নাই। মাটির নিচের বস্তায় বাসন্তি সংসারের টুকিটাকি জমিয়েছিল— চারদিকে কত খরচ, সবকিছুতে কুলিয়ে উঠবে না তাই। বাসন্তি দিলদারকে বলেছিল, বিয়ের বিষয়ে স্যারের কাছে ফরিয়াদ জানাতে। কিন্তু, দিলদারের হাঁটু কাঁপার কারণে সে বলতে পারেনি, উল্টো ডরাইছে সে, বিয়ে করলে যদি বাড়িতেই থাকতে না দেয়। শেষে সব ডর ভয় কাটিয়ে তারা পালিয়ে বিয়ে করেছে ঠিকই, কিন্তু অবশেষে ফিরেও এসেছে। এই সংসার ছেড়ে নিজেদের সংসার করতে ভাল্লাগবে না তাদের। সন্ধ্যা বাড়ছে। বাইরে শ্রাবণধারা। বাগানের ফোর-ও-ক্লক ফুলগুলো কাঁপছিল।  
Link copied!