‘বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে সম্ভাবনা বিপুল, চ্যালেঞ্জও অনেক’
একুশে সংবাদ : এ. এস. এম. রাকিবুল হাসান (শামীম) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিল লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক। স্পিনিং ছাড়াও, ওয়েভিং, ডায়িং ও তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে যুক্ত তিনি। অর্থসূচককে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে তুলে ধরেছেন সামগ্রিক বস্ত্র খাত সম্পর্কে তার মূল্যবান অভিজ্ঞতা।
আমাদের এ খাত ও দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থে আমাদের ইমেজকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এটি সম্ভব হবে সারকার ও মালিক উভয়ের সমন্ময়ে। আর সেটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্চ। তবে দেশের স্বার্থে এই চ্যালেঞ্চগুলো আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। তিনি বলেন, এটি করতে হলে আমাদের রুট লেবেল থেকে কাজ করতে হবে।
দেশের বস্ত্রখাত কেমন করছে। স্পিনিং, উইভিং এবং তৈরি পোশাক- সব মিলিয়ে কেমন অবস্থা এ খাতটির?
শামীম: এক কথা বলা যায় দেশের বস্ত্র খাত একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। এমনিতেই মৌসুমটা ধীর গতির। এ সময়ে ক্রেতাদের অর্ডার কম থাকে। তারওপর গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা, রানা প্লাজা ধস, বাংলাদেশের বস্ত্রখাত বিরোধী প্রচারণা ইত্যাদি এ খাতে তীব্র প্রভাব ফেলেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কারখানা পরির্দশনের বাড়বাড়ি, শ্রমিক সংগঠনগুলোর দায়িত্বহীন আচরণ।
এসব কারণে পোশাক কারখানাগুলোতে অর্ডার বেশ কম। গত মাসে ওভেন পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। নীট পোশাকে প্রবৃদ্ধি হলেও হার খুবই নগন্য।
তার প্রভাব রয়েছে স্পিনিং এবং ওয়েভিংয়েও। অনেক কারখানা এখন উৎপাদন ক্ষমতার ৫০ ভাগও ব্যবহার করতে পারছে না।
তাহলে এ খাতের ভবিষ্যত কি তেমন ভালো নয়?
শামীম: না, আমাদের বস্ত্র খাতের ভবিষ্যত অনেক ভালো। বলা যায়, এখনও দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত এটি। তবে চ্যালেঞ্জও অনেক। পর্যাপ্ত অবকাঠামো, নীতি সহায়তা ও অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে এ খাতটি অর্থনীতিতে বিপুল অবদান রাখতে পারবে। কিন্তু ‘বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে আমাদের বিকল্প নেই’-এমনটি ভেবে আয়েস করলে সম্ভাবনা তো কাজে লাগানো যাবেই না, উল্টো পরিস্থিতি আরও নাজুক হতে পারে।
বিপুল জনশক্তি, সাশ্রয়ী শ্রম ইত্যাদি কারণে আমাদের কিছু বাড়তি সুবিধা আছে ঠিকই। তবে তারপরও আমাদের জায়গা দখল করার মতো দেশ আছে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে শ্রীলংকা, মায়ানমারের মতো দেশ। অনেক বস্ত্র খাতের সুবিধা নিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। খোদ বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে। দেওয়া হচ্ছে নানা ধরণের প্রণোদনা।
বিকল্প উৎস আছে বলেই গত বছর রাজনৈতিক অস্থিরতায় ফিরে যাওয়া অর্ডার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও আর দেশে আসেনি।
আমরা আশা করছিলাম রাজনৈতিক অস্থিরতা চলে গেলে আমরা কাজের চাপে নিঃশ্বাস ফেলতে পারবো না। আমরা চিন্তা করছিলাম অফ সিজন বলতে কোনো কিছু থাকবে না। সময় মতো মাল দিতে পারি নাই, সময় করে এসে তারা নিয়ে যাবে। তারা কিন্তু আসেনি। তার মানে কী ক্রেতা তাদের ব্যবসা বন্ধ রেখেছে? মোটেও তা নয়, তারা তাদের প্রয়োজনীয় পোশাক কোনো না কোনো জায়গা থেকে তৈরি করিয়ে নিচ্ছে।
তাহলে কী আমাদের হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিতে হবে? না, মোটেও তা নয়। বস্ত্র খাতের সবচেয়ে বড় উৎপাদক চীন আমাদের জন্য একটা আশির্বাদ হয়ে উঠছে। দেশটিতে শ্রমিকের মজুরি অনেক বেড়ে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা কারখানা স্থানান্তর করছে। অন্যদিকে তারা সাধারণ বস্ত্র ও পোশাকের পরিবর্তে বেশি মূল্যসংযোজনশীল পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন। এটা অন্যদের জন্য তৈরি করছে নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা।
চিনের বাজার ছোটো হয়ে এলে সেগুলো কোন দিকে মুভ করবে?
শামীম: এ অঞ্চলে বস্ত্র খাতে সম্ভাবনাময় দেশ হলো চারটি, বাংলাদেশ, পাকিস্থান, শ্রীলঙ্কা এবং ভারত। আমি মনে করি আমাদের সম্ভাবনাই বেশি। আমাদের রয়েছে বিশাল শ্রমশক্তি। তবে এ শ্রমগোষ্ঠিকে শিল্পের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। শুধু সাশ্রয়ী মজুরীর উপর ভরসা রাখলে চলবে না। কারণ এমনিতে মজুরি বিবেচনা করলে বাংলাদেশে অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের চেয়ে কম। কিন্তু দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বিবেচনায় এখানে শ্রমিক কিন্তু যথেষ্ট কস্টলি।
ধরুণ আমাদের দেশে একজন শ্রমিককে ১০০ ডলার দিচ্ছি। অন্যদেশে ২০০ ডলার দিচ্ছে। আউটপুটে আসুন। সেখানে আমরা যে পরিমাণ আউটপুট পাই, তার তুলনায় তারা কয়েকগুণ বেশি পায়। আমরা একজন হেলপার দিয়ে শুরু করি। এরা সাধারণত দরিদ্র হয়। সে কিন্তু প্রচুর পণ্য ও কাঁচামাল নষ্ট করে। একজন অদক্ষ শ্রমিক ২০পিস কাপড়ও নষ্ট করে ফেলতে পারে। প্রতি পিসের দাম ৫ ডলার হলেও ২০ পিসে ক্ষতি হচ্ছে ১০০ ডলার। তাহলে কিন্তু আমাদের দাম অন্যদেশের তুলনায় বেশি পড়ে।
পাশাপাশি এখানে গ্যাস-বিদ্যুত, সড়ক, বন্দরসহ অবকাঠামোগত নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের দেশে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। এসব সমস্যার সমাধান করা গেলে চিনের বেনিফিট আমরা নিতে পারবো।
শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আপনারা কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
শামীম: আমরা এদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কাজ করতে পারি না। কারণ শিখানোর পর তাদেরকে নিজের মতো কাজ করানো যায় না। তারা কিছু টাকা বেতন বেশি নিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। আমরা শুরু করেছিলাম। কিন্তু কন্টিনিউ করতে পারিনি। ব্যক্তি পর্যায়ে না করে যদি বিজিএমইএ থেকে করা হয় তাহলে এটির ভালো আউটপুট পাওয়া যাবে। সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়িয়ে সেখানে মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
তৈরি পোশাক শিল্পে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পরিদর্শন কার্যক্রমকে নতুন সংকট হিসেবে দেখছেন অনেকে। আসলেই কি তা? এ ক্ষেত্রে আমাদের করনীয় কী? আপনাদের কারখানার কোনো সমস্যা আছে?
শামীম: বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর ভবন নিরাপত্তা ও নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উত্তর আমেরিকার ক্রেতা জোট অ্যালায়েন্স ফর ওয়ার্কার্স সেফটি ইন বাংলাদেশ (অ্যালায়েন্স) ও ইউরোপের ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ (অ্যাকর্ড) কারখানা পরিদর্শন করছে। বিদেশি ক্রেতারা কারখানা পরিদর্শন করে পোশাক শিল্পে অগ্নি, বিদ্যুৎ ও ভবন নিরাপত্তা ইস্যুতে কাজ করছে। এটি ভালো। এতে আমাদের করনীয় হলো তাদেরকে সহযোগিতা করা। তাদেরকে সহযোগিতা করে আমাদের অবস্থান তাদের কাছে তুলে ধরতে হবে। আমাদের কোনো ধরনের সমস্যা নেই।
প্রতিযোগী দেশগুলোতে পণ্য মূল্য বেড়ে গেলেও আমরা কিন্তু ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি মূল্য নিতে পারছি না। অনেক কম মূল্যে পোশাক সরবরাহ করতে হচ্ছে। এই না পারার কারণ কি?
শামীম: ক্রেতাদের মানসিকতার অবস্থা এমন, যে বাংলাদেশে কম দামে প্রোডাক্ট পাওয়া যায়। আর এটার জন্য দায়ী আমরা। আমরা এ অবস্থা তৈরি করেছি। আমরা তাদের কাছ থেকে ভালো দাম নিতে পারি না। আমাদের অনেকের পণ্যের মান খারাপ। যার প্রভাব পড়ে সবার ওপর পরে।
দর কষাকষির করার সক্ষমতার ঘাটতিও অনেক। বেশিরভাগ কারখানায় এ বিষয়ে যোগ্য ও পেশাদার লোকের অভাব আছে। তাই তারা সঠিকভাবে দরকষাকষি করতে পারে না। বরং মূল্য কমিয়ে দিয়ে অর্ডার পাওয়ার চেষ্টা করে। এতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। এর সুযোগ নেয় চতুর ক্রেতারা।
বস্ত্রখাতের বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে মোজাফফর হোসেন স্পিনিং অন্যতম। আপনাদের কোম্পানি কি কি ধরনের পণ্য উৎপাদন করে, উৎপাদিত সুতার কোনো বিশেষত্ব আছে কি?
শামীম: আমরা বিভিন্ন কাউন্টের সুতা উৎপাদন করে থাকি। তবে উৎপাদিত সুতার বিশেষত্ব হলো ম্যানেজমেন্ট টাচ। ক্রেতারা যে প্রোডাক্টি কেনেন তাতে ম্যানেজমেন্টের হাতের ছোঁয়া থাকে। অর্থাৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে সব জায়গায় আমরা নিবিড় মনিটরিং করি। ফলে যে প্রোডাক্ট বের হচ্ছে সেটাই গুনগত মানের বেড় হচ্ছে। আমাদের দক্ষতার স্তরটি অনেক উচুঁতে।
একুশে সংবাদ ডটকম/আর/১৬-০৮-০১৪:
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :