মা–বাবার প্রতীক্ষায়...
একুশে সংবাদ : তিন বছরের রাকিব। বয়সের তুলনায় কিছুটা গম্ভীর। মুখে হাসি নেই। কাছে ডেকে জানতে চাইলাম, ‘বাবার নাম কী?’
‘শাহজাহান।’
‘আর মা?’
‘রাহেলা, বাড়ি কুমিল্লা।’
এর বেশি কিছু তার স্মৃতিতে নেই। সাড়ে চার মাস ধরে সে চট্টগ্রামের রৌফাবাদের ছোটমণি নিবাসের বাসিন্দা। তাকে নগরের আমবাগান রেলওয়ে কলোনি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ দিয়ে যায় এখানে।
ছোটমণি নিবাসে কর্মকর্তাদের মুখে জানা যায় রাকিবের কাহিনি। গত ১১ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১১টায় শিশুটিকে রেলওয়ে কলোনিতে নিয়ে যান মনা নামের এক ব্যক্তি। মনার দাবি, রাকিবকে বটতলী রেলস্টেশনে কুড়িয়ে পেয়েছেন। এরপর পুলিশকে খবর দিলে রাকিবের ঠাঁই হয় এখানে। রাকিব রয়েছে মা–বাবার প্রতীক্ষায়। এখনো খোঁজ মেলেনি তাঁদের।
রাকিবের মতো হারিয়ে যাওয়া শিশুদের ঠাঁই মিলছে এই ছোটমণি নিবাসে। সেখানে বর্তমানে থাকা ৫১ জন শিশুর ১৯ জনই হারিয়ে যাওয়া শিশু, যাদের মা–বাবা কিংবা স্বজনের হদিস পাওয়া যায়নি।
ছোটমণি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক হাসান মাসুদ বলেন, ‘এ পর্যন্ত যত শিশু এ নিবাসে এসেছে, তার অধিকাংশই হারিয়ে যাওয়া শিশু। আমরা তাদের পরিবারের লোকজনকে খঁুজে পাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু অধিকাংশ বাচ্চাই নিজের ঠিকানা বলতে পারে না।’
এখানে এক দিন বয়স থেকে শুরু করে সাত বছর বয়সের শিশুরা রয়েছে। এ নিবাসে থাকা শিশুদের অনেকেই পথে হারিয়ে এখানে ঠিকানা পেয়েছে। আবার কারও মা রয়েছেন কারাগারে। হাসপাতালে ফেলে যাওয়া অনেক শিশুরও ঠাঁই হয়েছে এখানে।
হারিয়ে যাওয়া শিশুদের অধিকাংশ নিজের বা মা–বাবার নাম বলতে পারে। আবার যারা নিজেদের নাম বলতে পারেনি, ছোটমণি নিবাসে এসে নতুন নাম পেয়েছে। তাদের একজন মিতু। ১৫ দিন বয়সে তাকে কে বা কারা নোয়াখালীর সুধারাম মডেল থানার বাইরে রেখে যায়। এর পর থেকে এই নিবাসই তার ঠিকানা।
সম্প্রতি ছোটমণি নিবাসে এসেছে শুভ নামের ছয় বছরের এক শিশু। ৩ আগস্ট সীতাকুণ্ড থানার পুলিশ উদ্ধার করেছে তাকে। হেপাটাইটিস বি রোগে আক্রান্ত শুভর শুশ্রূষার জন্য মা–বাবাকে প্রয়োজন। শিশুটির বাবার নাম শাহ আলম। ঠিকানা কোতোয়ালি, নিউমার্কেট। কিন্তু এর বেশি কিছু জানাতে না পারায় শুভর স্বজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
চার বছরের মিনহাজ আর পাঁচ বছরের শাহিদা আকতার পিংকী। দুই ভাইবোন। সাত মাস আগে পটিয়া সার্কেলের কালারপুল খালের পাড়ে অভিভাবকহীনভাবে পুলিশ খঁুজে পায় তাদের। এর পর থেকে ভাইবোনের ঠিকানা ছোটমণি নিবাস।
একই ঘটনা ঘটেছে আঁখিনূর ও হারুনুর রশীদের বেলাতেও। ২০০৯ সালে খুলশী পুলিশ খঁুজে পায় এই ভাইবোনকে। পাঁচ বছরেও ওরা বাড়ি ফিরতে পারেনি।
সাকিবুল হাসানের কাহিনি শোনালেন ছোটমণি নিবাসের শিশুদের দেখভালের দায়িত্বরত মিনু আকতার। সোয়া এক বছরেও শিশুটি পায়নি পারিবারের খোঁজ। পূর্ণ ঠিকানা জানে না। তবে মা–বাবার নাম বলতে পারে। বাবার নাম মহিউদ্দিন আর মায়ের নাম রোজিনা। গত বছরের ৫ এপ্রিল বাকলিয়ার কালামিয়া বাজারে তাকে কান্নাকাটি করতে দেখে রাসু আকতার নামের এক নারী থানায় নিয়ে যান। শিশুটির ভাষ্যমতে, তার মা বাজারের এক পাশে দাঁড় করিয়ে হারিয়ে গেছে। সাকিবুল গ্রামীণ একাডেমি নামে একটি স্কুলে শিশু শ্রেণিতে পড়ত বলে জানায়।
রিতা, প্রান্ত, নূরজাহান, আবু তৈয়ব, আহসান, রিয়া, ইভা, রিফাত, রাবেয়া, মিতু, আসিফের হারিয়ে যাওয়ার গল্পও প্রায় একই রকম। ইভার বাবার নাম আলমগীর আর মা রাশেদা বেগম। রিফাতের বাবার নাম ওসমান, মা মরিয়ম আর রাবেয়ার বাবার নাম মাহমুদুল হাসান, মায়ের নাম নার্গিস। বাকিরা বাবা-মায়ের নামও জানাতে পারেনি। ভাগ্যদোষ বা অসচেতনতা যেটিই হোক, পরিবারের স্নেহবঞ্চিত এই শিশুরা।
হারিয়ে যাওয়া শিশুর খোঁজে অনেকেই আসেন ছোটমণি নিবাসে। তবে খুব কম ভাগ্যবানই খোঁজ পান। এ রকম ভাগ্যবান শিশু আফসানা ও জুয়েল রানা। দুজনই তাদের মায়ের কোলে ফিরে গেছে। এখন এই শিশুরাও মায়ের কোলে ফেরার অপেক্ষায়।
একুশে সংবাদ ডটকম/আর/২৪-০৮-০১৪:
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :