মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে রোপা আমন ধান কাটা এবং মাড়াই উৎসবে মেতেছেন চাষিরা।
রবিবার (৩ ডিসেম্বর) সকাল-থেকে বিকেল পর্যন্ত শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায় পুরোদমে চলছে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। আবার কিছু এলাকায় বিস্তৃর্ণ মাঠজুড়ে এখনও দোল খেতে দেখা যাচ্ছে সোনালী ধান। ধান কাটা-মাড়াইয়ে কৃষকের পাশাপাশি দিনমজুরদের মাঝেও বেড়েছে চরম ব্যস্ততা।
উপজেলার আশিদ্রোন ইউনিয়নের টিকরিয়া, আশিদ্রোন, কপালী পাড়া, রামনগর এলাকা এবং শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের জেটি রোড ও ভাড়াউড়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকরা ধান কাটা ও মাড়াই নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। শ্রীমঙ্গলে এবার আমন ধান উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন চাষিরা। বাজারে চালের দাম চড়া থাকায় এবার লাভও বেশি হবে বলে আশা করছেন কৃষকেরা। চলতি মৌসুমে রোপা আমন ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসির ঝিলিক। শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের কৃষক মোঃ সুমন মিয়া বলেন, আমি এবার ১০ কেয়ার জমিতে রোপা আমন ধান চাষ করেছি। আলহামদুলিল্লাহ, অন্যান্য বছরের তুুলনায় দিগুণ ফলন পেয়েছি। এবার প্রতি জমিতে ১২-থেকে ২৫ মন ধান পেয়েছি।
এবারের ভালো ফলন পেয়ে আমি খুব খুশি। শহরতলীর রামনগর এলাকার চাষী মোঃ জুবায়ের মিয়া বলেন, চলতি মৌসুমে আমি ১২ কেয়ার জমিতে ধান চাষ করি।
প্রতি কেয়ারে ১১ মন থেকে ২৩ মন পেয়ে খুব খুশি। কারণ অন্যান্য বছর কেয়ার প্রতি ৭ থেকে ১২ মন ধান পেয়েছিলাম। আশিদ্রোনের ইউনিয়নের কৃষক মকছুদ মিয়া বলেন, আমি চলতি মৌসুমে ১৫ কেয়ার জমিতে রোপা আমন ধান চাষ করি। এবার প্রতি কেয়ারে ৮ মন থেকে ২৫ মন ধান পেয়েছি, যা বিগত কয়েক বছরেও পাইনি। যদি ধানের ন্যায্য মূল থাকে তাহলে কৃষকরা আরও লাভবান হতে পারবেন।
একই গ্রামের মুহিবুর রহমান বলেন, আমি ৬ কেয়ার জমিতে ধান চাষ করে ভালোই ধান পেয়েছি। আশিদ্রোন খোশবাস এলাকার কৃষক মোঃ শাকির আহম্মেদ জানান, তিনি এবার ৪ একর জমিতে রোপা আমন চাষাবাদ করেছেন। বাম্পার ফলনও হয়েছিল। কিন্তু ঘুর্ণিঝড় মিধিলার প্রভাবে ধানে পানি জমে ধান ঝরে পরে যাওয়ায় কাঙ্খিত ফসল ঘরে তুলতে পারেননি।
টিকরিয়া কপালীপাড়ার কুষক বাবুল কপালী, ধনঞ্জন কপালী এবং সুবিনয় কপালী বলেন, আমরা গত বছরের চেয়ে এ বছর অনেক বেশি ধান পেয়ে খুশি হয়েছি। সরকার যদি বেশি দামে ধান কিনে তাহলে আমরা আরও খুশি হবো। রামনগর গ্রামের ধান কাটতে আসা শ্রমিক মন্টু কর জানান, দৈনিক ৭০০ টাকা মজুরিতে ধান কাটেন। একদিনে এক কেয়ার ধান কাটতে ৪জন শ্রমিক লাগে। সকাল ৯টা থেকে বেলা ৪টা পর্যন্ত শ্রমিকরা ধান কাটেন বলে কৃষকরা জানান। এতে অঞ্চল অনুযায়ী প্রতি শ্রমিককে ৫০০ থেকে ৭০০টাকা মজুরি দিতে হয়। ধান মাড়াই শ্রমিক সোহেল রানা জানান, প্রতি বিঘা জমির ধান মেশিনে মাড়াই করতে স্থান ভেদে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে বাজারে ধানের দাম সন্তষজনক নয় বলে অভিযোগ করেছেন কৃষকরা। এবিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুস সামাদ জানান-কৃষকদের অভিযোগ সঠিক নয়। বাজারে ধানের দাম সন্তষজনক পর্যায়ে রয়েছে বলে। তিনি বলেন, সরকার এখন কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি মন ধান ১২০০ টাকা দিয়ে ক্রয় করছে। একজন কৃষক সরকারের কাছে সর্বনিম্ন ১২০ কেজি আর সর্বোচ্চ সর্বোচ্চ ৩ টন বা ৭৫ মন ধান বিক্রি করতে পারবে। শ্রীমঙ্গল উপজেলায় কৃষকদের কাছ থেকে মোট ৫৩৩ টন ধান ক্রয় করা হবে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবার শ্রীমঙ্গলে রোপা আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার ৩৬৫ হেক্টর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১০ হেক্টর বেশি জমিতে রোপা আমন চাষ হয় অর্থাৎ মোট আমন চাষ হয়েছে ১৫ হাজার ৩৭৫ হেক্টর জমিতে। কৃষি অফিস আরও জানায়, চলতি মৌসুমে শ্রীমঙ্গলে বিভিন্ন জাতের ধান চাষ হয়েছে। এরমধ্যে হাইব্রিড জাতের বারি হাইব্রিড-৬, হীরা-১০, এজেড-৭০০৬, সুবর্ণ-৮ জাতের ধানের চাষ হয়েছে। এছাড়াও উফশী জাতের বিআর-১১ ও ২২, ব্রি ধান- ৩২, ৩৪, ৪৯, ৫২, ৭১, ৭৫, ৮৭, ৯৩, ৯৪, ৯৫ এবং বিনা-৭, ১১, ১৬, ১৭ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এদিকে স্থানীয় জাতের ধান চাষ করা হয়েছে বিরুইন, বালাম, কালিজিরা ও চিনিগুড়া জাতের ধান।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা মো. মাসুকুর রহমান জানান, এবার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৯ হাজার ১৪২ মেট্রিক টন। যা থেকে চাল উৎপাদন হবে ৪৫ হাজার ৬৩৪ মেট্রিক টন। উপ-সহকারি উদ্ভিদ সংরক্ষন কর্মকর্তা রকেন্দ্র শর্মা জানান, রোপা আমন ধানের মাঠে পোকামাকড় ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে থাকায় এবার আমন ধানের ফলন বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক আমন ধান উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মহিউদ্দিন বলেন, এ মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ও সময়মতো বীজ ও সার পাওয়ায় এবার শ্রীমঙ্গলে রোপা আমনের অনেক ভালো ফলন হয়েছে। তাই এবছর আমন ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পেরেছে। তিনি বলেন অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে হাওর অঞ্চলের কৃষকরা ধান কাটা শুরু করেন। ইতোমধ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ১১ হাজার ৫৩১ হেক্টর জমিতে ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। উপজেলার ৭৫ পার্সেন্ট কৃষকরা ধান কেটে মাড়াই করে ঘরে ফসল তুলেছেন। আরও কয়েকদিন কৃষকদের পর ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব শুরু হবে।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :