বারো মাসে তের পার্বনের দেশ বাংলাদেশ। সারা বছরই লেগে থাকে নানা উৎসব, পালা-পার্বন। গ্রামে গঞ্জে সাধারণত সবচেয়ে বেশি মেলা বসতো। শীতকাল আসলেই পৌষ-পার্বণের মেলা, হরেক রকমের পিঠা উৎসব, যাত্রা পালা ও লোক সাংস্কৃতিক, বসন্তের মেলাগুলো জমে উঠত। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো থেকে মেলাকে কেন্দ্র করে জারি-সারি ভাটিয়ালী, বাউল গানের আসর বসাতো।
বাংলার গ্রামগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন, মূলত প্রয়োজন মেটানোর জন্য মেলার আয়োজন শুরু হয়। । শহরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহের কারণে মেলার আয়োজন শুরু হয়। গ্রামের হাটে দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর পণ্য মিলতো। সাংসারিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য এমন কিছু পণ্য মেলায় স্থান পেত যেমন খাট-পালঙ্ক, হাড়ি-পাতিল ইত্যাদি। এর বাইরেও ঋতুভিত্তিক প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহের জন্য মেলা বসতে শুরু করে।
অঞ্চলভিত্তিক দেখা যেত বিভিন্ন ধরণের মেলার প্রচলন ছিল। মেলাগুলো সাধারনত: স্কুল কলেজের মাঠ, গ্রামের মন্দির, নদীর তীর বা বড় বৃক্ষের নিচে কেন্দ্র করে বসত। কালের বিবর্তনে সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম থেকে হারিয়ে গেছে এই সব উৎসবগুলো।গ্রামে এখন আর বাসন্তি রং এর শাড়ী পড়ে, তাজা লাল, হলুদ গাঁদা ফুলের মালা খোপায় বা বেণীতে পরে মেঠো পথে তরুণীদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়না। ছেলে মেয়েরা বায়না করেনা নাগোরদোলায় চড়বো, সার্কাস,যাত্রাপালা কিংবা পুতুলনাট্য দেখবো।
গ্রামীণ মেলাগুলো হারিয়ে যাওয়ায় লোকজ ঐতিহ্যগুলো হারিয়ে গেছে। ঐতিহ্যবাহী ও মেলার জায়গা কেড়ে নিয়েছে শহুরে বাণিজ্যিক মেলা৷ এরফলে দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঐতিহ্যের সব উপকরণ ও লোকজ উপাদানগুলো কালের বিবর্তনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
মেলাগুলোতে কারুশিল্পীদের শিল্পকর্ম করা হাতের তৈরি বিভিন্ন উপাদান বিক্রি করা হতো। কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল, নকশী কাঁথা, সিলেটের শীতল পাটি, তামা কাঁসা ও পিতলের কারুশিল্প, বাঁশের কারুশিল্প, কাঠের সামগ্রীক, ঘরের আসবাবপত্র, শামুক ঝিনুকের গহনা এখন বিলুপ্তপ্রায়। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে হাতের তৈরী জিনিস হারিয়ে যাচ্ছে। আর্থিক সংকটে এই কারুশিল্পীরাও এখন অস্তিত্বের সংকটে ভুগছেন।
বাংলাদেশের মানুষ আর তার শৈশবের স্মৃতিতে গ্রামের মেলা জড়িয়ে নেই, এটা হতেই পারে না। গ্রামের শান্ত নিথর জীবনে গ্রামীণ মেলা যেন আনন্দের বন্যা নিয়ে হাজির হতো। দৈনন্দিন জীবনের গণ্ডির বাইরে মেলা যেন একটা দমকা হাওয়া। যেখানে হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। মানুষে মানুষে মিলবার জাত-পাত, ধর্মীয় পরিচয় পেছনে ফেলে এমন মিলবার জায়গা আর কোথায়? বাংলার এই মেলা ছাড়া!
তবে আধুনিকতার অভিঘাতে ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর চরিত্র বদলাচ্ছে। আগে সব মেলাই ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। গ্রামের মেলা যখন চরিত্র হারাচ্ছে কিংবা বন্ধ হতে বসেছে তখন সেই গ্রামীণ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে শহরেই শুরু হয়েছে মেলার আয়োজন। গ্রামের কোনো কোনো মেলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী পণ্যের বদলে স্থান করে নিচ্ছে এখনকার প্লাস্টিকের পণ্য। যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছেন জীবিকার তাগিদে অনেকটা তাদের নস্টালজিক স্মৃতিই গ্রামের সেই মেলাকে শহর জীবনে নিয়ে আসছে। ঐতিহ্যবাহী পণ্যগুলোকে ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় দেখা যায় শহুরে এসব মেলায়। আবার শহরের বাসিন্দাদের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়েও মেলার আয়োজন বসছে।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :