পর্যটন নগরী ও বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে উপজেলার ঢাকা-মৌলভীবাজার আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে উত্তরসুর এলাকায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)। নির্মাণের সাড়ে চার বছরেও বরাদ্দ হয়নি অর্ধেক শিল্প প্লট।
সরজমিন ঘুরে দেখা যায় বরাদ্দকৃত প্লট খালি পড়ে আছে। দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ থাকার কারণে যেখানে থাকবার কথা শিল্প প্লট সেখানে গজিয়েছে ঘাস আর ঝোপ জঙ্গল। জঙ্গলে আচ্ছাদিত এক ভুতুরে অবস্থায় পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, শিল্প প্লটের দাম বেশি। নেই গ্যাস সংযোগ। এসব কারণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শ্রীমঙ্গলে বিসিক প্লট প্রস্তুত হবার প্রথম বছরে মাত্র তিনটি প্লট বরাদ্দ হয়। সেগুলো আবার যারা বরাদ্দ পেয়েছিলেন তারা বরাদ্দ বাতিল করে টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যান। পরে অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে বিসিক শিল্পনগরী। চতুর্থ বছরে এসে বিসিক কর্তৃপক্ষের নানা তৎপরতায় একটি প্রতিষ্ঠানের ৪০টিসহ মোট ৫১টি প্লট বরাদ্দ হলেও সেগুলোতে কোন কারখানা গড়ে ওঠেনি। এমনকি কারখানা গড়ে তোলার কোন কার্যক্রমও নেই। দেশের ৮০টি বিসিক শিল্পনগরীর মধ্যে ৭৯টিতে প্লট বরাদ্দের জন্য প্রতিযোগিতা রয়েছে। এক প্লটের জন্য একাধিক উদ্যোক্তা চাহিদা দেয়ায় লটারির মাধ্যমে প্লট বরাদ্দ করতে হচ্ছে।
শিল্প উদ্যোক্তা সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে জমির বাজার মূল্য থেকে বিসিকের প্লটের জমির মূল্য কয়েকগুন বেশি এবং পার্শ্ববর্তী জেলা সদর মৌভীবাজারে অবস্থিত বিসিকের প্লটের চেয়ে শ্রীমঙ্গল বিসিকের প্লটের মূল্য বেশি হওয়া, প্রচারণা ও নিরাপত্তার অভাব এবং বিসিক পরিচালনার জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ না হওয়ায় স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তারা এখানে প্লট বরাদ্দ নিতে তেমন আগ্রহী হচ্ছেন না। বিসিক উদ্বোধনের পর প্রথম বছরে এখানে যারা তিনটি প্লট ক্রয় করেছিলেন তারা আবার টাকা বরাদ্দ বাতিল করে টাকা ফেরত নেন। নির্মাণের সাড়ে বছরের মাথায় এসে শ্রীমঙ্গল বিসিকের ১১৯টি প্লটের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের ৪০টিসহ মোট বরাদ্দ হয়েছে ৫১টি প্লট। বাকি ৬৮টি প্লট এখনো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। যে ৫১টি প্লট বরাদ্দ হয়েছে তাতে কাঁচামালের প্রাপ্যতা থাকা সত্তে¡ও এখনো কোন কারখানা গড়ে ওঠেনি। কারখানা গড়ে তোলার কোন কার্যক্রমও নেই। যারা প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন তারা বরাদ্দের টাকা জমা প্রদান করে অনেকটা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। শিল্প উদ্যোক্তরা জানান, আশপাশের জমির চেয়ে শ্রীমঙ্গল বিসিকের জমির মূল্য কয়েকগুণ বেশি হওয়ায় সরকার ভর্তুকি দিয়ে প্লট বরাদ্দ না দিলে এবং কারখানা স্থাপনে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান না করলে শ্রীমঙ্গলের বিসিক শিল্পনগরী জমে ওঠার সম্ভবনা কম। বিসিক মৌলভীবাজার কার্যালয় সূত্র জানায়, মৌলভীবাজারের বিনিয়োগকারীদের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলার উত্তরসুর এলাকায় ২০১২ সালের জুলাই মাসে ২০ একর জমি অধিগ্রহণ করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পভিত্তিক মৌলিক শিল্পনগরী নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালের জুন মাসে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সেখানে বিসিক কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত একাধিক অফিস ভবন, পাম্প হাউস এবং পাম্প চালক কোয়াটার, ডাম্পিং ইয়ার্র্ড, মসজিদ, পুকুর এবং পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নির্মিত বিসিক শিল্পনগরী শ্রীমঙ্গলের কাজ শেষ হয়। এখানে কারখানা স্থাপনের জন্য তৈরি করা হয় বিভিন্ন মাপের ১১৯টি প্লট। যেখানে মৌলভীবাজার বিসিকের প্রতি শতক জমির মূল্য ৩ লক্ষ টাকা, সেখানে শ্রীমঙ্গল বিসিকের প্রতি শতক জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৩ লক্ষ ৪৮ হাজার টাকা। অথচ শ্রীমঙ্গল বিসিকের পার্শ্ববর্তী প্রতি শতক জমির মূল্য সড়কের পাশে সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকার মধ্যে। ২০১৯ সালে উদ্বোধনের পর এখানে মাত্র তিনটি প্লট বরাদ্দ করা হলেও পরে ওই তিনজন টাকা ফেরত নিয়ে নেন। এরপর দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর চার বছরের মাথায় সম্প্রতি সর্বমোট ৫১টি প্লট বরাদ্দ নিয়েছে শিল্প উদ্যোক্তারা। বাকি ৬৮টি প্লট এখনো অবিক্রিত। এরইমধ্যে গত সাড়ে চার বছরের মধ্যে তিনবারে বিসিকের ৫টি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। প্রতিবার ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনায় থানায় মামলাও হয়েছে। টি প্ল্যান্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সদস্য সচিব জহর তরফদার গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘শ্রীমঙ্গল সারাদেশের মধ্যে একটি ব্যবসায়ীক প্রাণন্দ্রে। উপজেলায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। কয়েক বছর ধরে চলমান রয়েছে দেশের দ্বিতীয় চা নিলাম কেন্দ্র। শ্রীমঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত বিসিক নিয়ে আমাদের বড়ধরণের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু জমির মূল্য অত্যাধিক হওয়ায় এবং নানা কারনে এখনো অর্ধেক প্লটও বরাদ্দ হয়নি। এছাড়া এখানে জমি বরাদ্দ পেতে কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে সে ধরণের ঠিকানা বা মোবাইল নম্বর সম্বলিত কোন সাইনবোর্ডও সাটানো নেই।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) মৌলভীবাজারের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. বিল্লাল হোসেন ভুইয়া জানান, এখানে এখনো কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ হয়নি। তবে মৌলভীবাজার বিসিকের একজন কর্মকর্তা ও একজন গার্ড অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সেখানে কাজ করছেন।
তিনি আরও জানান, শ্রীমঙ্গল বিসিকে মোট ১১৯টি প্লট রয়েছে। প্লটগুলোর আয়তন ৬০০০ স্কয়ার ফিট, ৪৫০০ স্কয়ার ফিট এবং অন্যান্য ছোট ছোট প্লট। এখানে এ পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠানের ৪০টিসহ মোট ৫১টি প্লট বরাদ্দ হয়েছে। বাকি ৬৮টি প্লট এখনো পড়ে রয়েছে। যে ৫১টি প্লট বরাদ্দ হয়েছে তারা কোন কার্যক্রম করছেন না। ফলে বিসিকের ভেতরে কোন কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। যারা প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন তাদের সাথে যোগাযোগ করে বলেছি কারখানা করার কাজ দ্রুত শুরু করতে। আশা করছি খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে কারখানা তৈরির কাজ শুরু হবে। বাকি প্লটগুলো বরাদ্দের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলমান রয়েছে।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :