গ্রাম-বাংলা থেকে বাঁশ বাগানের পরিমাণ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। বাঁশের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য কুঠির শিল্পও। এ শিল্পের সাথে জড়িতরা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে।
বর্তমানে নির্বিচারে বাঁশ কাটা, দেখভাল ও পরিচর্যার অভাবে বাঁশঝাড় ক্রমশই কমে যাচ্ছে। উজাড় হচ্ছে প্রকৃতির দুর্যোগ প্রতিরোধক ও পরিবেশের পরম বন্ধু বাঁশঝাড়। কালের বিবর্তনে ও নগরায়নের ফলে বাঁশঝাড় কমে যাওয়ায় হারাতে বসেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্পও। কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী তার ‘কাজলা দিদি’ কবিতায় বাঁশ বাগান নিয়ে লিখেছেন, বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই/মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই? কবিতাটিতে ‘বাঁশ বাগান’ নিয়ে গ্রামীণ চিত্র ফুটে উঠেছে। এতে বাঁশ বাগানের গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। গ্রামীণ প্রত্যেকটি জনপদে বাঁশ ছিল প্রকৃতির এক অপূর্ব দান। সেই বাঁশ আজ উজাড় হচ্ছে। প্রকৃতি হারাচ্ছে ভারসাম্য।
একসময় গ্রামীণ জনপদে বাঁশঝাড় ছিল না—এমনটা কল্পনাও করা যেত না। যেখানে গ্রাম; সেখানেই বাঁশঝাড়। বিশ্বে প্রায় ১৫০০ প্রজাতির বাঁশ আছে। বাংলাদেশেই ২৬ প্রজাতির বাঁশ আছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার বাঁশ শিল্প এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। এ কারণে গ্রামের হাটবাজারগুলোতে বাঁশের তৈরি শিল্প আগের মতো আর চোখে পড়ে না। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকা পরিবারগুলো এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সঠিক সময়ে রোপণ প্রয়োজনীয় পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিকল্পনার অভাবে ফরিদপুর জেলার যে বাঁশ দিয়ে বাঁশ শিল্পের নিপূণ কারুচাজের তৈরির কাজে ব্যবহার হয় সেই বাঁশ ঝাড় উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ফলে এলাকা থেকে বাঁশ-নির্ভর শিল্প এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
এলাকাসূত্রে জানা যায়, একসময় গ্রামের হাট-বাজারগুলোতে বাঁশের তৈরি অনেক ধরনের হস্তশিল্প বিক্রি হতো। যেমন কুলা, ডালা, টুপরি, কুড়ি চালুন, তালাই, টোপা, ঝাঁটা হোঁচা, মই, মাছ ধরার খালুই, পলো, দারকি, ধীল, চাঁই, বানা এবং বিভিন্ন সৌখিন খেলনা সামগ্রী। এছাড়া এলাকায় কাঁচা ঘর তৈরিতে বাঁশের খুঁটি, বেড়া, ঘরের দরজা ইত্যাদি উপকরণও ব্যবহার হতো।
এ বিষয়ে বাঁশের শিল্প সাথে জড়িত নিমাই সরকার বলেন, আগে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র নিজেরা বাড়িতে তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেছি, তখন লাভ হতো। কিন্তু এখন তেমন একটা লাভ হয় না। রাত-দিন খেটে যা তৈরি করি হাটবাজারে সে তুলনায় বিক্রি নেই। সরকারিভাবে কোনো সাহায্যে সহযোগিতাও পাচ্ছি না। অনেক দুঃখ কষ্টে দিন কাটছে আমাদের। অভাবের তাড়নায় গোত্রের অনেকেই অন্য পেশায় চলে গেছেন। উপযুক্ত কাজ এবং অভিজ্ঞতার অভাবে আমরা অন্য পেশায় যেতে পারিনি।
স্থানীয় একজন কৃষক জানান, আগে জমির দাম কিছুটা কম থাকায় বাঁশ ঝাড়গুলো সংরক্ষিত ছিলো। এখন জমির দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় বাঁশ ঝাড় কেটে জমি বিক্রি করা হচ্ছে। এসব জায়গায় গড়ে উঠেছে বসতিসহ নানান স্থাপনা। এছাড়া ইটভাটার জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে বাঁশ।
বাঁশ বাগানের মালিকরা বলেন, আগে আমাদের বাঁশ ঝাড় অনেক বড় ছিলো। এখন এর প্রতি গুরুত্ব না দেয়ায় অনেক কমে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঝাড় কমে যাওয়ায় এখন বাঁশ আর সহজলভ্য নয়। এ কারণেই দিনে দিনে বাড়ছে বাঁশের দাম। কিছুদিন আগেও একটি বাঁশের দাম ছিলো ১০০ টাকা। এখন বেড়ে দাড়িয়েছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।
কয়েকজন বাঁশ ব্যবসায়ি জানান, ঝাড়গুলো নিধন হচ্ছে। পুনরায় জন্ম নিচ্ছে না। তাই আমাদের কিনতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বাঁশের আগের মতো ঝাড় নেই।
বোয়ালমারী উপজেলার ময়না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কালিপদ চক্রবর্ত্তী জানান, এক সময় ফরিদপুর জেলায় ৯৯ শতাংশ ঘর ছিল বাঁশের খুঁটির উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও ঘরের বেড়া, চালা, অবকাঠামো নির্মাণ রান্নাঘর ও কৃষি ক্ষেতসহ পরিবারের অনেক কাজেই বাঁশের ব্যবহার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ।
তিনি আরও বলেন, পাকা ঘরবাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট, ছাদ ঢালাইসহ অন্যান্য কাজে বাঁশের ব্যবহার ছিল অপরিহার্য্য।ইতি পূর্বে জেলায় অনেক বাঁশ ঝাড় ছিল। কিন্তু যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার ব্যাপকহারে গঠিত হওয়ায় বসত বাড়ীর জন্য বাঁশঝাড় কেটে ফেলা হচ্ছে।
সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রকৃতির পরম বন্ধু এই বাঁশঝাড় কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এই বাঁশঝাড় টিকিয়ে রাখার তাগিদ দিচ্ছেন পরিবেশবিদ ও প্রকৃতি প্রেমিরা পরিবেশ সুরক্ষা ও কৃষি সহায়ক উপাদান হিসেবে বাণিজ্যিক ভাবে বাঁশ চাষের প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। ফরিদপুর জেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তাদের উদ্বুদ্ধ করছে। এই বাঁশের ঝাড় পুনরায় স্থাপন করতে কি প্রযুক্তি লাগবে সেগুলো আমরা দিচ্ছি। এর মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি তারা আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
স্বল্প পরিসরে হলেও বাড়ির আশেপাশে বাঁশ বাগান সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়ার উপর জোড় দিয়েছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ।
একুশে সংবাদ/স.চ.জে/সা.আ
আপনার মতামত লিখুন :