পবিত্র ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পরিবারের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি এবং প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের অন্যতম পর্যটন শহর হিসেবে পরিচিত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জে এবার ঢল নেমেছে পর্যটকদের।রবিবার (১৪ এপ্রিল) বিকেলে সরজমিন শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর লেকসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পট ঘুরে দেখা যায়, ঈদের চতুর্থ দিনেও ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে বিপুল সংখ্যক পর্যটকেরা শ্রীমঙ্গলের বধ্যভূমি৭১, দার্জিলিং টিলা, বাইক্কাবিল, বিটিআরআই, নীল কণ্ঠ, হরিণ ছড়া গল্ফ মাঠ, চা বাগান লেক, সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানাসহ বিভিন্ন হোটেল-রিসোর্টে দল বেঁধে ঘুরছেন, ছবি তুলছেন।
এছাড়া কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানেও কয়েক হাজার পর্যটকদের দেখা মিলে। এসময় দেখা যায়, টিকিট কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন ধরে টিকিট কেনা চলছে। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত দেশ-বিদেশি পর্যটকেরা এখানকার জীব-বৈচিত্র্যময় পরিবেশে ঘুরে তাদের ঈদের আনন্দ পরিপূর্ণ করার চেষ্টা করছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে যারা এসেছেন, তারা সঙ্গে ইকো-টুরিস্ট গাইড নিয়ে ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কেউ কেউ বনের ভেতর প্রবেশ করে ঘোরাফেরা করছেন। অনেকে দল বেঁধে ঘুরছেন, ছবিও তুলছেন।
ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থী ফারদিন, রফিক, সামাদের সাথে দেখা হয় কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। আলাপকালে তারা বলেন এখানকার প্রাণ প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ঘুরে ঘুরে দেখে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পেরে বেশ খুশি।
মানিকগঞ্জ থেকে পরিবার নিয়ে শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে আসেন ফাহিম আসাদ। আলাপকালে তিনি বলেন, আমার স্ত্রী, কন্যা, পুত্র, পুত্রবধু নিয়ে চায়ের দেশ ঘুরতে আসি। ঈদের ছুটিতে পরিবারের সবাইকে আনন্দ দেয়ার জন্যই আমরা প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখতে এসেছি। আমরা গত দুই দিনে শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিল, হরিণছড়া গল্ফ মাঠ, বিটিআরআই, বধ্যভূমি ৭১ ঘুরে ঘুরে অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। আজ কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া, মাধবপুর লেক এবং আগামীকাল বড়লেখার মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত ঘুরে দেখবো।
মৌলভীবাজার জেলার প্রাকৃতিক পরিবেশ, চা বাগান, টিলাসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলো যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। আমাদের সবাই এখানে এসে মোহিত হয়েছেন।
শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বধ্যভূমি ৭১, চা যাদুঘর, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা, বাইক্কা বিলসহ বিভিন্ন বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রগুলো গত দুই দিনে পরিবার নিয়ে ঘুরে দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন নরসিংদি থেকে আসা আফিফ হামিদ। তার সাথে আলাপকালে তিনি শ্রীমঙ্গলের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং পর্যটন স্পটগুলোর সুনাম ও প্রশংসা করেন। তবে ঈদ উপলক্ষে পরিবহনের বাড়তি ভাড়া ও বিভিন্ন পণ্যের অতিরিক্ত দাম নিয়ে তিনি কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
সানজিদা আক্তার সুলতানা নামের কলেজ শিক্ষার্থী বলেন, আমরা ঢাকা সাভার থেকে কয়েকজন বান্ধবিরা মিলে শ্রীমঙ্গলের বিটিআরআই, বািক্কাবিলসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পট ও কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া, মাধবপুর লেক, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ ঘুরে দেখে এসে বেশ আনন্দ পেয়েছি। এসব এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, টিলা, চা বাগান ও লেকগুলো অসাধারণ।
দর্শনার্থী ফারজানা বলেন তারা ঢাকায় থাকেন। ঈদের ছুটিতে শহরের কোলাহল ছেড়ে তারা লাউয়াছড়া, বাইক্কাবিল, বিটিআরআই, বধ্যভূমি৭১ ঘুরতে এসেছেন। চা বাগান আর পাহাড়-টিলার অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন।
ঈদের চারদিন ও বাংলা নববর্ষের একদিন ছুটি মিলে পাঁচ দিন ছুটি থাকায়, বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রীমঙ্গলের দর্শনীয় স্থান গুলোতে ব্যাপক দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে, যার ফলে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে স্থান গুলো। পর্যটকের এমন উপস্থিতিতে দারুণ খুশি পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
পর্যটকদের আগমনে ভাসমান ব্যবসায়ীরা আনারস, চটপটি, শরবত, লেবুসহ বিভিন্ন স্থানীয় বাগানের ফল ভ্যান, ঠেলা গাড়ির মধ্যে সাজিয়ে বসেছে সড়কের পাশে। এতে পর্যটকদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় সেসব ফল ক্রয় করতে দেখা যায়। জেলার বিভিন্ন রির্সোট, গেস্ট হাউস, রেস্ট হাউস, হোটেল ব্যবসায়ীরাও বেশ লাভবান। সবমিলিয়ে স্থানীয় পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীসহ ভাসমান ব্যবসায়ীরা দারুণ খুশি। দর্শনার্থীরাও জেলার পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে দেখে বেশ উচ্ছ্বসিত।
লাউয়াছড়া এলাকার ব্যবসায়ীরা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দর্শনার্থী শূন্য ছিল পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু ঈদেও ছুটিতে প্রচুর দর্শনার্থী আসতেছে এখানে। আমাদের বেচাকেনাও অনেক ভালো। আশা করছি অন্তত এক সপ্তাহ ধরে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি থাকবে। ফলে ভালোই লাভবান হবেন জানান এ ব্যবসায়ীরা।
এদিকে এবারের ঈদের ছুটিতে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জের বিভিন্ন চা-বাগানসহ জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোতে রেকর্ড সংখ্যক পর্যটের উপস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশসহ প্রশাসনকে। আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে শহরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ছিল পুলিশের কঠোর নজরদারি। এছাড়া প্রতিটি পর্যটন স্পটের মুখে দীর্ঘ যানজট ছিল লক্ষণীয়।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির অফিস সহকারী আফজাল হোসেন বলেন, কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ঈদুল ফিতরের ছুটিতে বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) ঈদের দিন ৩ হাজার পর্যটক, পরদিন শুক্রবার ২ হাজার ৫০০ জন ও ঈদের তৃতীয় দিন শনিবার ৩ হাজার ৩০০ জন পর্যটক টিকেট কেটে লাউয়াছড়ায় প্রবেশ করেন। তিনি বলেন ঈদের তিনদিনে উদ্যানে প্রায় দশ হাজার পর্যটক প্রবেশ করেছেন। এতে প্রবেশমূল্য বাবদ রাজস্ব আয় হয়েছে ৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের শ্রীমঙ্গল শাখার সাধারণ সম্পাদক রাসেল আলম বলেন, ঈদ ও বাংলা নববর্ষ কেন্দ্র করে আমরা বেশ কিছু পর্যটক ভ্রমণ প্যাকেজ বিক্রি করতে পেরেছি। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার পর্যটক বেড়েছে এবং শতভাগ রুম বুকিং হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সেলিম আহমেদ বলেন, পর্যটকরা প্রতি বছর ঈদের সময়টাতে চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গলে সপরিবারে ঘুরতে আসেন। অতীতের তুলনায় এবারের ঈদ ও পহেলা বৈশাখের ছুটিতে শ্রীমঙ্গলে ট্যুরিস্টদের আনাগোনা বেড়েছে, হোটেল- রিসোর্টের বুকিংও কয়েকগুণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশ শ্রীমঙ্গল জোনের উপপরিদর্শক প্রবাল সিনহা বলেন, পুলিশের সার্বক্ষণিক নজরদারির কারণে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে কোনো ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা ও হয়রানি ছাড়াই পর্যটকরা আনন্দ উপভোগ করে বাড়ি ফিরছেন। প্রতিটি পর্যটন স্পটে ট্যুরিস্ট পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
একুশে সংবাদ/এস কে
আপনার মতামত লিখুন :