অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরের তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকা ডুবিতে নিহত আট বাংলাদেশির মরদেহ পৌঁছেছে তাদের নিজ বাড়িতে। নিহতদের মধ্যে পাঁচ জনই মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার বাসিন্দা। অন্য তিনজন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার। ৭৯ দিন পর বাড়িতে মরদেহ পৌঁছালে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন স্বজনরা।
পরে মরদেহগুলো দাফন করা হয় পারিবারিক কবরস্থানে। এতে একদিকে আদরের সন্তানদের হারিয়ে দিশেহারা পরিবার। অন্যদিকে দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ স্বজন ও এলাকাবাসী।
শুক্রবার (৩ মে) সন্ধ্যার কিছু সময় আগে অ্যাম্বুলেন্সযোগে রাজধানী ঢাকা থেকে নিয়ে আসা হয় নিহতদের মরদেহ।
নিহতরা হলেন- মাদারীপুরের রাজৈরের কোদালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান কাজীর ছেলে সজীব কাজী (১৯), পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২২), সেনদিয়ার গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী (২২), উত্তরপাড়া গ্রামের পরিতোষ বিশ্বাসের ছেলে নয়ন বিশ্বাস (২৪), কেশরদিয়া গ্রামের কাওসার (২২), গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বড়দিয়া গ্রামের দাদন মিয়ার ছেলে রিফাদ (২১), ফতেয়পট্টি এলাকার মো. রাসেল (২০) ও গয়লাকান্দি গ্রামের পান্নু শেখের ছেলে ইসরুল কায়েস আপন (২২)। ৮ বাংলাদেশি ছাড়াও এই দুর্ঘটনায় এক পাকিস্তানি নাগরিকও মারা যান। কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টগার্ড।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে তিউনিসিয়া থেকে সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায় নিহত আট বাংলাদেশির মরদেহ। পরে মরদেহগুলো নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে শুক্রবার দুপুরে পরিবারের কাছে মরদেহ বুঝিয়ে দেয় ঢাকা জেলা প্রশাসন ও বিমানবন্দর থানা পুলিশ। পরে মরদেহগুলো নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈরে ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। ধর্মীয় রীতি শেষে নিহতদের দাফন করা হয় নিজ নিজ পারিবারিক কবরস্থানে।
স্বজনরা জানায়, গত ১৪ জানুয়ারি রাজৈর ও মুকসুদপুরের কয়েকজন যুবক ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়। প্রথমে তারা বিমানযোগে লিবিয়া, পরে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া থেকে দালালদের মাধ্যমে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় তারা। মাঝপথে তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগর ইঞ্জিন ফেটে আগুন ধরে ডুবে যায় নৌকাটি। এতে রাজৈরের কোদালিয়ার সজীব কাজী, পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের মামুন শেখ, সেনদিয়ার সজল বৈরাগী, কদমবাড়ির নয়ন বিশ্বাস ও কেশরদিয়া গ্রামের কাওসার ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের রিফাদ, রাসেল ও আপনের মৃত্যু হয়।
স্বজনদের অভিযোগ, মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য মুকসুদপুরের গজারিয়া গ্রামে রহিম শেখ ও সুন্দরদী গ্রামের মোশারফ কাজী প্রত্যেকের পরিবারের কাছ থেকে নেয় ১০-১৫ লাখ টাকা। পরে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালি পাঠালে এই দুর্ঘটনা। এই ঘটনার দালালদের বিচার দাবি করেছেন স্বজন ও এলাকাবাসী।
নিহত মামুনের বড় ভাই সজীব শেখ বলেন, আমার ভাইয়ের মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। এভাবে যেন কেউ অবৈধপথে কাউকে বিদেশে না পাঠায়। দালালরা মুখে বলে এক কথা, আর কাজে আরেক কথা। কথার সঙ্গে কাজের কোনো মিল নেই।
নিহত সজল বৈরাগীর ফুফাতো বোন আরতী বৈরাগী বলেন, আমার মামাতো ভাইয়ের মতো যেন, আর কারো মৃত্যু না হয়। সজলের অকাল মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ধারদেনা করে দালালদের লাখ লাখ টাকা দিলেও নিরাপদে ইতালি পৌঁছাতে পারেনি। এমন ঘটনায় দোষীদের বিচার হওয়া উচিত।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, তিউনিসিয়ায় নিহতের মরদেহ এরই মধ্যে নিজ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছেছে। দাফনও সম্পন্ন হয়েছে। এই ঘটনায় ভুক্তভোগীর পরিবার আইনগত সহযোগিতা চাইলে, সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে।
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান বলেন, অবৈধভাবে সমুদ্রপথে বিদেশযাত্রা বন্ধের জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। মানুষ সচেতন হলে অকালে এমন মৃত্যু আর হবে না। এজন্য জনপ্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :