ঢাকার ধামরাইয়ে প্রতি বছরের মতো এবারও রথযাত্রা উপলক্ষে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী রথ। এটির সংস্কার ও সাজিয়ে তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা। এ উৎসব যথাযথভাবে পালনে এরইমধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসনও।
আয়োজকরা জানান, রোববার (৭ জুলাই) ধামরাইয়ের বাজারের রথখোলা এলাকা থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত প্রথমে রথটান ও পরে ১৫ জুলাই উল্টোরথের মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে। তবে রথকে কেন্দ্র করে ৭ জুলাই থেকে পরের এক মাস চলবে ঐতিহ্যবাহী মেলা।
রথ সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে, প্রায় ৪০০ বছর আগে ধামরাইয়ের জমিদার ছিলেন শ্রী যশোপাল। নিজের সৈন্য সামন্ত নিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন পাশের এলাকায়। বন-জঙ্গলে ঘেরা পথে চলতে গিয়ে এক ঢিবির সামনে হঠাৎ থেমে যায় তার হাতি। হাতি আর এগোয় না। উপায় না পেয়ে সেই ঢিবি খননের নির্দেশ দেন রাজা। খননের পর ঢিবির নিচ থেকে পাওয়া যায় এক মন্দির ও কিছু মূর্তি। ভক্তি করে সেসব মুর্তি বাড়ি আনেন রাজা। রাতেই স্বপ্নে দেখেন মাধব দেবতাকে। তিনি রাজাকে নির্দেশ দেন পূজা করার ও নিজের সঙ্গে মাধব নাম বসিয়ে নেওয়ার। যশোপালের নাম হয়ে যায় যশোমাধব। সময়টি ছিল চন্দ্র আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথি। সেই থেকেই শুরু হয় যশোমাধবের পূজা ও রথযাত্রা। প্রতি বছর এ সময়েই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এ রথযাত্রা।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, বাংলা ১২০৪ থেকে ১৩৪৪ সন পর্যন্ত ঢাকা জেলার সাটুরিয়া থানার বালিয়াটির জমিদাররা বংশানুক্রমে এখানে চারটি রথ তৈরি করেন। ১৩৪৪ সালে রথের ঠিকাদার ছিলেন নারায়ণগঞ্জের স্বর্গীয় সূর্যনারায়ণ সাহা। এ রথ তৈরি করতে সময় লাগে এক বছর।
ধামরাই, কালিয়াকৈর, সাটুরিয়া, সিঙ্গাইর থানার বিভিন্ন কাঠশিল্পী যৌথভাবে নির্মাণকাজে অংশগ্রহণ করে ৬০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন রথটি তৈরি করেন। এ রথটি ত্রিতলবিশিষ্ট ছিল, যার প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় চার কোণে চারটি প্রকোষ্ঠ ও তৃতীয় তলায় একটি প্রকোষ্ঠ ছিল। বালিয়াটির জমিদাররা চলে যাওয়ার পর রথের দেখভালের দায়িত্ব পালন করত টাঙ্গাইলের রণদাপ্রসাদ সাহার পরিবার।
২০১০ সালে ধামরাইয়ে পুরোনো রথটির আদলে দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন রথ বানিয়ে দেওয়া হয়। ৪০ জন শিল্পী ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে নিরলসভাবে কাজ করে ৩৭ ফুট উচ্চতা ও ২০ ফুট প্রস্থের কারুকার্যখচিত নতুন রথটি নির্মাণ করেন।
লোহার খাঁচার ওপর সেগুন ও চাম্বল কাঠ বসিয়ে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে আকর্ষণীয় সব শৈল্পিক নিদর্শন। এতে রয়েছে লোহার তৈরি ১৫টি চাকা। রথের সামনে রয়েছে কাঠের তৈরি দুটি ঘোড়া ও সারথি।
এছাড়া রথের বিভিন্ন ধাপে প্রকোষ্ঠের মাঝে স্থাপন করা হয়েছে কাঠের তৈরি দেব-দেবীর মূর্তি। প্রতি বছর রথযাত্রার আগে রং চরানো ও সাজসজ্জার কাজ করে এটিতেই অনুষ্ঠিত হয় রথ উৎসব।
রথের দেখভালের দায়িত্বে থাকা দায়িত্বপ্রাপ্তরা জানান, রথটি সারা বছর বাইরে খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়। এ জন্য রং মলিন হয়ে যায়। কিন্তু রথযাত্রার আগে এটিকে পুরোপুরি সাজিয়ে তোলা হয়। এছাড়া সংস্কারের কাজকর্মও এই সময়ে করা হয়।
মঙ্গলবার (৪ জুলাই) দুপুরে ধামরাই উপজেলা পরিষদসংলগ্ন রথখোলায় গিয়ে রথের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির ব্যস্ততা দেখা যায়।
রথের খুঁটির দেয়ালের দেবতাদের প্রতিমার প্রতিকৃতি রঙ করছিলেন সঞ্জয় পাল নামে এক রংমিস্ত্রী। তিনি বলেন, ১১ বছর ধরে রথের সাজসজ্জা ও মেরামতের কাজ করছি। এ বছরও গত কয়েক দিন যাবত টানা রথের সংস্কার কাজ করছি। এই কাজ শুধু পেশা হিসেবে নয়, নিজের ভালো লাগা থেকেও করি। আগামী ৭ জুলাই রথটানা হবে। তার আগেই কাজ সেরে ফেলব বলে আশা করছি।
প্রদীপ চৌধুরী নামে অপর এক রংমিস্ত্রি বলেন, ভগবানের কৃপা ও মানুষের আশির্বাদ পেতে এই রথে কাজ করছি। প্রত্যেকটি কাঠের কাঠামোয় রঙের প্রয়োজনীয় কাজ করা হচ্ছে। প্রয়োজন অনুযায়ী রং করে রথ সাজিয়ে তোলা হচ্ছে। তবে বৃষ্টির জন্য কাজে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে। আশা করছি দ্রুত কাজ শেষ হবে।
রথযাত্রার সর্বশেষ প্রস্তুতির বিষয়ে ধামরাই যশোমাধব মন্দির পরিচালনা পর্ষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নন্দ গোপাল সেন বলেন, ইতোমধ্যে থানা, উপজেলা ও পৌর মেয়রের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা আশ্বস্ত করেছেন, অন্যান্য বছরের মতো এবারও নিরাপত্তায় উৎসবমুখর পরিবেশে রথযাত্রা উৎসব পালিত হবে। রথযাত্রা উৎসবকে সুন্দরভাবে পালন করতে বেশ কয়েকটি উপ-কমিটি করে থাকি। সেগুলো কাজ শুরু করেছে। রথের কাঠের কাজ শেষ হয়েছে। রঙের কাজ করা হচ্ছে। বৃষ্টির জন্য কাজে কিছুটা বিঘ্ন ঘটলেও সঠিক সময়ে কাজ শেষ করে সুন্দর ও আনন্দঘনভাবে রথযাত্রা উৎসব পালন করতে পারবো।
ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম শেখ বলেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় উৎসব রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার সকল প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় সব জায়গায় পুলিশ মোতায়েন করা থাকবে। আমরা নিশ্ছিদ্রভাবে রথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো।
ধামরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) খান মো. আব্দুল্লা আল মামুন বলেন, রথযাত্রা উপলক্ষে বিশেষ সভা করেছি। রথযাত্রা নিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসক বিষয়টি অবগত রয়েছেন। তিনি সার্বিক নির্দেশনা দিয়েছেন৷ ঢাকা-২০ আসনের সংসদ সদস্য বেনজির আহমদও এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এ অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সহযোগিতা করছে। আশা করছি, অন্যান্যবারের মতো এবারও উৎসবমুখর পরিবেশে রথযাত্রা উদযাপন করতে পারবো। পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। উপজেলা প্রশাসনও এ বিষয়ে কাজ করছে।
একুশে সংবাদ/সা.আ
আপনার মতামত লিখুন :