শাহ আলম ডাকুয়া ও মোয়াজ্জেম হোসেন:
পূর্বকথা-
২০২৪ সাল। এ সময়ের ‘বরিশাল’ জেলার আগের নাম ছিল ‘চন্দ্রদ্বীপ’। এ চন্দ্রদ্বীপের মূলভূখণ্ড ছিল বর্তমান বরিশাল জেলা, পটুয়াখালি জেলা, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, খুলনা ও বাগেরহাটের কতিপয় এলাকা নিয়ে। তবে বরিশালের বাবুগঞ্জের ক্ষুদ্রকাঠি, উজিরপুর, নলছিটি, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া, বাকেরগঞ্জ ও মাদারীপুরের ইদিলপুর ছিল অত্যন্ত সুপরিচিত জনপদ, ব্যস্ততম ও নদীতীরে গড়ে ওঠা ব্যবসা কেন্দ্র।
ক্ষুদ্রকাঠি, নলছিটি, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া, বাকেরগঞ্জ ও মাদারীপুরের ইদিলপুরে চন্দ্রদ্বীপের রাজধানীও ছিল পরবর্তী সময়ে। নদীপথে ক্ষুদ্রকাঠি থেকে কোটালীপাড়া গমনের মধ্যপথে উল্লেখযোগ্য বন্দর ছিল উজিরপুরের যোগীরকান্দা।
এ প্রাচীন জনপদটি বলেশ্বর ও মেঘনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল। আবুল ফজল-এর মতে− বাকলা চন্দ্রদ্বীপ ছিল সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত। প্রাচীনকালে গঙ্গা নদী সপ্তশাখায় বিভক্ত ছিল। এর একটি ছিল পাবণী পূর্বগামী শাখা। পূর্বগামী ত্রিধারার মিলিত স্থানকে সুগন্ধা বলা হতো। এই সুগন্ধা হলো বর্তমান উজিরপুর উপজেলার (বরিশাল) মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ঝালকাঠির দিকে গেছে উজিরপুরের গুঠিয়া হয়ে। এ নদীর বুকে গঙ্গার পলিমাটি অসংখ্য দ্বীপ সৃষ্টি করে। এসবের মধ্যে ইন্দ্রদ্বীপ, সংখকোট, স্ত্রীর, জম্বু দ্বীপ প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। কালের বিবর্তনে দ্বীপগুলোর সম্মিলিত নাম হয় চন্দ্রদ্বীপ। দ্বীপগুলোর আকৃতি চাঁদের ন্যায় ছিল বলে এরূপ নামকরণ করা হয়। আবার কেউ কেউ বলেন, চন্দ্রভদ্র জনগোষ্ঠির নামানুসারে চন্দ্রদ্বীপের নাম হয়েছে। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের পূর্ব পর্যন্ত বাকলা চন্দ্রদ্বীপের রাজনৈতিক ইতিহাস জানা যায় না। খ্রিষ্টীয় ৪র্থ ও ৫ম শতকে এই অঞ্চল মৌর্য ও গুপ্ত শাসনাধীন ছিল। ৪র্থ শতকে পুষ্করণ (বাঁকুড়া) মহারাজা চন্দ্রবর্মা কোটালীপাড়া দখল করে বাকলা চন্দ্রদ্বীপে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় কোটালীপাড়াকে কেন্দ্র করে চন্দ্রদ্বীপের সভ্যতা বিকাশ লাভ করে। উল্লেখ্য গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বাখরগঞ্জ, পটুয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাটসহ সমস্ত দক্ষিণাঞ্চল তখন বাকলা চন্দ্রদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এই সময় বর্তমান মাদারিপুরের পূর্বাংশ ইদিলপুর এবং পশ্চিম অংশ কোটালীপাড়া নামে পরিচিত ছিল। ইদিলপুর চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের একটি উন্নত জনপদ ছিল। একসময় এ অঞ্চলের প্রশাসনিক নাম ছিল নাব্যমন্ডল। কোটালীপাড়া ছিল বাংলার সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র। (তথ্য- উইকিপিডিয়া)
যোগীরকান্দা নাম যেভাবে হলো-
বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার ওটরা ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম যোগীরকান্দা। উজিরপুরে বর্তমানে সুগন্ধা, সন্ধ্যা ও পশ্চিমে কচা নদী রয়েছে। যা মূলত পুরনো সুগন্ধা নদীকে পরে ভাগ করে সন্ধ্যা ও কচা নাম দেওয়া হয়। খ্রিষ্টীয় ৪র্থ ও ৫ম শতকে এই অঞ্চল মৌর্য ও গুপ্ত শাসনাধীন ছিল। ৪র্থ শতকে পুষ্করণ (বাঁকুড়া) মহারাজা চন্দ্রবর্মা কোটালীপাড়া দখল করে বাকলা চন্দ্রদ্বীপে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় কোটালীপাড়াকে কেন্দ্র করে চন্দ্রদ্বীপের সভ্যতা বিকাশ লাভ করে। যোগীরকান্দা গ্রামটি উপরে উল্লেখিত সন্ধ্যা-সুগন্ধা নদীর মোহনায় অবস্থিত ছিল। বর্তমান ২০২৪ সালে সন্ধ্যা, সুগন্ধা ও কচা নদীর যে অবস্থান তা মোটেই ৭০০ কিংবা ৮০০ শতাব্দীর অবস্থান নয়।
নদীর পাড়ে বা তীরেই সাধারণত সেসময় বসতি গড়ে উঠতো। তখনকার মানুষজনের একমাত্র পেশা ছিল কৃষি ও মাছ ধরা ও বিক্রি। নৌকাই ছিল একমাত্র চলাচলের বাহন। কোনো প্রকার বড় কাঁচা সড়কও ছিল না। ছিল ধানক্ষেতের আইলের মতো সরু রাস্তা। যা দিয়ে মানুষ আশেপাশে চলাচল করতো। তবে প্রধান বাহন ছিল নৌকা। যোগীরকান্দা থেকে কোটালীপাড়ার দূরত্ব বেশি নয়। যোগীরকান্দা গ্রামটির অস্তিত্ব ছিল ৭৫০ সালের দিকে। এবং বাংলা ভাষার পুথি, কির্তন, গ্রাম্য প্রবাদ কথা, হেয়ালি, ছড়া, ধর্মীয় কাহিনিনির্ভর বচন সাহিত্যের প্রাথমিক উৎপত্তি স্থান এই যোগীরকান্দা বলে ধারণা করা হচ্ছে। তখন ওই এলাকায় কেবল বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের সংমিশ্রণে অন্য একটা ধর্মের উৎপত্তিস্থলও ছিল। হিন্দুদের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন এলাকায় নাথ বংশ আছে। নাথেদের মধ্যে অনেক সমাজপতি ছিলেন। এ সমাজপতিরা কাজ শেষে যোগসাধনা/ধ্যান করতেন। যোগসাধনা করতেন যারা তাদের যোগী বলা হতো। এই যোগীদের সবাই মান্য করতেন। এই যোগীদের বংশ বাড়ার সাথে সাথে এরা একটা সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত লাভ করে। এরা মূল নাথ সম্প্রদায় থেকে যোগী সম্প্রদায় হিসেবে আলাদা সম্প্রদায় হয়ে যায়। এই যোগীরা তখন অন্য মানুষদের উপদেশ দিতেন ছড়া বা পাঁচালি আকারে।
ধারণা করা হচ্ছে- ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম যোগীদের বাস ছিল যোগীরকান্দা গ্রামে। এখানে অনেক নাথ পরিবার ছিল। তাদের মধ্যে অনেকে ধ্যান সাধনা বা যোগ সাধনা করতো। এই যোগ সাধনার জন্য মানুষের মুখে মুখে নাম হয় যোগীদের গ্রাম। যোগীরা অন্যদের তুলনায় নিজেদের উচ্চ বা কুলীন ভাবতেন। এই যোগীরা সুগন্ধা-সন্ধ্যা নদীর তীরে বা নদীর কান্দায় বা কিনারায় এক-দুই মাইলব্যাপী মাটি কেটে উঁচু বাঁধ করে বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতেন। কারণ চারদিকে তখন ছিল পানি আর পানি। জোয়ারে তলিয়ে যেত পুরো এলাকা। তাই মাটি কেটে উঁচু বাঁধের মতো করে ঘরবাড়ি তোলার কারণে কান্দি বা পাড়া বলা হতো। ৭৫০ সালের দিক থেকেই এই যোগীদের বসবাসের স্থান ছিল যোগীরকান্দা। ওই সময় যোগীরকান্দার আশপাশে যারা বসত করতো তাদের সবার কাজ ছিল সুগন্ধার মোহনা (সন্ধ্যা) নদী থেকে মৎস্য ধরা আর ধান ফলানো। কেউ কেউ তাঁতে নিজের পরনের কাপড়ও তৈরি করতো।
৫ম থেকে ১২০০ শতাব্দী পর্যন্ত সারা ভারতবর্ষে যোগাযোগ, ব্যবসা, সব হতো নদী ও খালপথে। যোগীদের আমলে ওই এলাকায় ছোট নদীবন্দর ছিল। সেটা আজকের গালা বাজার বলে ধারণা করা হচ্ছে। যোগীরকান্দা গ্রামের গালা বাজারের অস্তিত্ব এখনো আছে। এখানে ৩০ বছর আগেও ধান-চালের বড় বাজার বসতো। বর্তমান ২০২৪ সালে এখানে সন্ধ্যানদী সংলগ্ন কচা নদীতে একটা পাকা ব্রিজ নির্মাণের কাজ চলছে।
বর্তমানে ২০২৪ সালের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সন্ধ্যা নদীর কোলঘেষে (বর্তমানে এখানে কিছু অংশ কচা নামে) যোগীরকান্দা গ্রামে একটি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা আছে। যেটাকে স্থানীয় ভাষায় নোমোপাড়া (নমশুদ্র পাড়া) বলে। হিন্দুদের এই পাড়ার মধ্যে কিছু প্রাচীন মন্দির ও মঠ রয়েছে। অতি প্রাচীন মন্দির ও উপাসনালয়গুলোর অধিকাংশই তৎকালীন নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে হিন্দুদের মধ্যে হালদার, ডাকুয়া, দাস, দাহারিয়া, মাল, মল্লিক, মন্ডল শীল, পারুয়া প্রভৃতি বংশ-শ্রেণির লোকজন বসবাস করে। এদের বেশিরভাগই মৎস্যজীবী তবে নগণ্য সংখ্যক হালুটি বা কৃষি ও অন্যান্য পেশার সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। ঐ পাড়ার কৃষ্ণকান্ত মহুরি (৯০) জানান (আগস্ট-২০২৪)- তিনি তার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে জেনেছেন- যোগীরকান্দা, মালিকান্দা ও ভবানীপুর এলাকায় একসময় নাথ ও যোগী সম্প্রদায়ে বসবাস ছিল।
একুশে সংবাদ/এসএডি/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :