জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বেগুনগ্রামে চিশতীয়া পীরের আস্তানায় বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব উদ্যাপন উপলক্ষে জমে উঠেছে একদিনের নবান্ন মেলা। প্রতি বছর বাংলা অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার হিসাবে আজ ২১ নভেম্বর সকাল থেকে রাত ২টা পর্যন্ত এই উৎসব পালিত হয়। হাজার হাজার ভক্ত, মুরিদ ও দর্শনার্থীর উপস্থিতিতে পুরো এলাকা মুখরিত হয়।যা বাংলার সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক চেতনার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
উৎসবের মূল আকর্ষণ ছিল বিশাল পরিসরে ক্ষীর রান্না। আস্তানার ভাণ্ডার খানার তথ্য অনুযায়ী, এবছর ক্ষীর তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ১০৫ মণ চাল,৯২ মণ গুড়,৬৬ মণ দুধ এবং ৫০০টি নারিকেল। রান্নার জন্য ২৫০টি চুলা স্থাপন করা হয়। এর পেছনে প্রায় ৬০০ পীরভক্ত ও ৩৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। রান্নার কাজ শেষ হলে জিকিরের মাহফিল শুরু হলে চারদিকের পরিবেশ গুঞ্জরিত হয়। মাহফিল শেষে ভক্তদের মধ্যে ক্ষীর বিতরণ করা হয়।
আস্তানার ভাষ্য মতে,কালাই উপজেলার বেগুনগ্রামে হযরত খাজা শাহ মাওলানা মো. আব্দুল গফুর চিশতী বাংলা ১৩২৮ সালে আসেন। তার প্রচেষ্টা ও দিকনির্দেশনায় এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তব, চশমায়ে উলুম মাদ্রাসা এবং একটি আস্তানা। তিনি ১৩৮২ সালের ১৬ শ্রাবণ ইন্তেকাল করেন। পীরের তত্ত্বাবধানে তার অনুসারীরা প্রতি বছর নবান্ন উৎসবের আয়োজন করেন।
বৃহস্পতিবার(২১ নভেম্বর) বিকালে ও রাতে বেগুনগ্রাম আস্তানায় সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, কেউ নারিকেল ভাঙছেন,কেউ গুড় গলাচ্ছেন, আবার কেউ ক্ষীর রান্নার কাজে মগ্ন।এরইমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ আসতে শুরু করে।উৎসবকে ঘিরে পুরো বেগুনগ্রামে বসে একদিনের জমজমাট মেলা।রাস্তার দুই পাশে দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দোকান বসে। মেলায় বিক্রি হয় কাঠের খেলনা, হাতপাখা, মাটির ব্যাংক, টুল,পিরা হাড়ি-পাতিল প্রভৃতি। এছাড়াও আছে ঐতিহ্যবাহী নাগরদোলা ও চরকি।গ্রামের ঘরে ঘরে রান্না হয় মাংস,পায়েস এবং বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার। উৎসবের একেকটি পরিবার যেন হয়ে ওঠে উৎসবের অংশ।রান্নার কাজ শেষ হলে শুরু হয় জিকিরের মাহফিল,যা পুরো এলাকায় আধ্যাত্মিক পরিবেশ তৈরি করে। মাহফিল শেষে হাজার হাজার ভক্তের মধ্যে ক্ষীর বিতরণ করা হয়। প্রতিটি চুলার সামনে ছিল মানুষে মানুষে মেলবন্ধনের এক প্রাণবন্ত চিত্র।চিশতীয়া পীরের আস্তানার নবান্ন উৎসব কেবল একটি গ্রামীণ মেলা নয়,এটি বাংলার আধ্যাত্মিকতা ও ঐতিহ্যের এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন।
নবান্ন উৎসব কেবলমাত্র একটি অনুষ্ঠান নয়। এটি গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্য,সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব মিলনমেলা। এই আয়োজন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয় বলে এতো দূর থেকে এসেছি বলে জানান কুমিল্লার কাশিমপুর থেকে আগত আইনুল হোসেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মিনহাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান,“এই নবান্ন উৎসবের বয়স শত বছরের কাছাকাছি। প্রতিবছর এখানে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে।এটি গ্রামীণ সংস্কৃতিকে ধারণ করে আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করছে।”
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন,“ আমাদের পূর্বপুরুষের কাছে শুনেছি,পীরের আসার তিন বছরের মাথায় এই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। সেই ঐতিহ্য আজও চলছে।”
চিশতীয়া পীরের আস্তানার সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন মণ্ডল জানান,এই আস্তানা ১৩৭২ সালের ৬ কার্তিক উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে এটি ৩৭ শতক জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। প্রায় ৫০ বছর ধরে এই আস্তানার সকল কার্যক্রম মুরিদ ও ভক্তদের অনুদানের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়ে আসছে।
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :