প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের পরিচয় ও সুসম্পর্কের কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে আবু হানিফ তুষার ওরফে হানিফ মিয়া নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন(র্যাব)। মঙ্গলবার রাতে বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রসহ রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাবের একটি দল।
বুধবার (১৮ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
অভিযুক্ত হানিফ মিয়া প্রতারক চক্রের মূলহোতা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নিকটাত্মীয়ের মিথ্যা পরিচয় ও সুসম্পর্কের কথা বলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রাপ্তি, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন ও পদোন্নতি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়াসহ বিভিন্ন মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেছে হানিফ। তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অনেক সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে র্যাব বিভিন্ন ধরণের অপরাধীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে জোড়ালো ভূমিকা পালন করে আসছে। র্যাব বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গে নাম ও পরিচয় ভাঙ্গিয়ে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে চাকুরি দেয়া, গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি, বদলি বাণিজ্য, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ণমূলক প্রকল্পের টেন্ডার পাইয়ে দেয়াসহ বিভিন্ন ধরণের প্রতরণা ও মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে বিপুল অংকের টাকা আত্মসাৎকারী প্রতারক চক্রকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১ এর অভিযানে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা হতে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের নিকটাত্মীয় হিসেবে মিথ্যা পরিচয় ও সুসম্পর্কের কথা বলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রাপ্তি, গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন ও পদোন্নতি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি দেয়াসহ বিভিন্ন মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অংকের অর্থ আত্মসাৎকারী প্রতারক চক্রের মূলহোতা আবু হানিফ তুষার ওরফে হানিফ মিয়াকে বাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় উদ্ধার করা হয় ১টি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, এ্যামুনেশন, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত গাড়ী ও বিভিন্ন ভিডিও এবং এডিট করা ছবি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত বর্ণিত প্রতারণা সম্পর্কে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত আবু হানিফ দীর্ঘদিন যাবৎ প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের নিকটাত্মীয় হিসেবে মিথ্যা পরিচয় ও সুসম্পর্কের কথা বলে বিভিন্ন ধরণের প্রতারণা করে আসছিল। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন সংসদীয় আসনে মনোনয়ন প্রাপ্তির মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দাবি করে আসছিলেন। এছাড়াও গ্রেফতারকৃত আবু হানিফ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন ও পদোন্নতি, সরকারি চাকুরীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকুরী দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে জানা যায়। তিনি প্রতারণা করার জন্য বিভিন্ন সময় নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করতেন।
র্যাব জানিয়েছে, তিনি দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন বেনামী মোবাইল নম্বর প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নামে মোবাইলে সেভ করতেন। পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন এ্যাপস থেকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য সেজে সে নিজেই অথবা চক্রের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে ম্যাসেজ আদান-প্রদান করতেন। চ্যাটিং এ তারা আসন্ন সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাইয়ে দেয়া, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন ও পদোন্নতি, সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী দেয়া সংক্রান্ত ও বিভিন্ন অংকের অর্থ দাবি সংক্রান্ত বার্তা নিজেরাই নিজ চক্রের সদস্যদের সাথে আদান-প্রদান করতেন। তিনি বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সাথে নিজের ছবি এডিট করে বসাতেন এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নিকটাত্মীয়ের সাথে সুসর্ম্পক রয়েছে বলে মিথ্যা দাবি করে তা টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে প্রেরণ করতেন। তিন বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে ছবি তুলে তার টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে পাঠাতেন।
গ্রেফতারকৃতকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায় যে, তিনি বিভিন্ন সংসদীয় আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নাম ও মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে যাদের মনোনয়ন প্রাপ্তির সম্ভাবনা দোদুল্যমান/ক্ষীণ, তাদেরকে টার্গেট করতেন। পরবর্তীতে তাদের সাথে যোগাযোগ করে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের নিকটাত্মীয় হিসেবে মিথ্যা পরিচয় ও সুসম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করে মনোনয়ন প্রাপ্তির জন্য মোটা অংকের অর্থ দাবি করতেন। ক্ষেত্র বিশেষে, তিনি দামী গাড়ী করে দেশের বিভিন্ন স্থানে দামী হোটেলে টার্গেটকৃত ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করতেন। বিভিন্ন সংসদীয় আসনে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার জন্য ২০০-৩০০ কোটি টাকা দাবি করতেন। বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য তিনিবিদেশি বিভিন্ন মোবাইল নম্বর তার মোবাইলে সেভ করতেন এবং দেশের বাইরে অবস্থানরত চক্রের অন্য সদস্যদেরকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য সাজিয়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তির সাথে মোবাইলে কথাও বলিয়ে দিতেন। এছাড়াও, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন বা পদোন্নতি প্রাপ্তির মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তার নিকট বিপুল অংকের অর্থ দাবি করতেন। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি দেয়া, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পদ পাইয়ে দেয়াসহ বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিলেন। তিনি প্রতারণার মাধ্যমে ৩০ জনের অধিক ব্যক্তিকে চাকুরী পাইয়ে দিয়েছেন বলে জানান। সে প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট থেকে অদ্যাবধি প্রায় পাঁচ কোটি টাকার অধিক অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত আবু হানিফ এইচএসসি পাশ হলেও তিনি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী বিষয়ে স্নাতক ও স্নতকোত্তর সম্পন্ন করেছে বলে মিথ্যা পরিচয় দিতেন। তিনি ২০০৮ সালে মটরপার্টস এর ব্যবসার সাথে জড়িত হন। পরিবহণ সেক্টরে দেশের বিভিন্ন রুটে তুষার এন্টারপ্রাইজ পরিবহন নামে তার বেশ কয়েকটি বাস ও নিজের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য প্রাইভেট কার রয়েছে। তিনি ঢাকার নাখাল পাড়া এবং ধানমন্ডি এলাকায় দলীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছে বলে মিথ্যা প্রচার-প্রচারণা চালাতেন। ২০১৪ সাল পরবর্তী সময়ে একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রতারণার কার্যক্রম শুরু করেন।
র্যাব আরো জানায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কৌশলে রাজনৈতিবিদ, উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সাথে নিজের মিথ্যা পরিচয় দিয়ে পরিচিত হন। পরবর্তীতে সুসম্পর্ক তৈরি করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের অফিস বা কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে ঘনিষ্ঠ ছবি তুলে এবং প্রতারণার কাজে এই ছবিগুলো ব্যবহার করতেন। ২০১৫ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেইসবুক একাউন্ট খুলেন। বিভিন্ন সময়ে সে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সাথে, অনুষ্ঠান, সেমিনারে অংশগ্রহণ এবং দেশের বাহিরে বিভিন্ন সময় ভ্রমণ করে ছবি তুলে তা ফেইসবুকে আপলোডের মাধ্যমে তার ফেইসবুক একাউন্ট এর পরিচিতি ও দেশে-বিদেশে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করতেন। এছাড়াও তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান স্পন্সর করে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সান্নিধ্যে আসার চেষ্টা করতেন। তিনি প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমান জমি ও সম্পত্তির মালিক হয়েছে বলে জানা যায়। সে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে যুক্ত থাকায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক সংক্রান্ত বিষয়ে একাধিক মামলা রয়েছে এবং উক্ত মামলায় একাধিকবার কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়।
একুশে সংবাদ/এসআর
আপনার মতামত লিখুন :