বাংলা, উর্দু, হিন্দি, স্পেনিশ, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান ও ইংরেজিসহ মোট ১৮টি ভাষায় প্রায় ১০ হাজার গান গেয়েছেন রুনা লায়লা।রুনাকে নিয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান তথা গোটা উপমহাদেশে হুল্লোড় পড়ে গিয়েছিল।
উপমহাদেশের আধুনিক সংগীতের জীবন্ত কিংবদন্তি রুনা লায়লা। বাংলাদেশ নয়, ভারত উপমহাদেশের উজ্জ্বল নক্ষত্র তিনি। আজ এই শিল্পীর জন্মদিন। ৭১’র এ পা রাখলেন রুনা। ১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর সিলেটে এই কালজয়ী শিল্পীর জন্ম।
ভারতের প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক খুশবন্ত সিং বলেছিলেন, রুনাকে আমাদের দাও বিনিময়ে ফারাক্কা নাও। এক সময় শোনা যেত, এই কথাটি বলেছিলেন কাশ্মীরের রাজনীতিবিদ শেখ আবদুল্লাহ। কিন্তু এক সাক্ষাৎকারে এই ভুল ভেঙে দিয়েছেন রুনা লায়লা।
তিনি বলেন, এটা আবদুল্লাহ সাহেব বলেননি। বলেছিলেন খুশবন্ত সিং। ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক ছিলেন। তিনি কিন্তু খুব কম সময়ই প্রশংসা করতেন। সব সময় সমালোচনা করতেন। কিন্তু একবার আমার একটা কনসার্টে এসেছিলেন—সম্ভবত দিল্লিতে। পুরো অনুষ্ঠানে ছিলেন। কোনো মন্তব্য করলেন না।
আমার সঙ্গে দেখাও করেননি; কোনো কথাও বলেননি। কিন্তু তাঁর পত্রিকায় আমাকে নিয়ে অনেক কিছু লিখেছিলেন। এর মধ্যে ছিল, রুনা লায়লার গান শুধু শোনারই বিষয় না, দেখারও ব্যাপার আছে। তার পুরো অনুষ্ঠানটি দেখেছি। আমি শুধু একটা কথাই বলব বাংলাদেশ সরকারকে, ‘প্লিজ গিভ আস রুনা লায়লা, অ্যান্ড টেক অল দ্য ওয়াটার অব ফারাক্কা।
তবে ‘শের-ই-কাশ্মীর’খ্যাত রাজনীতিবিদ শেখ আবদুল্লাহর সঙ্গেও একটি বড় ঘটনা রয়েছে। সেখানকার শ্রীনগরে প্রথম হাসপাতাল নির্মাণ করতে একটি কনসার্টে বিনা পারিশ্রমিকে গেয়ে দিয়েছিলেন রুনা লায়লা। তা এখনও ওই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে।
এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে রুনা বলেছিলেন, শেখ আবদুল্লাহ তখন কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সম্ভবত ১৯৭৭ বা ১৯৭৮ সাল হবে। তখন শ্রীনগরে কোনো হাসপাতাল ছিল না। চিকিৎসা করতে চণ্ডীগড় বা দিল্লিতে যেতে হতো। তিনি একবার নিজের হাতে আমাকে চিঠি লিখলেন, শ্রীনগরে একটা হাসপাতালের জন্য তহবিল গঠন করতে চাই।
আপনি একটা গানের অনুষ্ঠান করে দেবেন? আপনার যা পারিশ্রমিক, তা আমাকে জানিয়ে দেবেন। আমি সেভাবে আয়োজন করব। আমি উত্তরে লিখলাম, আপনি এত বড় একজন মানুষ হয়ে আমাকে আমন্ত্রণ করেছেন এত ভালো একটা কাজের জন্য, এটা আমার জন্য অনেক আনন্দের। আমি কোনো পারিশ্রমিক নেব না। কোনো পেমেন্টের প্রশ্নই আসে না। আমি আসব আর বেড়িয়ে যাব আপনার হাসপাতালের জন্য অনুষ্ঠানে গান করব।
ব্যক্তিজীবনে বলিউডে নায়িকা হওয়ারও প্রস্তাব পেয়েছিলেন রুনা লায়লা। ভারতের বেশ কয়েকজনই এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। একবার তো স্বয়ং রাজ কাপুরের কাছ থেকে এমন আমন্ত্রণ এসেছিল। এক সাক্ষাৎকারে সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করে রুনা বলেছিলেন, ভারতের কয়েকজনই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে আছেন বি আর চোপড়া, রাজ কাপুর প্রমুখ।
রাজ কাপুর সাহেব একবার ফোন করেছিলেন। তখন তো ট্রাঙ্ক-কল করতে হতো। হঠাৎ একদিন অপারেটর বলছে, আপনার একটা ট্রাঙ্ক-কল আছে। কোত্থেকে? বলছে, বোম্বে থেকে। সে কথা বলতে পারছে না। বললাম, ফোন করেছে কে? বলে, রাজ কাপুর! রাজ কাপুর সাহেব ফোন করেছেন! বলে সে হাঁপাচ্ছে-এতটাই উত্তেজিত ছিল।
ভয়ে ভয়ে গিয়ে ফোন ধরলাম। বলছেন, ফোন করলাম আপনাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। বোম্বেতে আসেন। বললাম, আসব, কিন্তু কী ব্যাপারে! গান করাবেন? বললেন, গানও করবেন, আবার অন্য একটা আলাপও করব-সেটা ছবির ব্যাপারে। ঘটনাটা ঢাকায় আসার পর, তবে ১৯৭০-এর দশকেই। তাঁকে বললাম, ছবিতে তো অভিনয় করব না।
তবে গান-টান হলে আসতে আপত্তি নেই। বলছেন, আসুন, আমার অতিথি হয়ে থাকবেন। আমার বাড়িতে থাকেন বা হোটেলে থাকেন, আপনি যেখানে থাকতে চান, থাকবেন। পরে আর যাওয়া হয়নি। তিনি কয়েকবারই আমাকে অভিনয়ের জন্য অনুরোধ করেছেন। পরেও দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে কিন্তু কাজ আর করা হয়নি।
এছাড়া কলকাতার প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তী তাঁর মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করেছিলেন রুনা লায়লার প্রতি। কেননা তিনি তাঁর বড় ভক্ত। উচ্ছ্বসিত হয়ে নচিকেতা বলেছিলেন, রুনাজি সুফি, গজল, রোমান্টিক সব ধারার গানই করেন। কী অপূর্ব তাঁর গলা। আরেকটু আগে জন্মালে নিশ্চিত তাঁকে নিয়ে আমি পালিয়ে যেতাম।
শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে চলা আসার সময় সেখানকার চলচ্চিত্রের রথী-মহারথীরা রুনা লায়লাকে রেখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমস্ত লোভনীয় প্রস্তাব উপেক্ষা করে ১৯৭৪ সালে স্থায়ীভাবে রুনা লায়লা ফিরে এসেছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে।
একুশে সংবাদ/এএইচিবি/এস কে
আপনার মতামত লিখুন :