লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান শুধু যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর বিষয়টি এমন নয়, বরং দেশে যেটুকু বন এখনও অবশিষ্ট রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম এই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। ১৯২৫ সালে বনায়ন করে সৃষ্ট বনরাজি এখন ঘন প্রাকৃতিক বনের আকার ধারণ করেছে। এর আয়তন ১২৫০ হেক্টর। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে দেখা মেলে নানা বিরল প্রজাতির পশু পাখি ও বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদের। নানান জাতের উদ্ভিদ আর বন্যপ্রাণীর জন্য বিখ্যাত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। লাউয়াছড়ার আয়তন ১ হাজার ২৫০ হেক্টর । তবে বর্তমানে লাউয়াছড়ায় কি পরিমান বনভূমি আছে তা জানে না খোদ বন বিভাগ।
বিগত কয়েক দশকে বিগত সরকার দলের প্রভাব খাটিয়ে একটি নির্দিষ্ট গুষ্ঠি দখল করে নিয়েছে লাউয়াছড়ার চারিপাশ। বনের জমি দখল করে গড়ে তুলা হয়েছে চা-বাগান, লেবু-আনারস-বাগান, কটেজ, বাড়িসহ নানান স্থাপনা। বনের জমি নিজেদের দাবি করে কৌশলে মামলাও করে রেখেছে দখলদাররা।ফলে আইনি জটিলতায় দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না অবৈধভাবে দখলে থাকা লাউয়াছড়া বনের ভূমি। ফলে চরম হুমকিতে পড়েছে বন ও বন্যপ্রাণী। বনভূমি দখল ও বন উজাড়ের ফলে বন্যপ্রাণীদের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বনে খাদ্য সংকটের কারণে খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে চলে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। খাদ্য সংকটে লোকালয়ে চলে যাওয়া বন্যপ্রাণীর নির্মম মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
এদিকে দখলের দৌরাত্বে ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসছে লাউয়াছড়া। তবে কয়েক যুগ ধরে প্রভাবশালী মহলের বাধা, রক্তচক্ষু ও নানাবিদ কারণে বনটির প্রকৃত আয়তন পরিমাপ করতে পারেনি বন বিভাগ। তারা জানে না ঠিক কতটুকু জমি প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। তবে আশার বাণী হচ্ছে গত ৫ আগস্টে সরকার পতনের পর অবৈধভাবে দখলকৃত কিছু জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে সাবেক সরকারের কৃষি মন্ত্রী আব্দুস শহীদের দখলের কবল থেকে ৫ একর ভূমি উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও লাউয়াছড়ার অন্যান্য ভূমিখেকোদের অবৈধ দখলে থাকা ভূমির বিষয়ে রহস্যজনক কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছে বন বিভাগ। সূত্র বলছে লাউয়াছড়া বনের প্রায় ৭শ একর ভূমি ৩ যুগ আগেই চলে গেছে প্রভাবশালীদের দখলে ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের জীববৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়া বনটিকে সরকার ১৯৯৬ সালে ‘জাতীয় উদ্যান’ ঘোষণা করে। রেইন ফরেস্ট হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত এ বন বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য বিখ্যাত। উল্লুক ছাড়াও এ বনে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদসহ নানান জীবজন্তু। কিন্তু গত ২৮ বছরেও বনের সীমানা নির্ধারণ করতে পারেনি বন বিভাগ।স্থানীয়রা জানায়, জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণার পূর্ব থেকেই বনটিতে দখলের থাবা বসিয়েছে প্রভাবশালী মহল। নিজেদের জমির সঙ্গে বনের জমি দখলে নিয়ে বাড়িঘর তৈরি ও লেবু-আনারস-বাগানের সীমানা বর্ধিত করলেও প্রকৃতপক্ষে দখলের মহোৎসব শুরু হয়েছে ২০০৯ সাল থেকে।
সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য মো. আব্দুস শহীদ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন। পরের বছরই তিনি পূর্ণমন্ত্রী মর্যাদায় জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ মনোনীত হন। সে সময় তিনি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের স্টুডেন্ট ডরমিটরির পাশে কিছু জমি স্বল্পমূল্যে কিনে ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামে একটি চা-বাগান গড়ে তোলেন। অভিযোগ ওঠে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি নিজের কেনা স্বল্প জমির সঙ্গে লাউয়াছড়া উদ্যানের অনেকটা দখল করে চা-বাগানে যুক্ত করেছেন। সে সময় থেকেই বন বিভাগ বারবার জমি পরিমাপের উদ্যোগ নিয়েও করতে পারেনি। এরপর থেকেই মূলত লাউয়াছড়া বনভূমি দখলের মহোৎসব শুরু করে প্রভাবশালীরা।নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটি দখল-বেদখলে ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে প্রায় অর্ধেক আয়তনে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকবার বনটি ডিমারকেশনের (পরিমাপ) চেষ্টা করেও অদৃশ্য কারণে ব্যার্থ হয়েছে বন বিভাগ। এমনকি সম্ভব হয়নি দখলবাজদের উচ্ছেদ করা। কারণ দখলবাজরা প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগ বা পতিত সরকারদলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদের প্রভাবের কারণেই বন ডিমারকেশন (পরিমাপ) করা যায়নি। তাদের (দখলবাজদের) ভয়ে বন বিভাগই থাকত তটস্থ।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বন বিভাগ কিছুটা নড়েচড়ে বসে। শুরু করে বনের জমি উদ্ধার। গত ১৫ সেপ্টেম্বর সাবেক মন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদের ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামে চা-বাগানের দখলে থাকা প্রায় পাঁচ একর জমি উদ্ধার করে। গত ৩ নভেম্বর কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সদস্য বদরুল আলমের দখলে থাকা প্রায় চার একর ভূমি উদ্ধার করে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ।উদ্ধারকৃত ভূমিতে বন্য প্রাণীদের খাবার উপযুক্ত ফলদ বৃক্ষ রোপণ করা হয়।
বন বিভাগ যে চার একর বনভূমি উদ্ধার করেছে সে জমিতে লেবু চাষ করতেন শাহ আলম নামে একজন। তিনি শ্রীমঙ্গলের সিন্দুরখান ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিনি জানান, বদরুল আলম জেনারের কাছ থেকে ওই জমি পাঁচ বছরের জন্য লিজ নিয়ে লেবু চাষ করেছেন তিনি। অগ্রিম হিসেবে দুই বছরের জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। বাকি টাকা ধীরে ধীরে পরিশোধ করার কথা ছিল।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পরিবেশবাদী বলেন, ‘‘রক্ষিত বন এলাকার সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানেও এমন একটি কমিটি কাজ করছে। এ কমিটি প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা, সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে বৃক্ষনিধন ও পাচার রোধ, স্থানীয় প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক লাউয়াছড়ার বনভূমি অব্যাহত বেদখল বা জবরদখল রোধসহ বেশ কয়েকটি কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা। কিন্তু কমিটির সদস্য থাকা অবস্থায় বদরুল আলম জেনার নামে এক ব্যাক্তি নিজেই বনভূমি দখল করে নিয়েছেন। এ ছাড়া বনভূমি দখল করেছিলেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদও।
এককথায় বলা যায়, লাউয়াছড়া বনের ক্ষেত্রে ‘রক্ষকই ভক্ষক’। লাউয়াছড়া বনের ভূমি অবৈধভাবে দখল করে জীববৈচিত্র্য হুমকিতে ফেলার কারণে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তাদের শাস্তির দাবিও জানান তারা।’’ বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অবৈধ দখলদার ছাড়াও স্থানীয় তিন থেকে চারশ লোক বাদী হয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ৩৭০ একর জমির মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করেছে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ও বন ডিমারকেশন না হওয়া পর্যন্ত ঠিক কতটুকু জমি অবৈধ দখলে রয়েছে, আর কতটুকু জমি বন বিভাগের আওতায় রয়েছে, তা সঠিকভাবে বলা অসম্ভব। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দখলবাজদের চিহ্নিত করার কাজ চলমান। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বন ডিমারকেশন (পরিমাপ) করা হবে। ডিমারকেশন সম্পন্ন হলে প্রকৃত চিত্রটা জানা যাবে।’
সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জামিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘বনের জমি উদ্ধারের সময় কাউকে পাওয়া যায়নি। কেউ জমির মালিকানা দাবি করতেও আসেনি।’
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দুই দফায় বনের নয় একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা জমিতে বন্য প্রাণীর উপযোগী গাছের চারা লাগানো হয়েছে।’
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :