অবৈধ পথে ইউরোপ যাওয়া কোনভাবেই থামছে না। উন্নত ও স্বাচ্ছন্দ্য জীবনের জন্য সবাই দলবেঁধে ছুটছে ইউরোপ। শহর কি গ্রাম, উচ্চ শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত সবার উদ্দেশ্য বিদেশ গিয়ে সংসারে সচ্ছলতা আনা। হাজার হাজার বাংলাদেশি তরুণ মৃত্যুঝুঁকি জেনেও ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে। তাদের ধারণা ইউরোপ যাওয়া মানেই উন্নত জীবন নিশ্চিত। এই বদ্ধমূল ধারণা থেকেই ইউরোপ যাওয়া বেড়েই যাচ্ছে। এই যাত্রায় শিক্ষিত বেকাররাই বেশি, যারা লেখাপড়া শেষ করে সংসারের হাল ধরতে পারছে না। তারা হতাশাগ্রস্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে ইউরোপ যাচ্ছে। এছাড়া বুয়েট, মেডিকেল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষার সুযোগে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে ইউরোপে যেতে পারলে তার অধিকাংশই আর দেশে ফেরত আসছেন না।
একটি তথ্য জানা দরকার, ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৪৭ হাজার ৪২৫ জন অভিবাসন প্রত্যাশী অবৈধ পথে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে ৪৪ হাজার ৯৩ জন এসেছে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচএসিআরের তথ্য মতে, মোট অভিবাসনপ্রত্যাশীর ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ বাংলাদেশি। ইউরোপের সীমান্তরক্ষী সংস্থা ফ্রন্টেক্স জানায়, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী ইতালি, স্পেন এবং গ্রিসে পৌঁছেছেন এবং ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে অনেক বাংলাদেশি মারা যাচ্ছে।
সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার ঠাকুরভোগ গ্রামের স্থানীয় এক কলেজে স্নাতক শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত তানিল আহমদ (২২) অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার পথে তুরস্কের বরফঢাকা অঞ্চলে ঠান্ডায় জমে মারা যায়। পরিবারে সচ্ছলতার ফিরাতে সে পাড়ি জমিয়েছিল ইউরোপ।
এ রকম হাজারো বাংলাদেশী অবৈধভাবে দালালদের খপ্পরে পড়ে নৌপথে গ্রিসে যাওয়ার চেষ্টায় নৌকা ডুবে সাগরে মারা যাচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নদীপথ থেকেই ফেরত পাঠাচ্ছে। যদিও ইউরোপের দেশগুলোতে বৈধভাবে অভিবাসনের অনেক সুযোগ রয়েছে, তবুও তারা দালালদের খপ্পরে পড়ে অবৈধ প্রক্রিয়াকে বেছে নিচ্ছে। তাদের মাধ্যমে বিকল্প পথে তৃতীয় দেশ হয়ে সমুদ্র পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢোকার চেষ্টা করে নিজেরা বিপদে পড়ছেন, সেই সঙ্গে দেশের সুনামও ক্ষুণ্ন করছেন।
ইউরোপে গিয়ে যেসব সুবিধা কিংবা জীবনকে অতি মাত্রায় নিরাপদ ভাবে সেই কারণগুলো সরকারকে উদঘাটন করে বাংলাদেশেও সে সব প্রযুক্তিনির্ভর ও নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারলে উচ্চশিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে আসবে বলে মনে করি।
সমুদ্রপথে মৃত্যু ঝুঁকি জেনেও এদেশের বেকার যুবকেরা ইতালি যাচ্ছে। এ ঘটনায় বাড়ছে প্রাণহানি। গত ১০ বছরে প্রাণহানির ঘটনার ঘটেছে শতাধিক। দালালের প্রলোভনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুবকরা সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়েই পড়ছে মৃত্যুর মুখে। গেল ১০ বছরে মাদারীপুরে ৩২৯টি মানবপাচারের মামলা হলেও একটিরও বিচার হয়নি। ফলে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে দালালচক্র, এমন মত অপরাধ বিশ্লেষকদের। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুললেই এই অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব বলে দাবি পুলিশের।
ভুক্তভোগী পরিবার ও বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে জানা গেছে, কোনোভাবেই থামছে না অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে বাড়ছে প্রাণহানি। গেল ১০ বছরে তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবিতে মারা যাওয়াদের মধ্যে মাদারীপুরের রয়েছে শতাধিক যুবক। এখনও নিখোঁজ অনেকেই। সবশেষ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তিউনিসিয়ায় নৌকায় আগুন ধরে মারা যাওয়া ৮ বাংলাদেশির মধ্যে ৫ জনই মাদারীপুরের বাসিন্দা।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দালালচক্রকে নির্মূল না করায়, একের পর এক নৌকাডুবিতে মারা যাচ্ছে মানুষ। প্রতিরোধে প্রয়োজন জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকতা আর সচেতনতা বৃদ্ধি করা। জেলা পুলিশের তথ্য মতে, গেল ১০ বছরে মাদারীপুরে ৩২৯টি মানবপাচারের মামলা হয়েছে। এরমধ্যে মীমাংসা হয়েছে ১১১টি মামলার। বিচার হয়নি একটিরও। এমন দুর্ঘটনায় নিহতের স্বজনদের অনেক সময় মামলাও করতে দেয়নি দালালচক্র। সামান্য কিছু টাকা দিয়ে মীমাংসার চেষ্টা চালায় তারা। এতে কমছে না এমন দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা।
একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৩-২০২৩ এই ১০ বছরে মাদারীপুরে আদালত ও থানায় মানবপাচারের মোট মামলা হয়েছে ৩২৯টি। এরমধ্যে জেলার বিভিন্ন থানায় মামলার সংখ্যা ২৯২টি এবং আদালতে ৩৭টি মামলা করা হয়। মামলায় মোট আসামি ১ হাজার ৪৬৬ জন হলেও গ্রেফতার হয় মাত্র ২৮৭ জন। আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয় ৯৬টি মামলার, আর আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা পড়ে ৮৭টি মামলার। এছাড়া এখন পর্যন্ত ১১১টি মামলা মীমাংসা হওয়ায় বাদী মামলা প্রত্যাহার করেছেন। গত ১০ বছরে অবৈধ পথে ইতালি পাড়ি জমিয়েছে ৫ হাজার ৫০০ জন।
মানবধিকারকর্মীরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে অবৈধপথে ইতালিতে যাওয়ার সময় মাদারীপুরের যুবকরা মৃত্যুর মুখে পড়ে। মারাও গেছে অনেক। দালালদের বিচার না হওয়ার কারণেই এই অপরাধ কমছে না। মানবপাচারের ঘটনায় দালালদের কঠিন বিচার হলে সমাজ থেকে এই অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব।
মাদারীপুর আদালতের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এলাকাভিত্তিক গড়ে উঠেছে দালালচক্র। এই চক্রটি শক্তিশালী হওয়ায় বাদীকে অনেক সময় মামলা তুলে নিতে ভয়ভীতি দেখায়। এতে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে দালালরা।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মাসুদ আলম বলেন, শুধু আইনের প্রয়োগ করেই দালালকে নির্মূল করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন, পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের সচেতনা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে সমাজ থেকে দালাল নির্মূল হবে। এছাড়া মানবপাচার মামলায় অনেক দালাল গ্রেফতারের পর জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও একই কাজে লিপ্ত হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুললেই এই ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হবে না।
সাগরপথে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার তালিকায় ফের শীর্ষে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থ্া ইউএনএইচসিআরের তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সাগরপথে ইতালি প্রবেশকারীদের মধ্যে ২৩ শতাংশই বাংলাদেশী। ঝুঁঁকিপূর্ণ এ পথ পাড়ি দেয়ার সময় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যেও বাংলাদেশি নাগরিকদের সংখ্যা কম নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষ জনশক্তি তৈরির পাশাপাশি মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপই পারে অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করতে।
উত্তাল সাগরে ছোট্ট ভঙ্গুর নৌকায় গাদাগাদি করে অনেক মানুষ, সবাই লক্ষ্য ইউরোপের উন্নত কোনো দেশ। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছেন এই অভিবাসন প্রত্যাশীরা। বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের সঙ্গে এই নৌকায় রয়েছেন বাংলাদেশীরাও।
ইউএনএইচসিআর বলছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১৭ হাজার ১৬৯ জন সমুদ্রপথে ইতালি প্রবেশ করেছেন। এরমধ্যে বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা ২ হাজার ৬৭০ জন। এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশকে সমুদ্র পাড়ি দেয়ার তালিকায় শীর্ষে রেখেছে।
তবে সবাই সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছাতে পারে না। পথেই নৌকা ডুবে বা উত্তাল ঢেউয়ের তোড়ে অনেকেরই মৃত্যু হয় ভূমধ্যসাগরে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম’র প্রতিবেদন বলছে, সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার সময় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ১২ শতাংশ বাংলাদেশি। ৩ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে দালাল চক্রের হাত ধরে নানা পথ ঘুরে ইউরোপের পথে পা বাড়ায় বাংলাদেশীরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, অবৈধ এই পথ বন্ধ করতে প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ।
কক্সবাজারের টেকনাফে বঙ্গোপসাগর উপকূলে ২০২২ সালে মধ্যরাতে শতাধিক রোহিঙ্গা নিয়ে অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে একটি ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছে। ডুবে যাওয়া ট্রলারের ৩১ রোহিঙ্গা যাত্রী সাঁতার কেটে টেকনাফের বাহারছড়া সৈকতে ফেরেন। পরে পুলিশ ও কোস্টগার্ড বাহিনী তাঁদের হেফাজতে নিয়েছে।
টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ি তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেন, টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের বাইন্যাপাড়া ও হলবনিয়া সমুদ্রসৈকত দিয়ে গ্রামে আসেন ৩১ জন রোহিঙ্গা। তাদের মধ্যে দুইজন নারীও আছেন।
ওই রোহিঙ্গাদের একজন আবদুর রহিম বলেছিলেন গভীর সমুদ্রে একটি বড় জাহাজ অপেক্ষা করছিল। ওই জাহাজে ওঠানোর কথা বলে তিন দিন আগে দালাল চক্র শতাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে উখিয়ার কুতুপালং, লম্বাশিয়া, বালুখালী, মধুরছড়া ক্যাম্প থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আসে টেকনাফের বাহারছড়া গ্রামে। গতকাল মধ্যরাতে বাহারছড়া সৈকতের বাইন্যাপাড়া ও হলবনিয়া এলাকা নিয়ে শতাধিক রোহিঙ্গাকে একটি ট্রলারে ওঠানো হয়। সাগর উত্তাল থাকায় ট্রলারটি দুলছিল, কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে ঢেউয়ের ধাক্কায় ট্রলারটি ডুবে যায়। এ সময় কিছু রোহিঙ্গা প্লাস্টিকের গ্যালন, কাঠের তক্তায় ভেসে ও সাঁতরে উপকূলে উঠতে সক্ষম হন। তবে অনেকে নিখোঁজ আছেন।
২০২৩ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ প্রবেশে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ ছিল। ২০২২ সালে ছিল তৃতীয়। এবার ফের তিন মাসে আবার শীর্ষে বাংলাদেশ।
আপনার মতামত লিখুন :