চলছে পবিত্র মাহে রমজান। সাধারণত পবিত্র রমজান মাসে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পাশাপাশি আমাদের খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের একটি ব্যাপক পরিবর্তন চলে আসে।সেই সাথে পরিবর্তন চলে আসে আমাদের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেওয়ার নিয়মকানুনেও। শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতই মুখের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে দাঁত। অন্যান্য সময়ের মতোই রমজান মাসে দাঁতের যত্ন নেয়া অত্যন্ত জরুরি।

এ ব্যাপারে একুশে সংবাদ.কমের সঙ্গে কথা বলেছেন ডা: সানজির হাওলাদার মিলভা,ডেন্টাল সার্জন।
যেহেতু রোজা রাখার কারণে দিনের পুরোটা সময় পানাহার থেকে বিরত থাকা হয় তাই এ রমজান মাসে অনেকেই দাঁত ও মাড়ির পরিচর্যা নিয়ে ভাবনায় পড়েন যে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না। এ মাসে দাঁতের ও মাড়ির যত্নে কী করা উচিত, কী কী সমস্যা হয়ে থাকে সাধারণত, কখন দাঁত ব্রাশ করা উচিত বা মাউথওয়াশ ব্যবহার করা যাবে কী না প্রভৃতি নিয়ে অনেকের মনেই থাকে নানা প্রশ্ন ।
তাহলে চলুন প্রথমেই আমরা জেনে নেই দীর্ঘ সময় পানাহার থেকে বিরত থাকার জন্য কী কী সমস্যা দেখা যায়-
১. মুখে দুর্গন্ধ —
রমজানে মুখের প্রধান সমস্যা হল মুখ থেকে দুর্গন্ধ আসে। মূলত মুখে দুর্গন্ধ হওয়ার জন্য দায়ী জমে থাকা খাদ্যকণা ও মুখের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সালফাইড ও অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হওয়া। অনেকে আবার অযথা বার বার থুতু ফেলেন। এটি মুখগহ্বরের স্বাভাবিক আর্দ্রতা নষ্ট করে। এতে মুখগহ্বর এ শুকনোভাব হয়। এ বিষয়টি দাঁত, মাড়ি, জিহ্ববা, মুখগহ্বর কিছুর জন্যই স্বাস্থ্যকর নয়। মুখগহ্বর শুকনো থাকার কারণে মুখে বাজে গন্ধ হয়ে থাকে। আবার অনেক সময় পেটের সমস্যা থাকলেও রোজায় অ্যাসিডিটি বা গ্যাসট্রিকের সমস্যার জন্য মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। এমন হলে পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। পেটের সমস্যা ছাড়া, নাক, কান বা গলায় প্রদাহের কারণেও দুর্গন্ধ হতে পারে, সেক্ষেত্রে নাক-কান-গলা অর্থাৎ ইএনটি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
২. দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত—
দাঁতের গোড়ায় পাথর থাকার কারণে মাড়িতে প্রদাহজনিত রোগ দেখা দেয়। এতে ব্রাশ করার সময় মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে। স্কেলিং করালে এ সমস্যা থেকে সহজেই বের হয়ে আসা যায়।রমজান মাসে দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পরা কিছুটা বেরে যায় যা ভিটামিন স্বল্পতার কারণে বেশি হয়ে থাকে।

চলুন এখন আমরা জেনে নেই দাঁত ও মাড়ি সুস্থ রাখার জন্য কিছু পরামর্শ—
পরামর্শ ১ —
যেহেতু রমজান মাসে খাওয়া দাওয়া শেষ করা হয় সেহরির মাধ্যমে সুতরাং দাঁত ব্রাসের সময়টাও পরিবর্তন করতে হবে। শেষ রাতে সেহরির পরে ইফতার পর্যন্ত, অর্থাৎ ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছু খাওয়া হয় না৷ ফলে দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা খাদ্যকণা পচে যাতে দুর্গন্ধ সৃষ্টি না করে সেজন্য সেহেরির পরে দাঁত ব্রাশ করেই ঘুমানো উচিত৷ আবার ইফতারের পরও একবার দাঁত ব্রাশ করে নেওয়া ভালো৷
পরামর্শ ২ —
ফ্লুরাইড যুক্ত টুথপেষ্ট দিয়ে সেহরির পরে ও ইফতারের পরে অবশ্যই দাঁত ব্রাশ করুন।এতে দাঁতে জমে থাকা খাদ্যকণা এবং মুখের গন্ধ দূর করতে পারে।অনেকেই দাঁত ব্রাশ করতে অস্বস্তি বোধ করে তাই মেসওয়াক ব্যবহার করে থাকেন। তবে মেসওয়াক ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে। তাড়াহুড়া করে মেসওয়াক ব্যবহার করা ঠিক নয়। এর মাথা যদি ক্রমাগত মাড়িতে আঘাত করতে থাকে তাহলে দাঁতের গোড়া থেকে মাড়িটি সরে যায় এবং এতে দাঁতের গোড়ায় শিরশির অনুভূতি হয়। তাই দাঁত ব্রাশ করুন অথবা মেসওয়াক করুন সাবধানে করতে হবে।
পরামর্শ ৩ —
সেহেরির পরে দাঁত ব্রাশ করার আগে কুলকুচি করে নিয়ে ‘ডেন্টাল ফ্লস’ দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে খাদ্যকণা যতটা সম্ভব বের করে নিন ৷ তারপর মাউথওয়াশ দিয়ে মুখ কুলকুচি করুন৷ মাউথওয়াশ সম্ভব হলে সেহরির পরে ও ইফতারের পরে ২ বেলা ব্যবহার করা যেতে পারে।
পরামর্শ ৪ —
রমজানে মুখে বাজে গন্ধ হওয়া খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। আমরা অনেকেই মনে করি বার বার মুখের থুতু ফেলে দিলে ভাল রোজার সময়। ধারনাটি একদম ভুল। বার বার প্রয়োজন ছাড়া থুতু ফেললে এটি মুখগহ্বরের স্বাভাবিক আর্দ্রতা নষ্ট করে। এতে মুখগহ্বর শুকনোভাব হয়। এ বিষয়টি দাঁত, মাড়ি, জিহ্ববা, মুখগহ্বর- কিছুর জন্যই স্বাস্থ্যকর নয়। মুখগহ্বর শুকনো থাকার কারণে মুখে বাজে গন্ধ হয়ে থাকে। আবার অনেক সময় জিহ্বার উপরে খাদ্যের প্রলেপ জমে যায়৷ একসময় সেখানে জীবাণু হয় এর ফলে মুখে দুর্গন্ধ হয়৷ এই সমস্যা থেকে দূরে থাকতে প্রতিদিন দু’বেলা দাঁত ব্রাশ করার পাশাপাশি টাং স্ক্র্যাপার দিয়ে জিব পরিষ্কার করতে হবে।

পরামর্শ ৫ —
রোজার সময় অনেকের দাঁত ব্রাশ করার সময় দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে৷ ভিটামিন স্বল্পতার কারনে মাড়ি থেকে রক্ত পড়তে পারে। ইফতারিতে প্রচুর ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন লেবুর শরবত, জাম্বুরা, কমলা লেবু, আমড়া, মাল্টা, আনারস সেই সাথে সালাদ যেমন গাজর, শসা, টমেটো, লেটুস পাতা ইত্যাদির সাথে লেবুর রস মিশিয়ে খাওয়া ভালো।
এছাড়াও দাঁতের গোড়ায় পাথর থাকার কারণেও দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়তে পারে আবার শারীরিক অন্যান্য রোগ থাকলেও দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়তে পারে। সেক্ষেএে একজন দন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
পরামর্শ ৬ —
রমজান মাসে ইফতারে ভাজাপোড়া বা বাহিরের খাবার একটু বেশি খাওয়া হয়ে থাকে এর সঙ্গে পিঁয়াজ, রসুনও একটু বেশি খাওয়া হয়৷ ভাজাপোড়া বা পেঁয়াজ-রসুন কম খেয়ে টাটকা ফল বা সালাদ বেশি খেলে ভালো হবে৷ ভাজাপোড়া স্বাস্থ্য ক্ষতির পাশাপাশি দাঁত ও মাড়ির ক্ষতির কারন হতে পারে।বিশেষ করে ভাজাপোড়া ও পিঁয়াজ-রসুনের কারণেও মুখে দুর্গন্ধ হয়ে থাকে। অবশ্যই পিঁয়াজ-রসুন খেলে সঙ্গে সঙ্গে দাঁত ব্রাশ করে নিতে হবে।
পরামর্শ ৭ —
রমজানে মিষ্টি জাতীয় খাবার একটু বেশি খাওয়া হয়ে থাকে। মিষ্টি খাওয়ার পরে কিন্তু দাঁত ব্রাশ করতেই হবে, কেননা,মিষ্টিতে যে শর্করা জাতীয় উপাদান থাকে তা দাঁতের এনামেলের ক্ষতি করে৷ তাই কোল্ড ড্রিংকস, চকলেট এবং অন্যান্য মিষ্টি জাতীয় খাবার থেকে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে।
পরামর্শ ৮ —
ইফতারের পর বিড়ি,সিগারেট,পান,জর্দা থেকে বিরত থাকতে হবে। এটি দাঁত ও মাড়ির ক্ষতির পাশাপাশি মুখের দুর্গন্ধকে বাড়িয়ে দেয়।
পরামর্শ ৯ —
রমজানে ইফতারের পর ও সাহরির আগে কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করতে হবে।পানি পানের মাধ্যমে মুখের আদ্রর্তা রক্ষা পায়। ফলে অনেক রোগ প্রতিরোধ হয় ও মুখের দুর্গন্ধ কমে যায়।
পরামর্শ ১০ —
চা এর কথা বললে অনেকের জন্য ইফতারের পর চা লাগবেই। তাদের জন্য বলব রোজার সময় দুধ চায়ের পরিবর্তে রং চা অথবা গ্রিন টি খেলে ভাল।
পরামর্শ ১১ —
অতিরিক্ত গরম বা ঠাণ্ডা খাবার পাকস্থলীর পাশাপাশি দাঁতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। রোজায় ইফতারের সময় অনেক ঠাণ্ডা পানীয় বেশি খাওয়া হয় তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বেশি বেশি শাক-সবজি এবং ভিটামিন সি এবং ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
পরামর্শ ১২ —
যারা ডেনচার অথবা রিটেইনার নিয়মিত ব্যবহার করেন, তা পরিষ্কার করে অ্যান্টিসেপটিক দ্রবণে ধুয়ে ব্যবহার করতে হবে।

রমজানে কি দাঁতের চিকিৎসা করা যাবে?
অবশ্যই করা যাবে।
লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে দাঁতের যে কোনো কাজ যেমন- সব ধরনের দাঁতের ফিলিং / গ্রাইন্ডিং / দাঁতের রুট ক্যানেল ট্রিটমেন্ট /দাঁতের ক্যাপ, ব্রিজ /দাঁত তোলা /আঁকাবাঁকা দাঁতের চিকিৎসা ইত্যাদি করা যাবে।এমনকি দাঁতের স্কেলিং ও করতে পারবেন রোজা রেখে। আজকাল অনেক আল্ট্রাসোনিক স্কেলার মেশিন চলে এসেছে যার মাধ্যমে স্কেলিং করলে রক্তপাত হয় না। রক্তহীন ও ব্যথাহীনভাবে করা যায়।তাই আপনারা রোজা রেখেও স্কেলিং, পলিশিং, দাঁত Whitening করতে পারবেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে কাজের সময় পানি যেন গলার ভেতর প্রবেশ না করতে পারে। দাঁতের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক এর ডোজ ঠিক করে নেবেন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী। তীব্র দাঁতের ব্যথায় রোজা রেখে ব্যথার ওষুধ তো খাওয়া যাবে না তবে ব্যথা কমানোর জন্য ইনজেকশন দিতে পারবেন এতে রোজা ভঙ্গ হবে না। যারা ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেসার, হার্ট এর এবং কিডনি সমস্যার জন্য নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন তারা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইফতারের পর থেকে সাহরি পর্যন্ত ডোজ ঠিক করে নেবেন।
মুখের সুস্বাস্থ্যের জন্য শুধু রমজানই নয় সারাবছর ই মুখের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন এতে আমাদের স্বাস্থ্যও যেমন ভালো থাকবে, তেমনি আপনাদের রোজাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। নিয়মিত ব্রাশ করুন ও একটি সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। বছরে ২ বার অন্তত ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
॥সবাই ভাল থাকবেন
॥ সুস্থ থাকবেন॥
ডা: সানজির হাওলাদার মিলভা।।
ডেন্টাল সার্জন
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :