নানা অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা শঙ্কা কাটিয়ে পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হচ্ছে আজ। অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের উৎখাতের পর প্রায় দুবছরের রাজনৈতিক নানা টানাপোড়েন ও অস্থিরতার পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ নির্বাচন।
অন্যদিকে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নির্বাচনের লড়াইয়ে আছেন। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এটি পাকিস্তানের সবচেয়ে কম বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হতে চলেছে। প্রার্থী, প্রচারণা এবং মতামত জরিপ সম্পর্কে কী বলা যেতে পারে সেগুলোসহ নির্বাচনের খবর কভারেজ সম্পর্কে কঠোর নিয়ম ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা পর্যন্ত বহাল থাকবে।
ফলাফল দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে। দেশটির প্রায় ২৫ কোটি জনসংখ্যার এ দেশটিতে প্রায় ১২ কোটি ৮০ লাখ নিবন্ধিত ভোটার ওইদিন পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্যদের বেছে নেবেন। ভোটগ্রহণ হবে বেলুচিস্তান, খাইবার পাখতুনখোয়া, পাঞ্জাব ও সিন্ধ - এ চার প্রাদেশিক সরকার নির্বাচনেও।
পাকিস্তানের এবারের নির্বাচনে প্রায় ১২ কোটি ৮০ লাখ ভোটার তাদের ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধিত হয়েছেন। যার প্রায় অর্ধেক ৩৫ বছরের কম বয়সী। তারা ৫ হাজারেরও বেশি প্রার্থীর মধ্য থেকে নতুন আইনপ্রণেতা নির্বাচন করবে। এসব প্রার্থীদের মধ্যে মাত্র ৩১৩ জন নারী।
পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) (পিএমএল-এন) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) -এই দুটি প্রধান দলই ভোটের লড়াইয়ে আছে। তবে ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পার্টি থেকে প্রার্থী বাছাই করা আরো কঠিন হয়ে পড়েছে, কারণ দলটির ক্রিকেট ব্যাট প্রতীক ব্যবহার করা নিষিদ্ধ হয়েছে। ভোটের লড়াইয়ে নির্বাচনী প্রতীক কার্যত প্রধান ভূমিকা পালন করে, সেটিও আবার এমন একটি দেশে যেখানে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ পড়তে অক্ষম।
পিটিআই অভিযোগ করেছে, নির্বাচনী প্রতীক ছিনিয়ে নেয়া ছাড়াও তাদের প্রার্থীদের জয়ী হওয়া ঠেকাতে অন্যান্য নানা কৌশলও ব্যবহার করা হয়েছে। যার মধ্যে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা, মিছিল-সমাবেশ করা নিষিদ্ধ করা এবং জোরপূর্বক লুকিয়ে থাকতে বাধ্য করার মতো বিষয়গুলোও রয়েছে।
এ দিকে ইমরান খান নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও তিনি বলছেন, ভোটারদের মাঝে তার আকাশচুম্বি জয়প্রিয়তায় ভাটা পড়েনি এবং এই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে তার দলই বড় জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসবে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) প্রার্থী নওয়াজ শরিফ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রার্থী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির মধ্যে। অবশ্য সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট নওয়াজ শরিফের দল সহজেই নির্বাচনী বৈতরণী পেরিয়ে সরকার গঠন করবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সেক্ষেত্রে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী পারেন দলটির কর্ণধার নওয়াজ শরিফ।
অবাধ ও সুষুম নির্বাচনের জন্য দেশটিতে প্রায় পাঁচ লাখ নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গ্রেফতারসহ নানা ধরনের বিতর্কিত ঘটনায় পাকিস্তানে এবারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর অন্তত দুজন প্রার্থীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া দেশজুড়ে একাধিক হামলার ঘটনার কথা জানা গেছে।
এদিকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ইমরান খানের বিরুদ্ধে ১৫০টির বেশি মামলা দেয়া হয়েছে। গত প্রায় দুই বছর ধরে এসব মামলা লড়ে যাচ্ছেন পিটিআইয়ের এই শীর্ষ নেতা। এর মধ্যে তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর মামলা দেয়া হয় গত বছরের মে মাসে। যে মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ২০২৩ সালের মে মাসে আল কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার করা হয় ইমরান খানকে। এরপর ৯ মে তার দলের কর্মীসমর্থকরা সরকারি অফিস ভাংচুর করে ও আগুন লাগিয়ে দেয়। পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদস দফতরসহ বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটিতেও হামলার ঘটনা ঘটে। সহিংসতায় ইমরান খানসহ পিটিআই’র শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনা হয়।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অ্যাক্টের ৫৯ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে এবং পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালায় তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যেতে পারে।
৯ মের সহিংসতা মামলার বিচারকার্য চলছে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে। তবে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট সামরিক আদালতের রায়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে এবং তাকে এই ঘটনার জন্য দায়ী করেছে। কিন্তু ইমরান খান তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, তার দল পিটিআই’র ভাবমূর্তী ক্ষুণ্ণ করতেই সহিংসতার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
ইমরান আরো বলেন, লন্ডনে বসে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়। এ বিষয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান মুসলিম লীগের নেতা নওয়াজ শরিফ ও পাক সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতায় বসাতেই এই চুক্তি করা হয়েছে।
অন্যদিকে পাকিস্তানে নির্বাচনের প্রাক্কালে জোড়া বোমা বিস্ফোরণে অন্তত ২৮ জন নিহত হয়েছে। বেলুচিস্তানে গত বুধবার এই বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সময় দুপুরে বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী কোয়েটা শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পিশিন জেলায় একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কার্যালয়ে প্রথম বিস্ফোরণটি ঘটে। প্রথম বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ পরই কিল্লা সাইফুল্লাহ শহরে জমিয়তে উলেমা-ই-ইসলাম ফজলের (জেইউআই-এফ) নির্বাচনী কার্যালয়ের সামনে দ্বিতীয় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের ৭৫ বছরের ইতিহাসে তিন দশকেরও বেশি সময় সরাসরি দেশ শাসন করেছে সেনাবাহিনী। এমনকি যখন বেসামরিক সরকার দেশের শাসন ক্ষমতায় তখনও পর্দার আড়াল থেকে দেশের ক্ষমতা কেন্দ্রের বেশিরভাগই তারাই নিয়ন্ত্রণ করেছে।
একুশে সংবাদ/এস কে
আপনার মতামত লিখুন :