ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের সংঘর্ষের মধ্যেই নতুন করে আলোচনায় আসে ইরান। গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে অবস্থিত ইরানি কনস্যুলেটে ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে বিপ্লবী গার্ডের দুই কমান্ডারসহ ৭ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিহত হন। সেই ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা চরম পর্যায়ে ওঠে। কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলার উপযুক্ত জবাব দিতে রোববার (১৪ এপ্রিল) রাতে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে তিনশরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। ইসরায়েল ভূখণ্ডে ইরানের হামলা নিয়ে যখন তুঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার পারদ, তখন আলোচনায় তেহরানের সমরভাণ্ডার। দুই দেশের মাঝে দীর্ঘ দূরত্ব থাকলেও তেল আবিবের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ, ইরানের কাছে থাকা দূরপাল্লার বিভিন্ন মিসাইল ড্রোন। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত হুমকি মোকাবেলায় দীর্ঘদিন ধরেই অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করছে তেহরান। যার মধ্যে অনেক সমরাস্ত্র ইসরায়েল তো বটেই, আঘাত হানতে সক্ষম মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো প্রান্তে।
মার্কিন গণমাধ্যমের দাবি, মাত্র ১২ মিনিটে ইরান থেকে ইসরায়েলে আঘাত হানতে পারে এমন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে তেহরানের কাছে। নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ক্রুজ মিসাইলের ইসরায়েলে আঘাত হানতে সময় লাগবে দুই ঘণ্টা। আর ড্রোন পাঠালে সেটি দেশটিতে পৌঁছাবে ৯ ঘণ্টায়। ইরানের হাতে রয়েছে নয়টি ব্যালিস্টিক মিসাইল। এসব ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো প্রান্তে হামলা চালাতে সক্ষম। দেখে নেয়া যাক সেসব মিসাইলের সক্ষমতা:
সেজিল মিসাইল:
সেজিল মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। যেটি ইরানের প্রযুক্তিতে তৈরি। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে এই ক্ষেপণাস্ত্রটির বিকাশ শুরু হয়। পূর্ববর্তী ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ‘জেলজাল এসআরবিএম’র নকশার আকারে এটি তৈরি বলে গণমাধ্যমের দাবি। সেজিল ক্ষেপণাস্ত্রটির দৈর্ঘ্য ১৮ মিটার এবং ব্যাস ১ দশমিক ২৫ মিটার। এর উৎক্ষেপণ ওজন ২৩ হাজার ৬০০ কেজি। ৭০০ কেজির পে-লোড বহনে সক্ষম সেজিল দুই হাজার কিলোমিটার দূর পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম।
খেইবার:
খেইবার ক্ষেপণাস্ত্রটি খোররামশহর-৪ নামেও পরিচিত। এটি চতুর্থ প্রজন্মের একটি ইরানি মাঝারি-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এটি আরব যুদ্ধের সময় মুসলমানদের জয় করা খাইবার দুর্গের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে।
ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৈরি ক্ষেপণাস্ত্রটি দুই হাজার কিলোমিটার দূর পর্যন্ত আঘাত করতে সক্ষম। খেইবার মিসাইল দেড় হাজার কেজি ওয়ারহেড বহন করার ক্ষমতা রাখে।
শাহাব-৩:
এটি মাঝারি-পাল্লার তরল জ্বালানির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। যা উত্তর কোরিয়ার নোডং-১ এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করেছে ইরান। ১২০০ পে-লোডে এটির পরিসীমা থাকে ১০০০ কিলোমিটার। আর হালকা পে-লোডে এর পরিসর থাকে ২০০০ কিলোমিটার। এটি প্রাথমিকভাবে বৃহৎ নরম লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে কার্যকর। ১০০০ থেকে ২০০০ কিলোমিটার পরিসরে এটি এক টন ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। শাহাব-৩ এর পরিচালনা করে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডস কোর (আইআরজিসি)।
ইমাদ:
ইমাদ হলো ইরানের প্রথম নির্ভুল-নির্দেশিত দূর-পাল্লার সারফেস-টু-সার্ফেস ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এটি শাহাব-৩ ক্ষেপণাস্ত্রের একটি রূপ, যেটি উত্তর কোরিয়ার নোডং ক্ষেপণাস্ত্রের আদলে তৈরি করা হয়েছিল। ইমাদের পরিসর প্রায় ১৭০০ কিলোমিটার। এর পে-লোড ক্ষমতা সাড়ে সাতশ কেজি। এটিকে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো বিশেষ করে ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখা হয়।
গদর:
গদর-১১০ ক্ষেপণাস্ত্রটি কদর-১১০ নামেও পরিচিত। মাঝারি-পাল্লার এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি ইরানেরই তৈরি। গদর হলো শাহাব-৩ এর উন্নত সংস্করণ। এটি আবার গদর-১০১ নামেও পরিচিত। এর রেঞ্জ ১৫০০ কিলোমিটার। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি তিনটি সিরিজে উৎপাদিত হয়। ১৩৫০ কিলোমিটার পরিসরে এর নাম ‘কদর-এস’, ১৬৫০ কিলোমিটার পরিসরের নাম ‘কদর এইচ’ এবং ১৯৫০ কিলোমিটার পরিসীমায় এর নাম ‘কদর এফ’।
কদর-১১০ সিরিজের মিসাইল ৬৫০ থেকে ১০০০ কেজি ওজনের ওয়ারহেড বহন করে। ‘কদর-এফ’ সবচেয়ে ভারী ওয়ারহেড বহন করে। এই মিসাইলটির দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৫ থেকে ১৬ দশমিক ৫৮ মিটার। সামগ্রিক ওজন ১৫ থেকে ১৭ দশমিক ৪৮ টন।
পাভেহ:
পাভেহ ইরানের তৈরি নতুন দূরপাল্লার ক্রুজ মিসাইল। ক্ষেপণাস্ত্রটি ইসলামী বিপ্লবী গার্ডস কোরের (আইআরজিসি) এরোস্পেস ফোর্সের প্রধান আমিরালি হাজিজাদেহ উন্মোচন করেছিলেন। এটির সীমা ১৬৫০ কিলোমিটার। এটি ইসরায়েল বা এই অঞ্চলে আমেরিকান লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।
ফাত্তাহ-২:
ফাত্তাহ-২ ইরানের তৈরি হাইপারসনিক মিসাইলের একটি নতুন সংস্করণ। এটি হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল (এইচজিভি) এবং হাইপারসনিক ক্রুজ মিসাইলের (এইচসিএম) সমন্বয়ে তৈরি। ভবিষ্যতে এর আরও সংস্করণ তৈরি হবে বলে ধারণা। ফাত্তাহ-২ ক্ষেপণাস্ত্র হাইপারসনিক ক্রুজ মিসাইলটির পরিসীমা ১৫০০ থেকে ১৮০০ কিলোমিটার। এটির ডিজাইন এমনভাবে করা যে, সহজেই এর শনাক্ত করা সম্ভব না। ফলে শত্রুদের চোখ ফাঁকি দিয়েই আঘাত হানতে সক্ষম।
ফাত্তাহ-২ এর দুটি অংশ নিয়ে গঠিত। প্রথম অংশটি হল ‘ফাত্তাহ সলিড ফুয়েল বুস্টার’। যা ক্ষেপণাস্ত্রটিকে মহাকাশ থেকে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় নিয়ে যায় এবং দ্বিতীয় অংশটি হল গ্লাইডিং ওয়ারহেড। এটি বুস্টার থেকে আলাদা হয়ে আঘাত হানে। এতে তরল জ্বালানির একটি রকেট ইঞ্জিনও রয়েছে। ফাত্তাহ-২ গ্লাইডিং ওয়ারহেডের সামগ্রিক আকৃতি বোয়িং এক্স-৫১ ক্ষেপণাস্ত্রের সমান।
খেইবার শেকন:
মাঝারি-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র শেইবার শেকনের পরিচালনায় রয়েছে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড কোরের অ্যারোস্পেস। ২০২২ সালে এটি উন্মোচন করা হয়। এটি কঠিন জ্বালানি ব্যবহার করে। এর পরিসীমা ১৪০০ কিলোমিটার। খেইবার শেকনকে নতুন প্রজন্মের এবং ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়নের রূপান্তর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খেইবার শেকান ক্ষেপণাস্ত্রের আলাদা বিস্তৃত লঞ্চার ব্যবহারের ক্ষমতা রয়েছে। এর জন্য ব্যবহৃত লঞ্চারটি ছদ্মবেশ ধারণ করে শত্রুদের চোখ ফাঁকি দিতে পারে।
হজ কাসেম:
যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় নিহত ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানির নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে। ২০২০ সালের আগস্ট থেকে এটি ইরানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাছে রয়েছে। হজ কাসেম ইরানের তৈরি মাঝারি-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর রেঞ্জ ১৪০০ কিলোমিটার। ওয়ারহেডের ওজন ৫০০ কেজি।
হজ কাসেম ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ফতেহ-১১০ এর নতুন প্রজন্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে গিয়ে আঘাত হানার ক্ষমতা রয়েছে এটির। এটিকে সহজেই শনাক্ত করা যায় না, ফলে শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার সক্ষম। এর ওজন ৭ টন।
একুশে সংবাদ/এ.ট.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :