মাত্র এক সপ্তাহ আগেও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের বিষয়টি ছিল প্রায় অচিন্তনীয়। কিন্তু সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চমকে দেওয়ার মতো পাল্টা আক্রমণ দুই সপ্তাহের কম সময়েই সব হিসাব-নিকাশ বদলে দিল। বিদ্রোহীদের ঘাঁটি সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমের শহর ইদলিব থেকে যে আক্রমণ শুরু হয়েছিল রাজধানী দামেস্ক দখলে তার পরিসমাপ্তি ঘটল।
বাশার আল-আসাদের পতনে সিরিয়ায় নতুন এক যুগের সূচনা হলো। বাবা হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর ২০০০ সালে দেশটির ক্ষমতায় আসেন বাশার। হাফিজ আল-আসাদ দেশটি শাসন করেন ২৯ বছর। ছেলের মতো তিনিও ছিলেন একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক। উত্তরাধিকারসূত্রে বাশার এমন এক শাসনব্যবস্থা পেয়েছিলেন, যেখানে শাসকের ইচ্ছাই সর্বশেষ কথা। বিরোধী মতের কোনো স্থান নেই।
প্রথম দিকে একটি প্রত্যাশা ছিল, তিনি হয়তো ভিন্ন হবেন-আরো খোলামেলা, তুলনামূলক কম নিষ্ঠুর। কিন্তু সেগুলো বেশি দিন টেকেনি।
২০১১ সালে তার সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন নৃশংসভাবে দমনের জন্য তাকে সব সময়ই মনে রাখা হবে। ওই ঘটনাই সিরিয়াকে গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। সেই যুদ্ধে পাঁচ লাখেরও অধিক মানুষ মারা যায় এবং শরণার্থীতে পরিণত হয় অন্তত ৬০ লাখ মানুষ।রাশিয়া ও ইরানের সহযোগিতা নিয়ে আসাদ বিদ্রোহীদের দমন করে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন।
রাশিয়া তার বিমানশক্তি ব্যবহার করেছিল, আর ইরান তার সামরিক উপদেষ্টা পাঠিয়েছিল সিরিয়ায়। পাশাপাশি ইরান সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহ তাদের প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের মোতায়েন করেছিল। কিন্তু এর কিছুই এবার ঘটেনি। তার সহযোগীরা নিজেদের বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। তারা আসাদকে কার্যত পরিত্যাগ করেছে।
অথচ তার সেনারা এদের সহযোগিতা ছাড়া অক্ষম। কিছু ক্ষেত্রে বিদ্রোহীদের থামাতে কার্যত তারা ছিল অনিচ্ছুক। এই বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)।
গত সপ্তাহে এইচটিএস প্রথমে আলেপ্পো দখল করে, কার্যত কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই। এটি সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এরপর তার কয়েক দিন পরই হামা, হোমস শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখলে নেয়। অন্যদিকে পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকেও এগিয়ে আসছিল বিদ্রোহীরা। ফলে অভিযানের এক পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দামেস্ক। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিদ্রোহী যোদ্ধারা রাজধানীতে প্রবেশ করে, যা ছিল আসাদের ক্ষমতার কেন্দ্র।
এদিকে আসাদ পরিবারের পাঁচ দশকের শাসনের অবসান আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে বদলে দিতে যাচ্ছে। সিরিয়ায় এই পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বড় ধরনের ধাক্কা খেল। আসাদের অধীনে সিরিয়া ছিল ইরানিদের সঙ্গে হিজবুল্লাহর যোগাযোগের অংশ। হিজবুল্লাহকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানোর জন্য এটা ছিল মূল পথ। হিজবুল্লাহ নিজেই ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে মারাত্মক দুর্বল হয়ে গেছে এবং তাদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ইরান সমর্থিত আরেকটি গোষ্ঠী হলো ইয়েমেনের হুতি। তারা বারবার বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। এসব গোষ্ঠীর সঙ্গে ইরাকের মিলিশিয়া ও গাজার হামাস—সব মিলিয়েই তেহরানের ভাষায় ‘প্রতিরোধের অক্ষ’, যা বর্তমানে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
এখন ওই অঞ্চলের নতুন চিত্র নিয়ে ইসরায়েলে উদযাপন হবে, যেখানে ইরানকে দেখা হবে অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে। অনেকে বিশ্বাস করেন, বিদ্রোহীদের এবারের অভিযান তুরস্কের আশীর্বাদ ছাড়া হয়নি। তারা অবশ্য সিরিয়ার কিছু বিদ্রোহীদের সমর্থন দিলেও এইচটিএসকে সমর্থনের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। কিছু সময়ের জন্য তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান কূটনৈতিক সমাধানের জন্য আলোচনায় বসার চাপ দিয়েছেন, যাতে করে সিরিয়ার শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরতে পারে। কমপক্ষে ৩০ লাখ সিরীয় শরণার্থী তুরস্কে অবস্থান করছে। এটা স্থানীয়ভাবে এখন স্পর্শকাতর ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বাশার আল-আসাদ তা করতে রাজি হচ্ছিলেন না। ফলে এখন আসাদের বিদায়ে অনেকেই খুশি। কিন্তু এরপর কী হবে?
অন্যদিকে এইচটিএসের উৎস হলো আল-কায়েদা। পাশাপাশি তাদের একটি সহিংস অতীত আছে। তারা কয়েক বছর ধরে জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে তাদের পরিচিত করানোর চেষ্টা করে আসছিল। তাদের সাম্প্রতিক বার্তাগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক ও সমঝোতামূলক সুর আছে। কিন্তু বহু মানুষই আছেন, যারা এতে আশ্বস্ত নন এবং তারা উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন এই ভেবে যে সরকার উৎখাতের পরই আসলে করণীয় ঠিক করবে বিদ্রোহীরা। একই সময়ে নাটকীয় এই পরিবর্তন ক্ষমতার বিপজ্জনক শূন্যতার দিকে ঠেলে দিতে পারে এবং এর ফলে আরো নৈরাজ্য, এমনকি আরো সহিংসতার জন্ম দিতে পারে।
সূত্র: বিবিসি
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :