বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সূচনা হওয়া ছাত্র আন্দোলন গত বছরের আগস্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল
আর সেখানে হাসিনার প্রয়াত পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ম্যুরালকে বিকৃত করে দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। অনেক বাংলাদেশি তাকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শ্রদ্ধা করলেও মুজিবের ম্যুরালের মুখে লাল রং ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিপ্লবের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকে উৎখাত করার মাত্র অর্ধ বছর পরে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের ইতিহাস আনুষ্ঠানিকভাবে পুনর্লিখন করছে। এখানে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবের ভূমিকাকে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এমন সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে যা তার ব্যক্তিত্বকে ঘিরে নির্মিত হয়েছিল।
হাসিনার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন ও বিদ্রোহে অংশ নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র মোহাম্মদ আবু বকের মজুমদার বলেন, “আমরা পুরো বিষয়টি নতুন করে লেখার চেষ্টা করছি না, তবে কিছু জিনিস দৃশ্যমান আছে যেগুলোর পরিবর্তন দরকার। আওয়ামী লীগ যা করেছে তা হলো গল্প, কবিতা ও শিল্পকর্মের মাধ্যমে একটি ভ্রান্ত মুজিববাদী আদর্শ তৈরি করা। আমরা ইতিহাসকে নির্ভুল ও শুদ্ধ করার চেষ্টা করছি।”
বাংলাদেশের জন্য পূর্ববর্তী রাজনৈতিক যুগের আখ্যান থেকে বের হয়ে নতুন করে একটি জাতীয় আখ্যানে ঐকমত্যে পৌঁছানো ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল-মতের আকাঙ্ক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেশের ঐতিহ্যবাহী এবং তিক্তভাবে বিরোধী রাজনৈতিক শিবির — শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল — উভয়ই ১৯৭১ সালের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণভাবে তুলে ধরে।
এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার বিচার বিভাগ, মিডিয়া এবং পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ব্যাপক সংস্কারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ হাসিনার দমনমূলক শাসনামলে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের কাছে এসব প্রতিষ্ঠান কার্যত ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ড. ইউনূসের সরকারের মুদ্রিত স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে মুজিবকে জাতির পিতার একক মর্যাদা থেকে অবনমিত করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে একসময় পেছনের কভারগুলোতে বিশিষ্টভাবে প্রদর্শিত হওয়া হাসিনার ছবি এবং উদ্ধৃতিগুলোও তারই (হাসিনার) উৎখাতের বিদ্রোহের সময়কার নানা গ্রাফিতির চিত্র দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
কিন্তু ইউনূসের সরকারের দেশকে পুনর্নির্মাণের এই প্রচেষ্টায় অনেক কঠিন বাধারও সম্মুখীন হতে হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে— উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিরুদ্ধে তথাকথিত হুমকির জন্য ভারতের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান। মূলত নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রমবর্ধমান আহ্বান রয়েছে। ইউনূসের সমালোচকরা অভিযোগ করেন, তার ছাত্র উপদেষ্টারা মৌলবাদী এবং ইসলামপন্থিদের প্রতি নমনীয়।
সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ আরাফাতের দাবি, “অধ্যাপক ইউনূস বলছেন— তিনি রিসেট বোতামে চাপ দিতে চান, এবং তিনি তা করছেন ইতিহাস বিকৃত করে এবং পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস সম্পর্কে মিথ্যাচার করে। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন, কিন্তু তারা তাকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে না পারায় তারা তাকে অন্যান্য নেতাদের সাথে রাখছেন।”
বিরোধী দল বিএনপিও ইতিহাস পুনর্বিবেচনার কাজটিকে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এবং এখন তার ছেলে তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত হিসেবে বিএনপির সভাপতিত্ব করছেন।
পাঠ্যপুস্তকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলোর মধ্যে একটি হলো— বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। পূর্ববর্তী সংস্করণগুলোতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কেবল শেখ মুজিবের ভূমিকার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হলেও ২০২৫ সালের সংস্করণে জিয়াউর রহমানের চট্টগ্রাম থেকে সম্প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এটাতে স্পষ্ট করা হয়েছে যে— তিনি মুজিবের পক্ষে এটি করেছিলেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ পাঠ্যপুস্তকে এই সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, “আমার গাইডলাইন ছিল, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির বর্ণনা দ্বারা পরিচালিত হবেন না।” পাঠ্যপুস্তকের এই সংশোধনকে তিনি বিরল এবং কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যা একবার বন্ধ হয়ে গেলে, সুযোগ আর কখনও নাও আসতে পারে।
এছাড়া সংশোধনীতে ভারতের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্যভাবে কম করা হয়েছে — আর এটি এমন একটি পদক্ষেপ যা সম্ভবত নয়াদিল্লির মনোযোগও আকর্ষণ করতে পারে। যদিও বেশিরভাগ শ্রেণির আপডেট হওয়া বইয়ের সংস্করণগুলোতে ৯ মাসের যুদ্ধের সমাপ্তির দিকে ভারতের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু পূর্ববর্তী পাঠ্যপুস্তকগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সহায়তা প্রদান, যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং লাখ লাখ উদ্বাস্তুকে আশ্রয় প্রদানসহ ভারতের অবদানের বিস্তৃত বর্ণনা হাজির করা হয়েছিল, যেই বর্ণনা এখন অনেকাংশেই অনুপস্থিত।
স্বাধীনতার সংগ্রামে শেখ মুজিবের কেন্দ্রীয় ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি বাংলাদেশিরা তার রেকর্ডের অন্যান্য দিক নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৪ সালে মারাত্মক দুর্ভিক্ষের সময়কার তার নেতৃত্বও রয়েছে। তারা সাম্প্রতিক নানা ঘটনাবলীও সামনে আনছেন, যার মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ শেখ হাসিনার অধীনে জোরপূর্বক গুমের বিভিন্ন ঘটনাও রয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাফকাত মুনির বলেছেন, বাংলাদেশের তরুণরা বলছেন— আপনাদের ১৯৭১ সালের দিকে তাকাতে হবে, কিন্তু আপনাদের ২০২৪ সালের দিকেও তাকাতে হবে। ১৯৭১ শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির অন্তর্গত বিষয় নয়।
বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে এখন নারী-নেতৃত্বাধীন সংগঠন “মায়ের ডাক”-এর কথাও রয়েছে। জোরপূর্বক গুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে এবং নিখোঁজদের সন্ধান দায়ীদের বিচারের দাবিতে ২০১৪ সালে এই সংগঠনটি গঠিত হয়েছিল।
ফ্রান্সের অ্যাকাডেমি ফ্রাঙ্কেসের সমতুল্য বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির সভাপতি আবুল কাশেম ফজলুল হক বলছেন, “গত ১৫ বছরে যা ঘটেছে... তা এখন প্রকাশ্যে আসছে: জোরপূর্বক গুম, গোপন নির্যাতন সেল, যাদের হত্যা করা হয়েছিল এবং তাদের লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এখন লোকেরা সেইসব গুম ও নির্যাতনের গল্পগুলো জানতে পারছে।”
সূত্র: ফিনান্সিয়াল টাইমস।
একুশে সংবাদ/ঢ.প/এনএস
আপনার মতামত লিখুন :