এক যুদ্ধে এত ব্যয়! চোখ কপালে ওঠার মতো। ইউক্রেন যুদ্ধে গত তিন বছরে ব্যয় হয়েছে ৩২০ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৯ লাখ কোটি টাকা! বাংলাদেশের সর্বশেষ বাজেটের তুলনায় এটি প্রায় ৬ গুণ।এই বিপুল পরিমাণ অর্থের অর্ধেকের বেশি টাকা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ।
কিন্তু আজ মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ইউক্রেন আর কোনো ধরনের সহায়তা পাঠাবেন না। এমন আশঙ্কা অবশ্য ট্রাম্প–জেলেনস্কির ঝগড়ার পর থেকেই বাতাসে ভাসছিল। জল্পনা–কল্পনা ডালপালা ছড়াচ্ছিল। অবশেষে তা সত্যে পরিণত হলো।
মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, ট্রাম্প যতক্ষণ না নিশ্চিত হন যে, দেশটির (ইউক্রেন) নেতারা শান্তির প্রতি সদিচ্ছার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য সকল সামরিক সহায়তা স্থগিত রাখবে।
কেন এমন সিদ্ধান্ত? এর পেছনে অনুঘটকের সূচনা গত ২৮ ফেব্রুয়ারিতে। ওই দিন ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ইউক্রেনের বিরল খনিজ নিয়ে চুক্তি করতে বৈঠকে বসেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। বৈঠকে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গ উঠলে এক সময় তীব্র বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন এই দুই বিশ্বনেতা। সঙ্গে যোগ দেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও।
এই নজিরবিহীন অপ্রীতিকর ঝগড়ার পর প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ওভাল অফিস থেকে চলে যেতে বলা হয়। ফলে বিরল খনিজচুক্তি বাতিল হয়ে যায়। বাতিল করা হয় ট্রাম্প–জেলেনস্কির যৌথ সংবাদ সম্মেলনও।এ ঘটনার পরপরই বাতাসে জল্পনা–কল্পনা ডানা মেলতে থাকে যে, ট্রাম্পের মুখে মুখে তর্ক করার খেসারত জেলেনস্কিকে অবশ্যই দিতে হবে। ট্রাম্প সম্ভবত ইউক্রেনে সকল সহায়তা বন্ধ করে দেবেন।শেষ পর্যন্ত হলোও তাই। ট্রাম্প ইউক্রেনে সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দিলেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমস বলছে, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গত তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ১৭৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তার অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১২০ বিলিয়ন ডলার সরাসরি সহায়তা দেওয়া হয়েছে; যার মধ্যে রয়েছে ৬৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা, ৪৯ বিলিয়ন আর্থিক সহায়তা এবং ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন মানবিক সহায়তা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও ১৭৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার তথ্য রয়েছে।
অন্যদিকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান বলছে, এখনো ৩ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা ইউক্রেনে পাঠানোর অপেক্ষায় রয়েছে। এই সহায়তা পাঠানোর অনুমোদন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশাসনই দিয়ে গেছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর বিষয়টি ঝুলে যায় এবং শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প নিজের নির্বাহী ক্ষমতাবলে সকল সামরিক সহায়তা পাঠানো বন্ধই করে দিলেন। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এসব ইউক্রেনে পাঠানোর কথা ছিল।
ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউক্রেনে আর কোনো রাডার, যানবাহন, গোলাবারুদ ও ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করা হবে না। কারণ এসবই ছিল মার্কিন সামরিক সহায়তার আওতায়।নিউইয়র্ক টাইমস আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছে, ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনের জন্য পরোক্ষ সহায়তাও বন্ধ করতে দিতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে—সামরিক অর্থায়ন, গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি, ইউক্রেনীয় সেনা ও পাইলটদের প্রশিক্ষণ এবং জার্মানির একটি ঘাঁটি থেকে আন্তর্জাতিক সাহায্যের মার্কিন সামরিক সমন্বয়।
সত্যি সত্যিই যদি এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে জেলেনস্কি কীভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন? তিনি অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাবেন কোথায়? এরই মধ্যে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকোর একটি ঘোষণা। গত ২ মার্চ তিনি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে পোস্ট করা একটি খোলা চিঠিতে লিখেছেন, ‘স্লোভাকিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ইউক্রেনকে আর্থিক বা সামরিকভাবে সমর্থন করবে না। যদি অন্যরা এটি করতে চায় তবে আমরা সেটিকে সম্মান করব।’
এর অর্থ হচ্ছে, ইউক্রেনের পাশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য মিত্ররাও একে একে সরে যেতে পারে। স্লোভাকিয়া হয়তো সেই সূচনাই করল।শেষ পর্যন্ত যদি এমন ঘটনা ঘটেই, তবে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তার প্রাথমিক উৎস হবে ইউক্রেন ডিফেন্স কন্টাক্ট গ্রুপ (ইউডিসিজি)। ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য ২০২২ সালে ৫০টি দেশ মিলে এই জোট গঠন করেছে। জোটটির নেতৃত্বে এখনো রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে সেখান থেকে সহজে সহায়তা পাওয়ার বিষয়টিও বিলম্বিত হতে পারে।
জেলেনস্কির জন্য এখন সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় একমাত্র আশার আলো হচ্ছে ইউরোপ। এরই মধ্যে ইউরোপের নেতারা অবশ্য তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ইউক্রেন সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করতে গত রোববার লন্ডনে সম্মেলন ডেকেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পোল্যান্ড, সুইডেন, তুরস্ক, নরওয়ে, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, রোমানিয়া, ফিনল্যান্ড, ইতালি, স্পেন ও কানাডাসহ ১৮টি দেশের নেতা উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জেলেনস্কিও।বৈঠক শেষে কিয়ার স্টারমার ইউক্রেনকে ২ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
তবে যুক্তরাজ্যের এসব সহায়তা যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার অভাব পূরণ করতে পারবে না। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা নিজেরাই স্বীকার করেছেন, তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে যেসব সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার হচ্ছে, তার ২০ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা বলেন, ‘এই যুদ্ধে ইউক্রেন বাহিনীর যেসব সমরাস্ত্র সবচেয়ে কার্যকর হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সমরাস্ত্রগুলোই রয়েছে। সেগুলোর অভাব ইউরোপ বা অন্য কোনো জায়গা থেকে পূরণ করা সম্ভব নয়।’
লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক র্যাচেল এলেহুস বিবিসিকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বিশেষ করে তিনটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলো আকাশ প্রতিরক্ষা, যেখানে প্যাট্রিয়ট ব্যবস্থার বিকল্প ইউরোপে তেমন একটা নেই; দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, এ ক্ষেত্রে জার্মানি তাদের টরাস ক্ষেপণাস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আর ফ্রাঙ্কো–ব্রিটিশ স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্রের সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে; এবং তৃতীয়ত, স্যাটেলাইট যোগাযোগ, যেখানে ইলন মাস্কের স্টারলিংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’
সবচেয়ে বড় বিষয়, যুদ্ধের ব্যয় বহন করা। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১৭৫ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছে ইউক্রেনকে। এর বাইরে ইউরোপীয় দেশগুলোর সামরিক সহায়তা খুব বেশি নয়। জার্মানির কিয়েল ইনস্টিটিউট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমির হিসাবমতে, ইউরোপের দেওয়া সামরিক সহায়তার পরিমাণ ৬৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। অন্যদিকে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো নিরাপত্তা খাতে ব্যয় করার জন্য ইউক্রেনকে দিয়েছে ৫১ বিলিয়ন ডলার।
জেলেনস্কি দাবি করেছেন, এখন পর্যন্ত ইউক্রেন যুদ্ধে ৩২০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ইউক্রেন নিজে খরচ করেছে ১২০ বিলিয়ন ডলার, বাকিটা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো। বাংলাদেশি মুদ্রায় হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৩৮ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যার প্রায় অর্ধেকই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে সহায়তা দেওয়া বন্ধ করায় সেই অভাব পূরণ করতে ইউরোপকে এখন দ্বিগুণ অর্থ ঢালতে হবে। ইউরোপ কি শেষ পর্যন্ত এত বড় ঝুঁকি নেবে?
তথ্যসূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, বিবিসি, গার্ডিয়ান, ইকোনমিক টাইমস ও মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :