আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের আন্দোলনকে দমানো, ভিন্নমতকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখা এবং সেই সুযোগে ভোটে সুবিধা নিতেই গায়েবি মামলা করা।
তারা বলেছেন, যেসব আইন এবং ধারায় মামলাগুলো হচ্ছে, তাতে শাস্তির মাত্রা বেশি এবং দ্রুত শাস্তি দেওয়া যায়। জামিনও পাওয়া সম্ভব হয় না। এর ফলে বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে এসব মামলায় আসামি করে সহজেই আন্দোলনের বাইরে রাখা যায়।
রোববার (৭ আগস্ট) সকালে ‘ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ’ এর আয়োজিত ‘গায়েবি মামলা ও আগামী নির্বাচন’ শীর্ষক ওয়েবিনারে তারা এসব কথা বলেন।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন, অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র আইন কর্মকর্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রিদওয়ানুল হক ও বিডিনিউজের সিনিয়র রিপোর্টার গোলাম মর্তুজা অন্তু। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সমাপনী বক্তব্য দেন ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জাহেদ উর রহমান।
বিচারপতি মতিন বলেন, ‘গায়েবি মামলাগুলো অসাংবিধানিক এবং আইনের পরিপন্থি। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমি আশঙ্কা প্রকাশ করছি, তাদের কী হবে? তারা কি জঙ্গলে গিয়ে বাস করবে? এর প্রতিকার হওয়া উচিত। এর বিরুদ্ধে সবার কথা বলা উচিত। নিজেদের স্থান থেকে এগিয়ে আসা উচিত।’
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘গায়েবি মামলাগুলো শুধু বিরোধী দলের নেতাকর্মীর নামে করা হয়। বেশির ভাগ মামলাই সম্পূর্ণ বানোয়াট। এসব মামলা করে মূলত পুলিশ কিংবা তার সোর্স। সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক নেতারা এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। এসব মামলায় বিপুল সংখ্যক মানুষকে আসামি করা হয়। আবার কিছু সংখ্যক অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়। এর মুখ্য উদ্দেশ্যই হচ্ছে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে বা গ্রেপ্তার করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে এলাকাছাড়া করা কিংবা ভীতসন্ত্রস্ত রাখা, যাতে তারা এলাকায় প্রবেশ না করে। উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে নির্বাচনের আগেই এ ধরনের মামলা বেশি বেশি করা হয়, যাতে সরকারি দল নির্বাচনে অবাধে কারচুপি ও অনিয়ম করতে পারে। এ ছাড়া বিরোধী দলগুলো বড় কোনো কর্মসূচি দিলেও এ ধরনের মামলা করা হয়।’
২০১৮ সালে গায়েবি মামলার বিষয়ে হাইকোর্টে দায়ের করা একটি রিটের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘১৯০৮ সালের বিস্ফোরক আইনের ৪ ও ৫ ধারায় মামলা করা হয়। এই দুই ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি যথাক্রমে ২০ ও ১২ বছর। এই দুই ধারায় মামলা দেওয়ার কারণ, তা জামিন অযোগ্য অপরাধ এবং দ্রুত বিচার ও শাস্তি দেওয়া সম্ভব। বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখতেই এসব ধারায় মামলা করা হয়। এ ছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫ ধারাসহ আরও কয়েকটি ধারায় মামলা দেওয়া হয়। বিশেষ ক্ষমতা আইনে নাশকতার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তাই এই মামলায় সাধারণত নিম্ন আদালতের বিচারকরা জামিন দিতে চান না। এসব আইনে মামলা দেওয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে চাপে রাখা।’
এ সময় তিনি গায়েবি মামলার ক্ষেত্রে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
রিদওয়ানুল হক বলেন, “পুলিশ ‘হোমওয়ার্ক’ করে এসব মামলায় আসামি করছে। দেখা যায়, যারা রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের আয়োজন করেন, মানুষকে সংগঠিত করে সেখানে নিয়ে আসেন, তাদেরই আসামি করছে পুলিশ, যাতে তারা সামনে আন্দোলন করতে না পারে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিরোধী দলের আন্দোলন দমানো এবং নির্বাচনে সুবিধা নেওয়া।”
গোলাম মর্তুজা অন্তু বিভিন্ন মামলার বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, মামলা করার ক্ষেত্রে কতটা বেপরোয়া হলে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই মামলায় আসামি করা হয়, তা না দেখলে বোঝা যাবে না। এমনকি প্রবাসী কিংবা মৃত ব্যক্তিরাও এসব মামলা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ঢাকায় যেসব গায়েবি মামলা হয়েছে, তাতে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের আসামি করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানের মামলাগুলোতে নিম্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীকে আসামি করা হচ্ছে।
-সমকাল
একুশে সংবাদ/এসএপি
আপনার মতামত লিখুন :