স্তন ক্যানসার নিয়ে জনমানুষে কিছুটা ধ্যানধারণা থাকলেও, স্তন যক্ষ্মা-র (Breast Tuberculosis) ব্যাপারে কজনই বা জানেন? দেশে এই অসুখে আক্রান্তের সংখ্যা কম নয়। সমস্যা হলে তখন কী করবেন? এই অসুখও কি ছোঁয়াচে? নানা দিক বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস ক্যানসার হাসপাতালের ক্যানসার সার্জন ডা. সৌমেন দাস।
যক্ষ্মা বা টিবি শুনলেই প্রথমে মাথায় আসে ফুসফুসের অসুখের কথা। কিন্তু এই অসুখ যে স্তনেও হতে পারে এটা অনেকেরই অজানা। টিবির ব্যাকটিরিয়ার একটি অন্যতম স্থান হল ফুসফুস। প্রথমে ফুসফুস থেকে তারপর রক্তের মাধ্যমে তা ছড়ায় স্তনে। এইভাবেই একজন আক্রান্ত হন। পরিসংখ্যান বলছে এদেশে প্রতি ১০০ জন মহিলা যারা স্তনের সমস্যা নিয়ে চেম্বারে আসেন তাদের মধ্যে ৪-৫ জন স্তন টিবিতে আক্রান্ত। কাজেই চিন্তার অবশ্যই। আর শুধু যে মহিলারাই এতে আক্রান্ত হয় তা কিন্তু নয়। পুরুষদেরও এর প্রকোপ থেকে রেহাই নেই।
ঠিক কী হয়?
মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামক একটি ব্যাকটিরিয়া দ্বারা এই টিবি রোগ হয়। ব্রেস্ট টিবির বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই দেখা গেছে – প্রথমে ফুসফুস বা অন্য কোনও অংশে টিবি সংক্রমণ হয় – তারপর তা রক্তের মধ্য দিয়ে স্তনে বাসা বাধে। মাইকোবাক্টেরিয়াম টিউবারকুলোসিস ছাড়াও, অধুনা দেখা গিয়েছে অ্যাটিপিক্যাল মাইকোব্যাক্টেরিয়া নামক একদল ব্যাকটিরিয়া টিবির মতো স্তনে বিভিন্ন রোগ তৈরি করতে সক্ষম।
কী কী লক্ষণ থাকলে বুঝতে হবে স্তনেটিবি?
ব্রেস্ট টিবির একটি অন্যতম লক্ষণ হল ব্রেস্ট লাম্প। টিবির লক্ষণের সঙ্গে স্তন ক্যানসারেরও খুব মিল রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হল এটা যে টিবির লক্ষণ তা কিন্তু প্রায় অধিকাংশই বুঝতে পারেন না। রোগীরা বেশিরভাগই মনে করেন, ফোড়া হয়েছে বা স্তনে কোনও টিউমার রয়েছে। তাই রোগ নির্ণয় হতে অনেক সময় নেয়। তাই স্তনে কোনও ফোড়া হলে বা পুঁজ জমলে সতর্ক হতে হবে। আর কোনও মাংসপিণ্ড থাকলে, যদি সেখানে ব্যথা না-ও থাকে তবুও সতর্ক হতে হবে। বারবার স্তনে পুজ জমতে থাকলে টিবি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অনেক সময় প্রথমে ওষুধ খেয়ে পুজ জমা কমে যেতে পারে। কিন্তু টিবি হলে তা বারবার হবে। স্তনে বা নিপলে ঘা বা আলসার হতে থাকলে, স্তন থেকে লালচে রস বেরতে থাকলে, ব্যথা হলে সাবধান হোন। অনেক সময় আবার স্তনে কোনও লক্ষণই থাকে না, বগলে কোনও লাম্প বা ফোলা অংশ দেখা যেতে পারে। সেটাও কিন্তু স্তনে টিবির ভাইরাস থাকলে তা থেকে হতে পারে।
রোগ নির্ণয়
স্তনে এই ধরনের লক্ষণ থাকলে ট্রিপল অ্যাসেসমেন্ট করে রোগ নির্ণয় করা খুব জরুরি। এক্ষেত্রে তিনটি স্তরে রোগ নির্ণয় হয়। প্রথমে চিকিৎসক হাত দিয়ে রোগীর স্তন পরীক্ষা করে দেখেন, তাকে বলা হয় ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট। দ্বিতীয় ধাপে করা হয়, রেডিওলজিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট। এক্ষেত্রে আল্ট্রাসাউন্ড ও ম্যামোগ্রাফির মাধ্যমে স্তনের লাম্প বা টিউমার কী ধরনের তা নির্ণয় করা হয়। তৃতীয় ধাপে করা হয়, প্যাথোলজিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট। এখানে ছুচ ফুটিয়ে কোর বায়োপসি করে দেখা হয় টিউমার ক্যানসারাস না কি এক্ষেত্রে টিবির জীবাণু রয়েছে। কোর বায়োপসি করলে অনেকেই মনে করেন রোগ হয়তো ছড়িয়ে পড়বে। এই ধারণা কিন্তু একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। কোর বায়োপসি স্তনের রোগ নির্ণয়ে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষা। এটাই সঠিক রোগ নির্ণয় করতে পারে।
স্তন টিবিও কি ছোয়াচে?
স্তন ক্যানসার ছোঁয়াচে নয়। কিন্তু স্তন টিবি ছোঁয়াচে। এক্ষেত্রে লালারসে রোগ ছড়ায় না। বেশি প্রবণতা থাকে স্তনের পুজ থেকে রোগ ছড়ানোর। স্তন থেকে পোশাকে যদি সেই পুজ লাগে এবং তা যদি শরীরের অন্য কোনও কাটা স্থানে লাগে বা অন্য কারও শরীরে লাগে তা থেকে একে অপরের মধ্যে টিবির জীবাণু ছড়িয়ে যায়। ফলে তা থেকে যে কোনও স্থানে টিবি হতে পারে।
এই অসুখ কী পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব?
যদি সঠিক সময়ে স্তন টিবি নির্ণয় করা যায় তাহলে ওষুধেই এই রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব। সাধারণত ৬-৯ মাসের ওষুধ রয়েছে। সেই ওষুধের ডোজ ধৈর্য ধরে সম্পূর্ণ করলেই রোগ পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব। স্তন টিবির চিকিৎসায় হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন প্রায় নেই বললেই চলে।
কাদের ঝুকি বেশি?
সাধারণত যাদের ইমিউনিটি কম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের এই রোগের সম্ভাবনা বেশি। বিশেষত ডায়াবেটিস, এইচআইভি, কিংবা কোনও ক্যানসার থাকলে কেমো চললে সেক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, ফলত স্তন টিবির সম্ভাবনা প্রকট হয়। যারা ধূমপান ও মদ্যপান করেন তাদেরও কিন্তু ইমিউনিটি কম থাকার জন্য এই ধরনের সংক্রমণের ঝুকি বেশি। তবে, এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলব, পারিবারিক ইতিহাসের সঙ্গে স্তন টিবির কোনও যোগসূত্র নেই।
কী কী মানবেন? কীভাবে সতর্ক থাকবেন?
টিবি রোগ ছোয়াচে। তাই এই অসুখ থেকে নিজেকে বাচিয়ে রাখতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা খুব জরুরি। নিজের জামাকাপড়, গামছা বা তোয়ালে কারও সঙ্গে শেয়ার করা উচিত নয়। আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখা দরকার। এক্ষেত্রে জীবনযাপন ঠিক রাখা, সঠিক ডায়েট মেনে খাওয়া ও পর্যাপ্ত ঘুম খুব জরুরি। সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন করে দেখা জরুরি। অর্থাৎ স্তনে কোনও লাম্প রয়েছে কি না সেটা নিজেই নিজের স্তনে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। কোনও অসামঞ্জস্য পেলে তখনই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।
একুশে সংবাদ/স.প্র/না.স
আপনার মতামত লিখুন :