বয়ঃসন্ধিকাল হলো সন্তানের বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর । এ সময় দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলি হঠাৎ করেই তাদের মধ্যে চলে আসে। বয়ঃসন্ধিকাল কমবেশি সব ছেলেমেয়ের ওপরেই প্রভাব ফেলে। এই সময়ে শরীর আর মনে হানা দেয় বিভিন্ন ধরণের সমস্যা।
অনেককেই ঘিরে ধরে অভিমান, অবসাদ, হতাশা। সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের এক অদ্ভূত স্পৃহাও কাজ করে অনেকের মধ্যে। ফলে কিশোর কিশোরীদের আবেগজাত ও আচরণগত নানা পরিবর্তন আসে এই সময়ে। এই সময়ে ছেলেমেয়েদের ব্যবহার ও আচরণে এমন কিছু দেখা দেয় যা পরবর্তী কালে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।
তার মধ্যে একটি হল কথায় কথায় মিথ্যা বলা। এই বয়সের অনেক ছেলেমেয়েই কল্পনার জগতে বিচরণ করে। ফলে গল্প বানিয়ে বলার অভ্যাস তৈরি হয় অনেকের মধ্যে। এমন পরিস্থিতিতে বাবা-মায়েদের কী করা উচিত? এই বিষয়ে পেরেন্টিং কনসালট্যান্টরা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন।
অনেক সময়ে বাবা-মা বন্ধু হিসেবে সন্তানদের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করলেও পারেন না। আবার ছেলেমেয়েদের মনে উঁকি মারা কৌতূহলকে অনেকেই এড়িয়ে যেতে চান। ফলে ওই বয়সের ছেলেমেয়েরা তাদের সমস্যা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে কুণ্ঠাবোধ করে। আর মিথ্যা বলার অভ্যাস তৈরি হয় সেখান থেকেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত তিনটি কারণে কৈশোরে মিথ্যা বলার অভ্যাস তৈরি হতে পারে।
প্রথমত, বাবা-মায়েদের নিজেদের মধ্যে সমস্যা, অশান্তি, চিৎকার করে কথা বলা, বকুনি, অতিরিক্ত উপদেশ দেওয়া এবং সন্তানের কোনো কথাতেই কর্ণপাত না করার প্রবণতা তাদের মনকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে। মনের ভিতরে যে চাপা অভিমান ও ক্ষোভের জন্ম হয়, তার থেকেই মিথ্যা বলার প্রবণতা তৈরি হয়।
দ্বিতীয়ত, অন্যের সঙ্গে সব সময়ে তুলনা টেনে কথা বলেন অনেক বাবা-মা। সকলের সামনেই তা করেন। অনেক সময়ে দেখা যায়, দুই সন্তান হলে যার গুণ ও প্রতিভা বেশি, তার সঙ্গেই তুলনা বেশি করা হয়। ফলে নিজের সম্মান বজায় রাখতে ও নিজেকে সেরা প্রমাণ করতে মিথ্যা বা কল্পনার আশ্রয় নেয় ছেলেমেয়েরা।
তৃতীয়ত, কেবল অভ্যাস। মানে এমনি এমনিই মিথ্যা বলা। একে বলে ‘প্যাথোলজিক্যাল লাইং’। এই প্রবণতা ছোটকাল থেকেই শুরু হয়। কেবল দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে ভালবাসে অনেকে।
মিথ্যা যখন মনের ব্যাধি: অভ্যাসবশে যে মিথ্যা বলা হয় তাকে ‘কমপালসিভ লাইং’ বলা হয়, যা বড় ধরনের ক্ষতি করে না অনেক সময়েই। ছেলেমেয়েরা যদি বোঝে তারা পরিবারে বা বন্ধুদের মাঝে অবহেলিত অথবা তাদের ভাবনাকে কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না, তখন কোনো চাঞ্চল্যকর কথা বলে বা গল্প বলে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে চায় তারা। আবার এমনও অনেক ছেলেমেয়ে রয়েছে যারা মিথ্যা বলে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে। অনেক সময়ে অপরাধপ্রবণতা থেকেও এমন হতে পারে। সেই মিথ্যা যদি কারো ক্ষতি করে তখন তা চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে বাবা-মাকে শুরু থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। বুঝিয়ে কাজ না হলে থেরাপির আশ্রয়ও নিতে হতে পারে। কারণে অকারণে মিথ্যা বলার অভ্যাস ‘অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার’-এর কারণও হয়ে উঠতে পারে। বাবা-মা বা পরিবারের কারো যদি এমন মিথ্যা বলার অভ্যাস থাকে, তা হলে তার থেকেও ছোটরা তা শিখে যায়।
সোহাগ নাকি শাসন, যেভাবে বোঝাবেন
১। শান্ত মনে ধৈর্য রেখে কথোপকথনের পথে যেতে হবে বাবা-মাকে। বকুনি বা উপদেশ দেওয়া, গায়ে হাত তোলা, কটু কথা বা গালমন্দ করলে মিথ্যা বলার জেদ আরো চেপে বসবে। তাই সন্তানের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনাই শ্রেয়।
২। সন্তানের সব বিষয়ে অনধিকার চর্চা করবেন না। মেয়ে যদি আপনার সামনে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে না চায়, তাহলে আপনি সরে যান। সব কাজে বাধা দিলে তাদের ক্ষোভ বাড়বে। তার থেকেই গোপন করা বা মিথ্যা বলার প্রবণতা তৈরি হবে। সব বিষয়ে নাক না গলিয়ে সন্তানকে সতর্ক নজর রাখা যায়।
৩। মনোযোগ আকর্ষণ করতে যদি মিথ্যা বলে, সেই মুহূর্তে ভুল শুধরে দিন। বলুন আপনি রেগে যাননি বা বকাঝকা করবেন না। শুধু জানতে চাইছেন, সে কেন এমন কথা বলছে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রথম বারেই হয়তো শুনবে না, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে শিখে যাবে।
৪। সন্তানকে সময় দিন। বয়ঃসন্ধিতে অহেতুক উপদেশ বা নীতিকথা শোনার রুচি থাকে না এখনকার ছেলেমেয়েদের। তাই বন্ধুর মতোই মিশতে হবে। তার ভাল লাগা, মন্দ লাগাগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। তার কথা শুনুন, শ্রোতা হয়ে যান। তা হলেই আপনার প্রতি ভরসার জায়গা তৈরি হবে।
৫। অনেক সময়ে বন্ধুদের প্রভাবেও মিথ্যা বলার ঝোঁক তৈরি হয়। বাবা-মাকে খেয়াল রাখতে হবে সন্তান কার কার সঙ্গে মিশছে, কোন কথাটি গোপন করছে। শাসনের বাড়াবাড়ি না করে বোঝাতে হবে যে বয়ঃসন্ধিতে কী কী ভুল হতে পারে, কোন পদক্ষেপে ক্ষতি হতে পারে। নিরাপত্তার বিষয়টি ধৈর্য ধরে বোঝালেই দেখবেন সন্তান আপনার কথা শুনছে।
সূত্র : আনন্দবাজার
একুশে সংবাদ/ক.ক./সা.এ
আপনার মতামত লিখুন :