AB Bank
ঢাকা রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতে পরিবার হত্যার ঘটনা জানতে পারেন শেখ হাসিনা


Ekushey Sangbad
SA Polash (এসএ পলাশ)
১১:৩৫ এএম, ১৫ আগস্ট, ২০২৩
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতে পরিবার হত্যার ঘটনা জানতে পারেন শেখ হাসিনা

আজ থেকে ৪৮ বছর আগে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। দেশের বাইরে থাকায় বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় প্রাণে বেঁচে যান। স্ত্রী শেখ হাসিনা ও শ্যালিকা শেখ রেহানা যেভাবে পিতা, মাতা আর ভাইদের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন, তা নিয়ে লিখেছিলেন পরমানু বিজ্ঞানী ড: এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া।

 

ওয়াজেদ মিয়ার লেখা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’গ্রন্থে তিনি যেভাবে লিখেছেন তা হবহু সেভাবে তুলে ধরা হল।

 

১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টায় ঘুম ভাঙ্গে ম্যাডাম রাষ্ট্রদূতের ডাকে। তিনি জানান যে, জার্মানীর বন থেকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাদের জন্য ফোন করেছেন। প্রথমে হাসিনাকে পাঠিয়ে দিই তার সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু দুই-এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে হাসিনা আমাকে জানায় যে, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। হাসিনাকে তখন ভীষণ চিন্তিত ও উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছিল। আমি দ্রুত নীচে দোতলায় চলে যাই। তখন সেখানে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় মাথা হেঁট করে রাষ্ট্রদূত সাহেব ধীরে ধীরে পায়চারি করছিলেন।

 

আমাকে দেখেও তিনি কোন কথা বললেন না। ফোনের রিসিভারটি ধরতেই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে বললেন, আজ ভোরে বাংলাদেশে ‍‍`ক্যু-দে-টা‍‍` হয়ে গেছে। আপনারা প্যারিস যাবেন না। রেহানা ও হাসিনাকে এ কথা জানাবেন না। এক্ষুণি আপনারা আমার এখানে বনে চলে আসুন।

 

"প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছে" একথা আমি তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এর বেশী আপাততঃ আমি আর কিছুই জানি না। একথা বলেই তিনি আমাকে ফোনের রিসিভারটি সানাউল হক সাহেবকে দিতে বলেন। অতঃপর আমি আস্তে আস্তে তিনতলায় আমাদের কক্ষে চলে যাই। সেখানে পৌঁছাতেই হাসিনা অশ্রুজড়িত কণ্ঠে আমার কাছ থেকে জানতে চায় হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে কি বলেছেন। তখন আমি শুধু বললাম যে, তিনি আমাদেরকে প্যারিস যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিল করে সেদিনই বনে ফিরে যেতে বলেছেন। একথা বলেই আমি বাথরুমে ঢুকে পড়ি। সেখানে এটাসেটা ভাবতে ভাবতে বেশ খানিকটা সময় কাটাই। ততক্ষণে রেহানা সজাগ হয়ে আমাদের কামরায় চলে আসে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই রেহানা ও হাসিনা দু‍‍`জনেই কাঁদতে কাঁদতে বলে যে, নিশ্চয়ই কোন দুঃসংবাদ আছে যা আমি তাদেরকে বলতে চাই না। তারা আরও বলে যে, প্যারিসে না যাওয়ার কারণ তাদেরকে পরিষ্কারভাবে না বলা পর্যন্ত তারা ঐ বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না। অতএব, বাধ্য হয়েই আমি তাদেরকে বলি যে, বাংলাদেশে কি একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে যার জন্য আমাদের প্যারিস যাওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না। একথা শুনে তারা দু‍‍`বোন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তাদের কান্নায় ছেলেমেয়েদেরও ঘুম ভেঙ্গে যায়।

 

১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমরা বনের উদ্দেশে ব্রাসেলস ত্যাগ করি। পথে রেহানা ও হাসিনা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমরা বনে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের বাসায় পৌঁছাই। সেদিন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন যুগোশ্লাভিয়ায় সফর শেষে বাংলাদেশে ফেরার পথে ফ্রাংফুর্টে যাত্রা বিরতি করে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের বাসায় উঠেছেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী, ডঃ কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তিনজন মিলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া রেহানা ও হাসিনাকে ধরাধরি করে বাসার ভেতর নিয়ে যান। ড্রইংরুমে এভাবে কিছুক্ষণ কাটানোর পর হুমায়ুন রশীদ সাহেবের স্ত্রী হাসিনাদের ওপর তলায় নিয়ে যান।


তখন ড্রইং রুমে ডঃ কামাল হোসেন, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও আমি ভীষণ উৎকণ্ঠিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অন্যান্য রেডিও স্টেশন থেকে বাংলাদেশের তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করতে থাকি। এরই এক ফাঁকে আমি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ঘরের বাইরে নিয়ে গিয়ে তার কাছ থেকে ১৫ই আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চাই। নিরাপদ স্থানে না পৌঁছানো পর্যন্ত হাসিনাদের আমি কোন কিছু জানতে দেবো না, এই শর্তে তিনি আমাকে বললেন, "বিবিসি-এর এক ভাষ্যানুসারে রাসেল ও বেগম মুজিব ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই এবং ঢাকাস্থ ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত বিবরণীতে বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কোথায় আশ্রয় নেয়া নিরাপদজনক হবে, তার কাছ থেকে একথা জানতে চাইলে তিনি বললেন, “উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একমাত্র ভারত ছাড়া আর কোন দেশ আপনাদের জন্য নিরাপদ নয়।"


পরদিন অর্থাৎ ১৬ই আগস্ট সকাল আটটার দিকে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করার জন্য ডঃ কামাল হোসেন বনস্থ বিমান বন্দরে যাবেন বলে আমাকে জানানো হয়। ডঃ কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে আমিও গাড়ীতে উঠে বসি। বিমান বন্দরে ডঃ কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দু‍‍`জনে একত্রে কিছু গোপন আলাপ করেন। অতঃপর আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার মুহূর্তে আমি ডঃ কামাল হোসেন সাহেবের হাত ধরে তাকে বললাম, "খন্দকার মোশতাক আহমদ খুব সম্ভবত আপনাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখার চেষ্টা করবেন। অনুগ্রহ করে আমার কাছে ওয়াদা করুন যে, আপনি কোন অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে আপোষ করে তার মন্ত্রী পরিষদে যোগদান করবেন না।


আমার এই প্রশ্নের জবাবে ডঃ কামাল হোসেন আমাকে বললেন, ডঃ ওয়াজেদ, প্রয়োজন হলে বিদেশেই মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছি। কিন্তু কোন অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আপোষ করে আমি দেশে ফিরতে পারি না।" এই কথাগুলো বলেই তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভেতরে চলে যান।

 

বিমান বন্দর থেকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসায় ফিরে হাসিনার কাছ থেকে জানতে পারি যে, ইতিপূর্বে লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মোমিনুল হক খোকা (কাকা) ওদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। তিনি আমাদেরকে লন্ডনে তার কাছে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এক সময়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ছোট ভাই কায়সার রশীদ চৌধুরী তাকে ফোন করেন। এই পরিস্থিতিতে খন্দকার মোশতাক আহমদের বিরুদ্ধে কোন কিছু না করার জন্য কায়সার চৌধুরী তাকে হুঁশিয়ার করে দেন। কায়সার রশীদ চৌধুরী, রেহানা ও হাসিনার সঙ্গেও কথা বলে তাদেরকে সান্তনা দেন। অতঃপর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, রেহানা, হাসিনা ও আমাকে বলেন যে, লন্ডনে চলে যাওয়া সাব্যস্ত করলে আমরা সেখানে তার বাসায় পিয়ে উঠতে পারি। তবে তিনি আমাদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন যে, সেখানে মাত্র একটি সমস্যা আছে। ঐ বাসার নীচ তলায় কায়সার রশীদ চৌধুরী বসবাস করে এবং সে ভুট্টোর অন্ধ ভক্ত।


উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ১৫ই আগস্ট তারিখে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো, খন্দকার মোশতাক আহমদের সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তার সঙ্গে তব্যাপারে একাত্মতা ঘোষণা করার জন্য। যাহোক, ঐদিনই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে কার্লসরুয়ে পাঠালেন সেখান থেকে আমার বইপত্র ও অন্যান্য ভারী জিনিসপত্র নিয়ে আসার জন্য।

 

আমি সেদিন কার্লসরুয়ে গিয়ে বনে ফিরে আসি রাত সাড়ে দশটার দিকে। কিন্তু সেদিন সাপ্তাহিক ছুটির কারণে অফিস বন্ধ থাকায় আমি কোন বইপত্র বা অন্য কোন জিনিসপত্র সঙ্গে আনতে পারিনি। রাত এগারোটার দিকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তার স্ত্রী ও আমাকে সঙ্গে নিয়ে নিজে গাড়ী চালিয়ে বাড়ীর বাইরে যান। পথে তিনি বলেন যে, একটি পূর্ব নির্ধারিত স্থানে ভারতীয় দূতাবাসের তার পরিচিত একজন অফিসিয়াল আমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন আমাকে তাদের স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যাহোক, উক্ত নির্ধারিত স্থানে পৌঁছার পর ভারতীয় সেই অফিসিয়ালের সঙ্গে তিনি আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকে তার কাছে রেখে দ্রুত বাসায় ফিরে যান। ফিরে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে পরামর্শ দেন যে, তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শেষে রওনা হওয়ার সময় আমি যেন তাকে ফোনে অবহিত করি।


অতঃপর ভারতীয় ঐ অফিসিয়ালের সঙ্গে আমি তাদের রাষ্ট্রদূতের বাসায় যাই। তখন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ছিলেন একজন মুসলমান জার্নালিস্ট। একটু ভয়ে ভয়ে আমাদের বিপর্যয়ের কথা আমি তাকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করি। আমার কথা শোনার পর তিনি আমাকে লিখে দিতে বলেন যে, আমরা ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে কি চাই। অতঃপর তিনি সাদা কাগজ ও একটি কলম আমার হাতে তুলে দেন। তখন মানসিক দুশ্চিন্তা ও অজানা শংকায় আমার হাত কাঁপছিলো। যাহোক, অতিকষ্টে রেহানাসহ আমার পরিবারবর্গের নাম উল্লেখপূর্বক সকলের পক্ষ থেকে আমি লিখলাম, "শ্যালিকা রেহানা, স্ত্রী হাসিনা, শিশু ছেলে জয়, শিশু মেয়ে পুতলি এবং আমার নিজের কেবলমাত্র ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের নিকট কামনা করি রাজনৈতিক আশ্রয়।"

 

১৭ই আগস্ট রোববার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সারাক্ষণ বাসায় ছিলেন। ঐ দিন লন্ডন থেকে আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতা ও বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় রেহানা ও হাসিনাকে ফোন করেন। এক সময় সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পত্নী আমাদেরকে ফোন করে জানান যে, তিনি ঢাকায় তার স্বামীর সঙ্গে ইতিপূর্বে কথা বলেছেন এবং তিনি আশ্বাস দেন যে, আমাদের ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। রাতে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমার কাছ থেকে জানতে চান যে, তিনি আমাদেরকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারেন কি না। আমি তাকে জানাই যে, হাসিনারা প্রত্যেকে মাত্র পঁচিশ ডলার সঙ্গে নিয়ে এসেছে। কার্লসরুয়ে পেষ্ট হাউসে আমি রেহানার জন্য একটি পৃথক কক্ষ ভাড়া নিয়েছি। অতঃপর আমি তাকে হাসিনার সঙ্গে ঐ বিষয়ে আলাপ করার জন্য পরামর্শ দিই। তখন হাসিনার সঙ্গে আলাপ করে আমরা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে জানাই যে, মাত্র হাজারখানেক জার্মান মুদ্রা দিলেই আমরা মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারবো।


১৬ই আগস্ট ডঃ কামাল হোসেন লন্ডন চলে যাওয়ার পর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দেশের কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট আমলার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনেক গোপন ও চাঞ্চল্যকর কাহিনী আমাকে শোনান। তিনি বলেন যে, তার ছোট ভাই, কায়সার রশীদ চৌধুরী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর একান্ত সচিব ছিলেন যখন তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মন্ত্রী পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ঐ সময় জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনেক অপকর্ম ও কুকর্মে প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো কায়সার রশীদ চৌধুরীর। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে তার ভূমিকা সম্পর্কেও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাকে অনেক কাহিনী শোনান। তিনি তখন দিল্লীস্থ পাকিস্তানী দূতাবাসে কাউন্সিলর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১-এ পাকিস্তানী পক্ষ ত্যাগ করে তৎকালীন বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের প্রতি সমর্থন ও আনুগত্য ঘোষণার পূর্বে তাকে দাপ্তরিক কাজে করাচী হয়ে ইসলামাবাদ যেতে হয়েছিল কয়েকবার। তখন পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন তার গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখতো। ১৯৭১-এর আগস্ট মাসে দিল্লী থেকে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ সফর শেষে ফেরার পথে করাচী বিমান বন্দরে তাকে গ্রেপ্তার করারও নির্দেশ দিয়েছিল পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য ইসলামাবাদ থেকে তদুদ্দেশে প্রেরিত টেলেক্স বার্তাটি করাচীস্থ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ায় তিনি সেবার ভাগ্যক্রমে রেহাই পান। অতঃপর দিল্লী পৌঁছেই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী পাকিস্তানী পক্ষ পরিত্যাগ করে তৎকালীন বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের প্রতি তার সমর্থন ও আনুগত্য ঘোষণা করেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাকে আরও জানান যে, ১৯৭১-এ কোলকাতায় খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে তৎকালীন আওয়ামী লীগের জহিরুল কায়উম, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, বিপ্লবী সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক সচিব মাহবুবুল আলম চাষী ও কোলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশন প্রধান হোসেন আলীসহ কতিপয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপন্থী প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব জোর গোপন তৎপরতা চালিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাহত ও নস্যাৎ করার জন্য।


১৯৭৫-এ আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর রাজধানী লিমায় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু ইতিপূর্বে ডঃ কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের যথাক্রমে দলপতি ও সচিব নিযুক্ত করেছিলেন। যে কারনে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী নিউইয়র্ক ও লিমায় হোটেলও রিজার্ভ করে রেখেছিলেন। কিন্তু ১৫ই আগস্টের ঘটনার পর খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দখল করায় তার লিমা সম্মেলনে যোগদান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর দৃঢ়ৃ বিশ্বাস যে, খন্দকার মোশতাক আহমদ তাকে কোন অবস্থাতেই লিমা সম্মেলনে যেতে দেবেন না। কিন্তু তখন স্বল্প সময়ের মধ্যে নিউইয়র্ক ও লিমান্থ হোটেলসমূহে তার পূর্ব নির্ধারিত রিজার্ভেশন বাতিল করা সহজ হবে যদি তিনি লন্ডন যান। সেই মোতাবেক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ১৮ই আগষ্ট তারিখে সপত্নীক লন্ডন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

 

১৮ই আগস্ট সোমবার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সাহেব অফিস থেকে বাসায় ফিরেন দুপুর বারোটার দিকে। তিনি আমাদের সঙ্গে দুপুরে খাওয়ার সময় আমাদেরকে কার্লসরুয়ে শহরে পৌঁছেই যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সেসম্পর্কে আমাকে বিস্তারিতভাবে অবহিত করেন। এর এক ফাঁকে তার সাহায্য ও সহানুভুতির প্রতীকস্বরূপ তিনি হাসিনাকে এক হাজার জার্মান মুদ্রা প্রদান করেন এবং ভবিষ্যতেও আমাদের তার সাধ্যমত টাকা- পয়সাসহ সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন। অতঃপর কার্লসরুয়ের উদ্দেশে রওনা হওয়ার মুহূর্তে ঘরের বাইরে এসে দেখি যে, হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী তার সরকারী রাষ্ট্রদূতের গাড়ীটি আমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন। তিনি আমাকে এও বলেন যে, কার্লসরুয়ে আমাদের জরুরি কাজগুলো সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমি যেন ঐ গাড়ীটিকে সেখানে রেখে দেই। তার এই সহমর্মিতা ও মহানুভবতায় আমি আবেগে এত অভিভুত হয়ে যাই যে, তখন আমার দু‍‍`চোখ অশ্রুতে আপ্লুত হয়ে পড়ে। এর জন্য তাকে ধন্যবাদ দেয়ার অন্য কোন ভাষা খুঁজে না পেয়ে আমি হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলাম।

 

১৮ই আগস্ট বন থেকে ৩৫০ কিলোমিটার ভ্রমণ করে আমরা নিরাপদে কার্লসরুয়ে পৌছাই সন্ধ্যে সাতটার দিকে। আমাদের কার্লসরুয়ে পৌঁছার সংবাদ পেয়ে সেখানে ছুটে আসে কার্লসরুয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রীর জন্য তখন গবেষণারত শহীদ হোসেন এবং কার্লসরুয়ে পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে প্রশিক্ষণরত আমার কনিষ্ট সহকর্মী আমিরুল ইসলাম। অতঃপর হাসিনাদের গেস্ট হাউসে রেখে আমি শহীদ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের কার্লসরুয়েতে উপস্থিতির কথা রিপোর্ট করার জন্য যাই সেখানকার বিশেষ নিরাপত্তা বিষয়ক দপ্তরে। ১৯শে আগস্ট আমি কার্লসরুয়ে পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র থেকে আমার বইপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে আসি এবং অন্যান্য জরুরী কাজকর্ম সম্পন্ন করি উক্ত গাড়ীটি ব্যবহার করে। ২০শে আগষ্ট তারিখে আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের ঐ গাড়ীটি ফেরত পাঠিয়ে দিই। শোক ও শঙ্কায় তখন আমরা এত মূহ্যমান হয়ে পড়ি যে, আমাদের দেখাশুনার ভার নিতে হয় শহীদ হোসেন ও আমিরুল ইসলামকে। গেস্ট হাউসে আমাদের কক্ষ দু‍‍`টির পাশের কক্ষটি ভাড়া নেয়া হয় শহীদ হোসেন ও আমিরুল ইসলামের জন্য।

 

২২শে আগস্ট বন থেকে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে ফোন করে ওদের (ভারতীয় দূতাবাসের) কেউ আমার সঙ্গে কার্লসরুয়েতে যোগাযোগ করেছেন কি না সেসম্পর্কে জেনে নেন। ২৩শে আগস্ট সকালে বনস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আমাকে ফোনে জানান যে, সেদিনই তার অফিসের একজন ফার্স্ট সেক্রেটারী কার্লসরুয়েতে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। বিকেল ২টার দিকে ঐ কর্মকর্তা ঐ গেস্ট হাউসে এসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন তিনি আমাকে এও জানান যে, তিনি পরদিন অর্থাৎ ২৪শে আগস্ট সকাল ১টার দিকে আমাদেরকে ফ্লাংফুর্ট বিমান বন্দরে নিয়ে যাবেন। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঐ ভদ্রলোক উক্ত গেস্ট হাউসে পৌঁছান। অতঃপর মালপত্রসহ দুটো ট্যাক্সিতে আমরা কার্লসরুয়ে রেলওয়ে স্টেশনে যাই ফ্লাংফুর্ট শহরে যাওয়ার জন্য। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আমি শহীদ হোসেনকেও সঙ্গে নেই। বিমান বন্দরের বহির্গমন হলে প্রবেশ করার মুহূর্তে শহীদ হোসেনের নিকট হতে বিদায় নেয়ার সময় তাকে শুধু আকার-ইঙ্গিতে জানাই যে, আমরা কোথায় যাচ্ছি। উল্লেখ্য, ভারতীয় ঐ কর্মকর্তা আমাদেরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন উক্ত ব্যাপারটি সম্পূর্ণ গোপন রাখার জন্য। শহীদ হোসেনও তখন মুখে কিছু বললো না। সে আমাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলো। তখন আমাদের জন্য সহমর্মিতা ও সমবেদনায় তার দু‍‍`চোখ ছিল অশ্রুতে ভরা।

 

আমরা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি জাম্বো বিমানে (পশ্চিম) জার্মানীর ফ্লাংফুর্ট থেকে দিল্লীস্থ পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করি ২৫শে আগস্ট সকাল সাড়ে আটটার দিকে। " আগমন হলে‍‍` কাউকেও দেখলাম না আমাদের খোঁজ করতে। দেখতে দেখতে ঐ বিমানে আগত প্রায় সব যাত্রিই চলে যান। মেরামত ও নবরূপায়ণ কাজের জন্য উক্ত হলটির শীতলীকরণ সিস্টেম বন্ধ ছিল। নানান দুশ্চিন্তা ও শঙ্কা এবং আগস্ট মাসের প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ার কারণে তখন আমার শরীর থেকে অঝোরে ঘাম করছিলো। যাহোক, সেখানের এক কর্মকর্তার অফিস থেকে ফোনে ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম প্রায় পৌনে এক ঘন্টা ধরে কিন্তু কাউকে পেলাম না। ফলে, আমার দুশ্চিন্তা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। মানসিকভাবে বিপর্যন্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় উক্ত অফিস থেকে হল ঘরে এসে হাসিনাদের সেখানে দেখতে না পেয়ে ভীষণ শঙ্কিত হয়ে পড়ি। যাহোক, এর একটু পরেই একজন শিখ কর্মকর্তা পাশের বিশ্রাম কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে আমার কাছ থেকে জানতে চান যে, আমি উক্ত দুই মহিলার সহযাত্রী কি না। আমি তাদের সফরসঙ্গী জেনে শিখ কর্মকর্তাটি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ঐ যুবতী মহিলাদ্বয়কে ঐ দুই বাচ্চাসহ ভিআইপি হিসেবে এই বিমান বন্দর হয়ে যেতে দেখেছিলাম। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস যে, আজকে তাদের কি নিদারুণ করুণ অবস্থা। এটা একেবারেই একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য।”

 

প্রায় আধঘন্টা পর ঐ শিখ কর্মকর্তাটি আমাকে জানান যে, কতিপয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অতি শিগগির সেখানে পৌঁছবেন আমাদের ব্যাপারে কিছু একটা ব্যবস্থা করার জন্য। এরও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর দুইজন কর্মকর্তা এলেন আমাদের খোঁজে। তাদের একজন নিজেকে ভারত সরকারের মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব বলে পরিচয় দিলেন। বিমান বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অতিক্রান্ত হয়। অতঃপর ঐ দুই কর্মকর্তা আমাদেরকে দুটো ট্যাক্সিতে বিমান বন্দর থেকে নয়াদিল্লীর ডিফেন্স কলোনীর একটি বাসায় নিয়ে যান। তখন ভারতীয় সময় দুপুর ১টা। সুদীর্ঘ চার ঘন্টা বিমান বন্দরে অপেক্ষা, দিল্লীর প্রচণ্ড আবহাওয়া, পারিবারিক শোক, নিজেদের নিরাপত্তা এবং নানান দুশ্চিন্তা ও শঙ্কায় আমি তখন শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়ে দারুণভাবে বিপর্যন্ত।

 

ডিফেন্স কলোনীর বাড়ীটির নীচতলায় ডাইনিং-কাম-ড্রইংরুম এবং প্রত্যেকটি সংযুক্ত বাথরুমসহ দুটো শয়নকক্ষ। এর ছাদে সংযুক্ত বাথরুমসহ একটি শয়নকক্ষ যা তখন গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দুপুরের খাবার ও বিকেলের চা-নাস্তা খাওয়ার পর ঐ দুই কর্মকর্তা চলে যান। ঐ বাড়ীর জানালায় কোন গ্রীল ছিলো না। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই আমরা সিদ্ধান্ত নেই রাতে রেহানাসহ সবাই মিলে একই শয়নকক্ষে থাকার। পরদিন অর্থাৎ ২৬শে আগস্ট উক্ত কর্মকর্তাদ্বয় ঐ বাসায় আসেন আমাদের খবরাখবর জানার জন্যে। তারা আমাকে পরামর্শ দেন সবকিছু বিস্তারিতভাবে উল্লেখপূর্বক জার্মানীর আমার ঐ স্কলারশিপটি কয়েক মাসের জন্য সংরক্ষিত রাখার অনুরোধ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখতে। অতঃপর ২৭শে আগস্ট তারিখে আমি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ঐমর্মে পত্র পাঠাই।

 

ঐ বাড়ীর চত্বরের বাইরে না যাওয়া, সেখানকার কারোরও নিকট আমাদের পরিচয় না দেয়া কিংবা দিল্লীর কারোও সঙ্গে যোগাযোগ না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিলো আমাদের সকলকে। অতএব নিঃসঙ্গ অবস্থায় ঐ বাড়ীর অতি ক্ষুদ্র চত্বরের মধ্যে আবদ্ধ থাকি আমরা সকলেই। আমি রাতে শুয়ে সারাক্ষণ জেগে থাকতাম এক রকম নিরাপত্তা প্রহরীর মত। মাঝে মাঝে জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরের গেটের দিকে তাকাতাম। রাতে কয়েক ঘন্টা পর পর গেটে প্রহরারত দারোয়ানের সঙ্গে বাইরের লোকের ফিসফিস কথা বলা সন্দেহের উদ্রেক করতো। এরূপ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে মাঝে মধ্যে হাসিনাকে সজাগ করতাম। সারা ভারতে তখন জরুরি অবস্থা আইন বলবৎ ছিল। সংবাদপত্রে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষ কোন সংবাদ প্রকাশিত হতো না। কাজেই তখনকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে আমরা থাকি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। এভাবেই অতিবাহিত হয় সপ্তাহ দুয়েক।

 

ইতোমধ্যে রেহানাসহ বাচ্চারা চক্ষুপীড়ায় (কনজাংটিভাইটিসে) আক্রান্ত হয়। এমন সময়ে একদিন ভারত সরকারের উক্ত যুগ্ম সচিব হাসিনা ও আমাকে জানান যে, ঐ রাতে আটটায় আমাদের দু‍‍`জনকে অন্য এক বাসায় নেয়া হবে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য। সে রাতে সেই বাসায় যাওয়ার পথে অপর একটি গাড়ীতে আমাদের সংগে যান একজন অতি উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তা। সেখান থেকে মিনিট পনের জার্নি করার পর আমরা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে পৌঁছাই। অতঃপর অতি উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন ঐ কর্মকর্তা আমাদের দু‍‍`জনকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের একটি মাঝারি ধরনের বৈঠকখানায় নিয়ে যান। একটি লম্বা সোফায় হাসিনাকে বসানো হয় আর আমাকে আর একটি লম্বা সোফায়। এর প্রায় মিনিট দশেক পর শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী উক্ত কক্ষে প্রবেশ করে হাসিনার পাশে বসেন। সামান্য কুশলাদি বিনিময়ের পর ইন্দিরা গান্ধী আমার কাছ থেকে জানতে চান যে, আমরা ১৫ই আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত রয়েছি কি না। এর জবাবে আমাদের জার্মানীর বনে থাকাকালীন সময়ে ১৫ই আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাকে ‍‍`রয়টার‍‍` পরিবেশিত এবং ঢাকাস্থ বৃটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত যে দুটো ভাষ্যের কথা বলেছিলেন আমি তার পুনরুল্লেখ করি। অতঃপর ইন্দিরা গান্ধী সেখানে উপস্থিত ঐ কর্মকর্তাকে ১৫ই আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে সর্বশেষপ্রাপ্ত তথ্য জানাতে বলেন। তখন উক্ত কর্মকর্তা দুঃখভারাক্রান্ত মনে ইন্দিরা গান্ধীকে জানান যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। এই সংবাদে হাসিনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। 

 

ইন্দিরা গান্ধী তখন হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে তাকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টায় বলেন, "তুমি যা হারিয়েছো তা আর কোনভাবেই পূরণ করা যাবে না। তোমার একটি শিশু ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। এখন থেকে তোমার ছেলেকেই তোমার আম্মা এবং মেয়েকে তোমার মা হিসেবে ভাবতে হবে। এ ছাড়াও তোমার ছোট বোন ও তোমার স্বামী রয়েছে তোমার সঙ্গে। এখন তোমার ছেলে-মেয়ে ও বোনকে মানুষ করার ভার তোমাকেই নিতে হবে। অতএব এখন তোমার কোন অবস্থাতেই ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।” 

 

উল্লেখ্য, ১৯৭৬-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতা থাকাকালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এটাই ছিল আমাদের একমাত্র সাক্ষাৎকার।

 

একুশে সংবাদ/এপি

Link copied!