কাশবন আর সবুজের বেষ্টনি ভেদ করে এগিয়ে চলেছে রেলগাড়ি। নবনির্মিত রেলট্র্যাকে ঝকঝকা ঝক দ্যোতনা তুলে এ যেন দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জন্য আশীর্বাদের বাহন হতে চলেছে আজ। সফলভাবে পদ্মা সেতুতে সড়ক যোগাযোগ চালু হবার পর এবার দেশের দক্ষিণাঞ্চলবাসীর কাছে উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে রেল সংযোগের দখিনা দুয়ার। শুধু আধুনিকই নয়, দৃষ্টিনন্দন এ রেল সংযোগ প্রকল্পটির মাধ্যমে আরও একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে দেশের রেলখাত।
পদ্মা সেতু হয়ে দেশের দক্ষিণের পথে নতুন রেলপথটি ঢাকার গেন্ডারিয়া, কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ থেকে পদ্মা সেতু হয়ে মাদারীপুর ও ফরিদপুর গেছে। আগামী বছর এ রেলপথের বাকি অংশ ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত চালুর লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। কী কী আছে এ মেগা প্রকল্পটিতে চলুন বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে এ জাতির যেমন গৌরবের প্রকল্প। তেমনি এ সেতুর সব সুবিধা এখনো পাচ্ছেন না দেশবাসী। তবে বহুমুখী এ সেতুর বহুমাত্রিক যোগাযোগ এবার উন্মুক্ত হচ্ছে সাড়ম্বরে।
মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) ঘটা করে পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে দেশের রেলখাতে সবচেয়ে বড় এ প্রকল্পটি দেশবাসীর কাছে হস্তান্তর করবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
মূলত পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন চালাতে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার নতুন রেলট্র্যাক নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে নির্মাণের পর এ প্রকল্প এখন বাস্তব। সুপ্রশস্ত পিচঢালা পথের পাশেই ব্র্যান্ড নিউ রেলট্র্যাক তৈরি করছে অভূতপূর্ব দৃশ্যপটের।
নতুন এ লাইনটিকে দেশের সবচেয়ে আধুনিক রেলট্র্যাক বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, প্রথাগত লাইনের পাশাপাশি এখানে স্থাপন করা হয়েছে পাথরবিহীন ট্র্যাক, যা ভ্রমণ আরামদায়ক এবং নিরাপদ করবে বলে প্রত্যাশা রেল প্রকৌশলীদের। আশা করা হচ্ছে, পুরোপুরি বাণিজ্যিকযাত্রা শুরু হলে এই ট্র্যাকে অন্তত ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারবে ট্রেন।
হিসেব মতে, মূলত তিন ধাপে এ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা থেকে মাওয়া, মাওয়া থেকে ভাঙ্গা এবং ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের অগ্রগতি হয়েছে ৯৭.৫ শতাংশ। ঢাকা-মাওয়া অংশের অগ্রগতি ৮৩ শতাংশ এবং ভাঙ্গা থেকে যশোর সেকশনের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ।
নতুন এ রেলপথে রয়েছে ২০টি স্টেশন। এর মধ্যে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে ১৬টি স্টেশন এবং আগে থেকে রয়েছে ৪টি স্টেশন। এছাড়াও এসব স্টেশন আধুনিক টেলিযোগাযোগসহ থাকবে সিবিআই সিস্টেম এর সিগন্যালিং ব্যবস্থা।
এছাড়া, প্রকল্পের আওতায় মেইন লাইন থাকছে ১৬৯ কিলোমিটার। লুপ এবং সাইডিং প্রায় ৫৪ কিলোমিটার। ঢাকা-গেন্ডারিয়া প্রায় ৪ কিলোমিটারের ৩টি লাইনসহ মোট ২২৭ কিলোমিটার রেলট্র্যাক বানানো শেষ। পাশাপাশি, এই পথে রয়েছে ২৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট, র্যাম্পস ১.৯৮ কি.মি., মেজর ব্রিজ ৬০টি এবং মাইনর ব্রিজ ২৭২টি। শুধু তাই নয়, নিরাপত্তার জন্য তৈরি করা হয়েছে ২৯টি লেভেল ক্রসিং।
মূল সেতু তো বটেই। সড়ক পথের সঙ্গে এবার রেল যোগাযোগ চালু হলে যোগাযোগ নেটওয়ার্কে অভূতপূর্ব এই উন্নয়ন দেশকে আরো এগিয়ে নেবে বলে প্রত্যাশা দেশবাসীর।
একনজরে পদ্মা সেতু রেল প্রকল্প
২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু করা হয়। দ্বিতল এ সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। সেতুর ভেতরে রয়েছে ট্রেন চলাচলের পথ। পদ্মার দুই পাড়ে যোগাযোগ স্থাপন করতে নেয়া হয় আলাদা প্রকল্প, যা পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্প নামে পরিচিত।
তিন অংশে ভাগ করে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রথম অংশ ঢাকা-মাওয়ার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৮ কিলোমিটার। এই অংশে কেরানীগঞ্জে একটি নতুন স্টেশন তৈরি হচ্ছে। মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৩ কিলোমিটার। এই অংশে নতুন স্টেশন ভবন রয়েছে পাঁচটি। এই দুই অংশ আজ উদ্বোধন হচ্ছে। প্রকল্পের শেষ অংশ ভাঙ্গা থেকে যশোর। এই অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ৮৩ কিলোমিটার। স্টেশনের সংখ্যা ১৪। প্রকল্পের মেয়াদ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত পুরো রেলপথটি চালুর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। মাঠপর্যায়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৩ মে একনেকে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। অনুমোদনের সময় প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। বর্তমানে এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। প্রকল্পটি সরকারের অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত (ফাস্ট ট্র্যাক)। চীনের অর্থায়নে ওই দেশেরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রেলপথ নির্মাণের কাজটি করছে।
নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর সংযোগ রেলপথে কী পরিমাণ যাত্রী ও মালামাল পরিবহন হতে পারে, তার একটি বিশ্লেষণ এরই মধ্যে তৈরি করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ (সিআরইসি)। স্বল্পমেয়াদি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ রেলপথটির ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে প্রতিদিন ১৩ জোড়া ট্রেন চলবে। একইভাবে ভাঙ্গা-কাশিয়ানী অংশে প্রতিদিন সাত জোড়া ও কাশিয়ানী-যশোর অংশে প্রতিদিন চলবে পাঁচ জোড়া ট্রেন। এ সময়ের মধ্যে ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে বছরে ৪০ লাখ, ভাঙ্গা-কাশিয়ানী অংশে বছরে ১৭ লাখ ও কাশিয়ানী-যশোর অংশে বছরে সাড়ে ১৩ লাখ যাত্রী পরিবহন করা হবে। ‘ওয়ান-ডিরেকশন’ বা একমুখী চলাচলের ওপর ভিত্তি করে এই প্রাক্কলন তৈরি করেছে সিআরইসি।
দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র আর সংকট পেছনে ফেলে প্রমত্তা পদ্মার বুকে এই বিস্ময়কর অবকাঠামো নির্মাণ মানুষের আত্মবিশ্বাস জাগানিয়া অন্যতম স্থাপনা হিসেবেও এখন বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত। এই মেগাস্ট্রাকচারের সুফল ঘরে তুলে গণমানুষ নতুন সম্ভাবনার পথে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে এগিয়ে যাবে গন্তব্যে।
একুশে সংবাদ/এসআর
আপনার মতামত লিখুন :