ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র ছোঁবলে প্রাণ গেল ৭ জনের। বাড়িঘর ছাড়াও ক্ষতির তালিকায় আমন ধান। কোথাও বা আংশিক আবার কোথাও বা পুরোপুরি বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি।মিধিলির প্রভাবে ভারী বৃষ্টি ও ঝড়ে দেয়াল ধসে, গাছের ডাল ভেঙে অন্তত ৭ জন মারা যাবার থবর এসেছে। উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় হাজারের বেশি কাঁচা ঘরবাড়ির ক্ষতিগ্রস্ত। কৃষি অধিদপ্তর জানাচ্ছে, টানা বর্ষণে উঠতি আমন ফসলও ক্ষতির মুখে পড়েছে।
শুক্রবারে বয়ে যাওয়া ‘মিধিলি’র তাণ্ডবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেললাইনে গাছ উপড়ে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম-নোয়াখালী-সিলেট তথা পূর্বাঞ্চলের ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল প্রায় দুই ঘণ্টা। বেশ কিছু এলাকায় বড় বড় গাছ ভেঙে ও উপড়ে পড়ে যান চলাচল ব্যাহত হয়েছে।
প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে উপকূলীয় অনেক জায়গা দুপুরের পর থেকে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিল। এদিন বিকালে বিদ্যুতের চাহিদা বিপরীতে অর্ধেকে নেমে আসে। উপকূলের চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। টানা বৃষ্টির মধ্যে সরকারি ছুটির দিনে রাস্তায় যানবাহন ও মানুষজনের আনাগোনা ছিল একেবারেই কম।
পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগরে গত ১৪ নভেম্বর একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে সেই ঘূর্ণিবায়ুর চক্র ১৫ নভেম্বর নিম্নচাপে পরিণত হয়। তারপর বাঁক নিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে বৃহস্পতিবার পরিণত হয় গভীর নিম্নচাপে। পরে সেটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়।
এ অবস্থায় মোংলা ও পায়রা বন্দরকে ৭ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দরের ৬ নম্বর বিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়। শুক্রবার বেলা ১টার দিকে ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে মোংলা-পায়রা উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’।
পরের দুই ঘণ্টায় বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে বেলা ৩টার দিকে তা পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসলেও তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আবহাওয়াবিদরা গত দু’দিন ধরেই বলে আসছিলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট এই ঘূর্ণিঝড়টি অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা নেই। ঘূর্ণিঝড়টি বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল হওয়ার পর বিপৎসংকেত নামিয়ে তিন নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
বৃহস্পতিবার দিনগত রাত ৩টা নাগাদ প্রবল বর্ষণে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজারের মরিচ্যাঘোনার পানিরছড়া এলাকায় বসতঘরের মাটির দেয়াল চাপায় এক পরিবারের ৪জন নিহত হন। এরা হচ্ছে, ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের পানিরছড়ার ফকির মোহাম্মদের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৫০), ছেলে শাহিদুল মোস্তফা (২০), মেয়ে নিলুফা ইয়াছমিন (১৫) ও সাদিয়া বেগম (১১)।
দমকা হাওয়ায় গাছের ঢাল ভেঙে বিকালে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার মগধারা ইউনিয়নের আব্দুল ওহাব (৭২) এবং মীরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাপাহাড় এলাকার আনোয়ার হোসেনের শিশু সিদরাতুল মুনতাহা আরিয়া (৪) মারা গেছেন। টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলা পরিষদের গেইটের সামনে গাছের ডাল ভেঙে ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক (৪০) মারা গেছেন।
নোয়াখালীর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বসান কর্মকর্তা মো. জাহিদ হাসান খান রাতে সাংবাদিকদের বলেন, জেলার ৩৪টি ইউনিয়নে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ২২১টি বাড়িঘর আর অংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও ৯১৩টি। মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছয় হাজার ৭৬০ জন।
বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওজোপাডিকোর বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফারুক হোসেন সংয়বাদমাধ্যমকে জানান, তার অধীনে ১৬ ফিডারের মাধ্যমে ৬৫ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টা পর্যন্ত ৪০ ভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি গ্রহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহে কাজ চলছে।
বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মঞ্জুরুল ইসলাম জানান, তার ফিডারে ৬৪ হাজার গ্রাহক আছেন। এর মধ্যে সন্ধ্যা সোয়া ৭টা নাগাদ ৭০ ভাগ গ্রাহকের বিদ্যুৎ চালু করা হয়েছে। বরিশাল আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক বশির আহমেদ জানান, বিকাল ৩টা পর্যন্ত বরিশালে ২১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে পটুয়াখালীতে আমন ধানে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঝড়ে বিভিন্ন এলাকায় গাছপালা পড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বেশকিছু কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সুমন দেবনাথ বলেন, ঝড়ে জেলায় মোট ১৩৩টি ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দশমিনা উপজেলায় ৭৫টি, রাঙ্গাবালী ২৬টি, মির্জাগঞ্জে ১৯টি, দুমকিতে ৯টি, কলাপাড়ায় দুটি, বাউফল ও সদর উপজেলা একটি করে ঘর রয়েছে।
পটুয়াখালী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামার বাড়ির উপ-পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ায় ধানসহ কৃষির বেশ ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এবার পটুয়াখালীতে এক লাখ ৯১ হাজার ১১৯ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে; এর মধ্যে ৫ ভাগ পাকা ও ২০ ভাগ আধাপাকা অবস্থায় আছে। এ ছাড়া ৭৫ ভাগ ধানে ফুল আসছে। ঝড় হাওয়ায় ধানে চিটা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
একুশে সংবাদ/এস কে
আপনার মতামত লিখুন :