রাজধানীর বাড্ডার সাতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে মারা গেছে শিশু আয়ান আহমেদ। তার মৃত্যুর ঘটনায় ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে মামলা হয়েছে।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, যখন বাড্ডার ইউনাইটেড হাসপাতালে আয়ানের অবস্থা খারাপ হয়, তখন তাকে নেওয়া হয় গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখানে ৩১ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত আয়ানকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এরপর তাকে মৃত ঘোষণা করে হাসপাতাল থেকে প্রায় পৌনে ৬ লাখ টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) মামলাটি বাড্ডা থানায় করেন শিশুর বাবা মো. শামীম আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা অনেক বড় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়ছি। কতটুকু সফল হবো জানি না। এই হাসপাতাল আমাদের বাসা থেকে কাছে, আর বড় প্রতিষ্ঠান দেখেই এখানে আসা। তারা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই। আগামীকাল মানববন্ধন করবো এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অভিযোগ জানাবো।
আয়ানের দাদা আবদুস সালাম কবীর বলেন, আমরা এক কাপড়ে আছি গত ১০ দিন ধরে। আমার ফুটফুটে সুন্দর নাতিরে ওরা মেরে ফেলেছে।
এই বলে কান্না করে দেন আয়ানের দাদা। বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকুল আবেদন জানাই, যাতে তিনি আমাদের দিকে দেখেন। তিনি যাতে এর কোনো ব্যবস্থা নেন।
বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন গাজী বলেন, আয়ানের বাবা মো. শামীম আহমেদ অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে মামলাটি করেছেন। মামলায় ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুই চিকিৎসক ও পরিচালককে আসামি করা হয়েছে।
আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ওই হাসপাতালের এনেসথেসিয়া স্পেশালিস্ট ডা. সাইদ সাব্বির আহমেদ, হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. তাসনুভা মাহজাবিন। তবে পরিচালকের নাম জানা যায়নি।
মামলার এজাহারে শামীম উল্লেখ করেন, আয়ান আহমেদের বয়স ৫ বছর ৯ মাস। ২০২৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় খাতনা করানোর জন্য আয়ানকে নিয়ে সাতারকুলের ইউনাইটেড হাসপাতালে যাই। এরপর ভিজিট দিয়ে সিরিয়াল নিয়ে ডাক্তার তাসনুভা মাহজাবিনের রুমে গিয়ে খাতনার বিষয়ে আলোচনা করি।
তখন ডা. তাসনুভা আমার ছেলে আয়ানকে দেখে বলেন, খাতনার আগে ওষুধ খাওয়ানোর ফলে বাচ্চার ১০-১৫ মিনিট ঘুমঘুম ভাব থাকে। এসময়ের মধ্যেই আমরা খাতনা শেষ করি এবং এটাই সব চেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি।’
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, ডা. সাব্বির আহমেদ (১ নম্বর আসামি) এবং ডা. তাসনুভা (২ নম্বর আসামি) আমার ছেলের শারীরিক পরীক্ষার জন্য কিছু টেস্ট দেন। টেস্টের রিপোর্টসহ ৩১ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় আবার যেতে বলেন। এরপর সেই হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে টেস্টের জন্য স্যাম্পল দিয়ে ছেলেকে নিয়ে বাসায় যাই।
‘পরদিন ৩১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৮টায় ছেলেকে নিয়ে আবার হাসপাতালে গিয়ে রিপোর্ট নিয়ে ডা. তাসনুভাকে দেখাই। তিনি রিপোর্ট দেখে বলেন, রিপোর্টে ভালো আছে। এরপর সকাল ৯টায় ওই দুই ডাক্তার তাদের নার্সদের সহযোগিতায় আয়ানকে ওটি রুমে (অপারেশন রুম) নিয়ে যান। একই সঙ্গে আমাদের ২০-২৫ মিনিট অপেক্ষা করতে বলেন।’
মামলার এজাহারে শামীম আরও উল্লেখ করেন, এরই মধ্যে ৩০-৪০ জন ইন্টার্ন ডাক্তার ওটি ড্রেস পরে ওটি রুমে প্রবেশ করেন। আমি তাদের ওটি রুমে প্রবেশ করার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, ডা. তাসনুভা মাহজাবিনের ক্লাস আছে। এরপর ২০-২৫ মিনিট পর আমি জিজ্ঞাসা করলে আরও কিছু সময় লাগবে বলে সময় পার করতে থাকেন তারা। এর ১ ঘণ্টা পরে ইন্টার্ন ডাক্তাররা ওটি থেকে বের হয়ে চলে যান। তারা চলে যাওয়ার পর আরও সময় লাগবে বলে কালক্ষেপণ করতে থাকেন।
এরপর ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট পর, হাসপাতালের বিভিন্ন ডাক্তাররা উদ্বিগ্নভাবে ওটি রুমে প্রবেশ করেন এবং বের হতে থাকেন। তখন আমরা বুঝতে পারি যে, কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। তখন আমি জোর করে ওটি রুমে প্রবেশ করে দেখি যে, ডাক্তাররা আমার ছেলের বুকে হাত দিয়ে চাপাচাপি করছেন। অনুমতি ছাড়াই তারা ছেলের বুকের দুই পাশ ফুটা করে টিউব স্থাপন করেন। এরপরও কোনো কাজ না হওয়ায় তারা তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আমার ছেলেকে দ্রুত গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতাল নিয়ে যান। সেখানে নিয়ে ছেলেকে লাইফ সাপোর্টে রাখেন।’
মামলার এজাহারে বলা হয়, ৩১ ডিসেম্বর রাতে হাসপাতালের আইসিইউতে প্রবেশ করে ছেলের দেহ শীতল ও নিথর অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। এই হাসপাতালের প্রতি আমাদের অনাস্থা বাড়লে, উন্নত চিকিৎসার জন্য ছেলেকে অন্য হাসপাতালে নিতে চাইলে, ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ জোর করেই তাদের হাসপাতালে রাখে।
শিশু আয়ানের বাবা বলেন, ডাক্তারদের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার কারণেই আমার ছেলের মৃত্যু হয়। ছেলেকে তারা কি ধরনের চিকিৎসা বা ওষুধ দিয়েছে তা এখন পর্যন্ত জানায়নি। এমনকি তারা ছেলেকে দেখতে চাইলে নানা তালবাহানা করে ঠিকমতো দেখতে দেননি।
এজাহারে বলা হয়, অধিক লাভবান হওয়ার জন্য ৩১ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি রাত ১১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ইউনাইটেড হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় আয়ানকে। এরপর তারা তাকে মৃত ঘোষণা করে মরদেহসহ ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৫৭ টাকার একটা বিল ধরিয়ে দেয়।
একুশে সংবাদ/আ.ট.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :